ইউক্রেন ভূখণ্ড ছাড় না দিলে রাশিয়া লড়াই চালিয়ে যাবে: শান্তি আলোচনার মধ্যেই পুতিনের হুঁশিয়ারি
ইউক্রেন যুদ্ধের অবসানে নিজের পুরোনো দাবিতেই অনড় রয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তিনি দ্ব্যর্থহীনভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, মস্কোর দাবি করা ভূখণ্ড থেকে কিয়েভ তাদের সেনা প্রত্যাহার করলেই কেবল রাশিয়া অস্ত্র সংবরণ করবে—নইলে তার সেনাবাহিনী বল প্রয়োগ করে সে ভূখণ্ড দখল করবে।
পুতিন দীর্ঘদিন ধরেই ইউক্রেনের দখল করা অঞ্চলগুলোর আইনি স্বীকৃতি দাবি করে আসছেন। এর মধ্যে ২০১৪ সালে দখল করা ক্রিমিয়া এবং বর্তমানে আংশিক দখলে থাকা দনবাস অঞ্চল অন্তর্ভুক্ত। তবে কিয়েভ সাফ জানিয়ে দিয়েছে, দনবাসের যেসব অংশ এখনো তাদের নিয়ন্ত্রণে আছে, তা ছাড়ার প্রশ্নই আসে না। আগ্রাসনের পুরস্কার হিসেবে রাশিয়াকে ভূখণ্ড ছেড়ে দেওয়া তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
পুতিনের এই বক্তব্যের পর ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, রাশিয়া প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধ শেষ করার প্রচেষ্টাকে 'তাচ্ছিল্য' করেছে।
কিরগিজস্তান সফরের সময় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে পুতিন অভিযোগ করেন, কিয়েভ 'শেষ ইউক্রেনীয় বেঁচে থাকা পর্যন্ত' লড়াই করতে চায়। পাল্টা হুঁশিয়ারি দিয়ে তিনি বলেন, নীতিগতভাবে রাশিয়াও এর জন্য প্রস্তুত।
পুতিন দাবি করেন, যুদ্ধক্ষেত্রের নিয়ন্ত্রণ রাশিয়ার হাতেই রয়েছে এবং লুহানস্ক ও দোনেৎস্ক নিয়ে গঠিত দনবাস থেকে ইউক্রেনীয় সেনারা সরে গেলেই কেবল যুদ্ধ থামবে। তার ভাষায়, 'যদি তারা সরে না যায়, তবে আমরা অস্ত্রের জোরেই তা অর্জন করব।'
তবে পূর্ব ইউক্রেনে রাশিয়ার ধীরগতির অগ্রগতির জন্য চড়া মূল্য দিতে হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক 'ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ার'-এর মতে, বর্তমান গতিতে দোনেৎস্কের বাকি অংশ দখল করতে মস্কোর আরও প্রায় দুই বছর সময় লাগবে।
কূটনৈতিক তৎপরতা ও মার্কিন প্রস্তাব
গত এক সপ্তাহের ব্যস্ত কূটনৈতিক তৎপরতা নিয়ে এই প্রথম মুখ খুললেন পুতিন। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেনের মধ্যে একটি শান্তি পরিকল্পনা নিয়ে নিবিড় আলোচনা হয়েছে, যা গত অক্টোবরে মার্কিন ও রুশ কর্মকর্তারা তৈরি করেছিলেন বলে জানা গেছে। জেনেভায় ইউক্রেন ও মার্কিন আলোচকদের মধ্যে সেই পরিকল্পনার সংশোধিত সংস্করণ নিয়ে আলোচনা হয়। সেখানে ইউরোপীয় প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন।
তবে ধারণা করা হচ্ছে, মস্কো ও কিয়েভের মধ্যে সবচেয়ে বড় বিরোধের জায়গা—দখলকৃত অঞ্চল এবং ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চয়তা—বিষয়ে পরিকল্পনাটিতে এখনো অস্পষ্টতা রয়েছে।
পুতিন জানিয়েছেন, নতুন খসড়া পরিকল্পনাটি রাশিয়াকে দেখানো হয়েছে এবং এটি যুদ্ধ অবসানের ভবিষ্যতের চুক্তির 'ভিত্তি' হতে পারে। তবে তিনি যোগ করেন, 'কূটনৈতিক ভাষায় কিছু নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা করা একান্ত প্রয়োজন।'
ক্রিমিয়া ও দনবাসের ওপর রাশিয়ার 'কার্যত' নিয়ন্ত্রণ থাকবে কিন্তু 'আইনি' স্বীকৃতি থাকবে না—এমন সম্ভাবনার বিষয়ে জানতে চাইলে পুতিন বলেন, 'আমেরিকানদের সঙ্গে আমাদের আলোচনার মূল বিষয় এটিই।'
পুতিন নিশ্চিত করেছেন, মার্কিন বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফের নেতৃত্বে একটি মার্কিন প্রতিনিধিদল আগামী সপ্তাহের প্রথমার্ধে মস্কো সফরে যাবে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছেন, মস্কোয় উইটকফের সঙ্গে তার জামাতা জারেড কুশনারও যোগ দিতে পারেন। অন্যদিকে, মার্কিন সেনাসচিব ড্যান ড্রিষকলের চলতি সপ্তাহের শেষের দিকে কিয়েভ সফরের কথা রয়েছে।
বৃহস্পতিবার রাতে এক ভিডিও বার্তায় জেলেনস্কি বলেন, 'জেনেভায় নিশ্চিত হওয়া বিষয়গুলোকে শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চয়তার পথে নিয়ে যেতে' ইউক্রেন ও মার্কিন প্রতিনিধিদল বৈঠকে বসবে।
এর আগে বুধবার ট্রাম্প বলেছিলেন, রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে 'খুবই সামান্য কিছু বিষয়ে মতভেদ বাকি রয়েছে।' তবে ট্রাম্পের এই মন্তব্যে ইঙ্গিত মেলে যে, শান্তি চুক্তিতে ঐকমত্য হলেই কেবল জেলেনস্কির সঙ্গে বৈঠকে বসতে পারেন তিনি।
সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে পুতিন আবারও ইউক্রেনের নেতৃত্বের প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ করেন এবং তাদের 'অবৈধ' বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, তাদের সঙ্গে কোনো চুক্তিতে সই করা 'অর্থহীন'।
উল্লেখ্য, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে পূর্ণমাত্রার আগ্রাসন শুরুর পর সামরিক আইন জারি থাকায় ইউক্রেনে নির্ধারিত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। তবে দেশটির পার্লামেন্ট সর্বসম্মতিক্রমে প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির বৈধতা নিশ্চিত করেছে।
অন্যদিকে, আগামী কয়েক দশকের মধ্যে রাশিয়া ইউরোপে হামলা চালাতে পারে—ইউরোপীয় নেতাদের এমন সতর্কবার্তাকে 'হাস্যকর' বলে উড়িয়ে দিয়েছেন পুতিন। তিনি বলেন, 'এটা আমাদের কাছে সত্যিই হাস্যকর শোনায়।'
হোয়াইট হাউস এবং ডোনাল্ড ট্রাম্প সাম্প্রতিক শান্তি আলোচনা নিয়ে আশাবাদী হলেও ইউরোপীয় নেতারা বারবার সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তাদের প্রশ্ন, পুতিন আদৌ যুদ্ধ শেষ করতে চান কি না।
বুধবার ইউরোপীয় কমিশনের প্রধান উরসুলা ভন ডার লিয়েন অভিযোগ করেছেন, রাশিয়া এখনো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী মানসিকতা ধারণ করে এবং ইউরোপকে এমন এক 'প্রভাববলয়' হিসেবে দেখে, যেখানে স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোকে 'কেটে ভাগ করা' যায়।
