এআই কেন নতুন নতুন জ্ঞান তৈরি করতে পারে না
শিশুরা কীভাবে কথা বলতে শেখে? তারা কি শুধু বড়দের অনুকরণ করে? নাকি তাদের শেখার প্রক্রিয়াটা আরও জটিল? ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত 'রিফ্লেকশনস অন ল্যাঙ্গুয়েজ'-এ ভাষাবিজ্ঞানী নোয়াম চমস্কি এক দারুণ যুক্তি তুলে ধরেছিলেন। তার মতে, শিশুরা কেবল শুনে শুনে অনুকরণ করে না, বরং বিচ্ছিন্ন ও অগোছালো তথ্য থেকে তারা নিজেদের মতো করে একটি 'তত্ত্ব' তৈরি করে নেয়।
চমস্কির ব্যাখ্যা অনুযায়ী, শিশুরা যা শোনে, তার চেয়েও অনেক বেশি জ্ঞান তারা অনুমান করে নেয়। আর এর ফলেই তারা এমন সব নতুন বাক্য তৈরি করতে পারে, যার সঙ্গে তাদের পূর্ব অভিজ্ঞতার সরাসরি কোনো যোগসূত্র নেই। সহজ কথায়, শিশুরা শুধু অন্যের বলা বাক্য বা ধরন নকল করে না, তারা নিজেদের মতো করে মৌলিক জ্ঞানও তৈরি করে নেয়।
মানুষের শেখার প্রক্রিয়া এবং যুক্তিবোধকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) থেকে আলাদা করার জন্য চমস্কির এই পর্যবেক্ষণই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন উটাহ স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষক টেপ্পো ফেলিন এবং অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ম্যাথিয়াস হলওয়েগ।
২০২৪ সালের শেষ দিকে 'স্ট্র্যাটেজি সায়েন্স' জার্নালে প্রকাশিত তাদের গবেষণাপত্র 'থিওরি ইজ অল ইউ নিড: এআই, হিউম্যান কগনিশন, অ্যান্ড কজাল রিজনিং'-এ এই দুই গবেষক এআইয়ের ভাষা তৈরির প্রক্রিয়াকে 'পেছন দিকে তাকানো ও অনুকরণের' সঙ্গে তুলনা করেছেন।
অন্যদিকে, মানুষের জ্ঞান অর্জনের ক্ষমতাকে তারা বলছেন 'সামনের দিকে ধাবমান এবং নতুনত্ব তৈরির সক্ষমতা সম্পন্ন'। অর্থাৎ, এআই যেখানে পুরোনো ছাঁচ অনুসরণ করে, মানুষ সেখানে নতুনত্বের জন্ম দেয়।
ফেলিন বলেন, 'কিছু গবেষক দেখেছেন, শিশুরা কীভাবে তাদের চারপাশকে বোঝে। তারা শুধু তথ্য গ্রহণ করে না, বরং সব সময় কিছু অনুমান বা হাইপোথিসিস তৈরি করতে থাকে।'
তিনি জানান, তার অন্যতম লক্ষ্য হলো 'এআই ঘিরে যে উন্মাদনা চলছে, তার ভুল ভাঙানো।' তিনি মানুষের মন কীভাবে কারণ ও তত্ত্ব দিয়ে চিন্তা করে, তার অনন্য দিকগুলো তুলে ধরতে চান।
গবেষণাটির দাবি, মানুষের মন কেবল তথ্য প্রক্রিয়াজাতকারী যন্ত্র নয়। মানুষ শুধু পৃথিবী সম্পর্কে অনুমানই করে না, বরং এতে হস্তক্ষেপ করে, পরিবর্তন করে।
ফেলিন ও হলওয়েগ গ্যালিলিও গ্যালিলির উদাহরণ টেনে বলেন, ধরা যাক, কোনো এআইকে ১৬৩৩ সাল পর্যন্ত প্রচলিত হাজার হাজার বছরের ভূ-কেন্দ্রিক ধারণার ওপর ভিত্তি করে প্রশিক্ষণ দেওয়া হলো। এমন পরিস্থিতিতে সেই এআই কখনোই গ্যালিলিওর সূর্য-কেন্দ্রিক বা হেলিওসেন্ট্রিক মডেলকে মেনে নেবে না।
গবেষকরা এই বিষয়টিকে 'ডাটা-বিলিফ এসিমিট্রি' বলে উল্লেখ করেন। এর মানে হলো, বেশিরভাগ লেখায় যা বলা হয়েছে, এআই সেটাই সত্যি বলে গ্রহণ করবে। কিন্তু মানুষ এমন কিছুতেও বিশ্বাস স্থাপন করতে পারে, যা প্রচলিত তথ্যের সম্পূর্ণ বিপরীত। এই অপ্রতিসাম্যের কারণেই মানুষের মনে এমন সব ধারণা বা বিশ্বাস তৈরি হতে পারে, যা শুরুতে অযৌক্তিক বা বিদ্যমান জ্ঞানের পরিপন্থী মনে হলেও, শেষ পর্যন্ত তা নতুন নতুন আবিষ্কারের জন্ম দেয়।
ফেলিনের মতে, বড় বড় ল্যাঙ্গুয়েজ মডেলগুলো এখন পর্যন্ত কেবল অতীতের ছাঁচ বা ধরনগুলোকেই তুলে ধরে। তিনি বলেন, 'গ্যালিলিওর সময়ে প্রচলিত তথ্য এটাই বলতো যে পৃথিবী স্থির। আপনি চারপাশে তাকালে দেখবেন, পৃথিবী নড়ছে না, বরং সূর্য পূর্ব থেকে পশ্চিমে চলে যাচ্ছে। সুতরাং, ১৬৩৩ সালের তথ্যে প্রশিক্ষিত একটি এআই সেই মডেলকেই সঠিক বলে মেনে নেবে।'
এই বিষয়টি আরও ভালোভাবে বোঝাতে 'রাইট ব্রাদার্স এর উদাহরণ টেনে তারা বলেন, উনিশ শতকে বিজ্ঞানীরা মনে করতেন, ভারী কোনো বস্তুর পক্ষে ওড়া একেবারেই অসম্ভব। কিন্তু যখন বৈজ্ঞানিক মহল মানুষের আকাশে ওড়াকে অসম্ভব বলে রায় দিচ্ছিল, তখন অরভিল রাইট এবং উইলবার রাইট থেমে থাকেননি। উত্তোলন (লিফট), চালনা (প্রপেলশন) এবং দিকনির্দেশনার (স্টিয়ারিং) সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য তারা একের পর এক পরীক্ষা চালান। শেষ পর্যন্ত তারা প্রমাণ করেন যে, এটি সত্যিই সম্ভব।
ফেলিন বলেন, 'অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে কেবল মানুষের তাত্ত্বিক চিন্তাভাবনাই সুবিধা দেয়। কারণ সৃজনশীলতা নির্ভর করে সেই সব তত্ত্বের ওপর, যা তথ্যের প্রচলিত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে—অ্যালগরিদমের ওপর নয়।' তিনি আরও বলেন, 'এআই অতীতের তথ্য বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যতের ঘটনা সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করে। কিন্তু এই পদ্ধতি কেবল তখনই কাজ করে, যখন পরিবেশ অপরিবর্তিত থাকে এবং কোনো অনিশ্চয়তা না থাকে।'
ফেলিনের মতে, মানুষের যুক্তিবোধে সীমাবদ্ধতা থাকলেও, 'পরিবর্তনশীল' এই জগতকে সঠিকভাবে বোঝার জন্য এটিই একমাত্র উপায়। তিনি বলেন, 'মানুষ সীমিত পরিমাণ ডেটা প্রক্রিয়া করতে পারে, আমাদের পক্ষপাতিত্ব আছে এবং আমরা ভুল সিদ্ধান্তও নিই। কিন্তু দেখা যায়, আমরা একটি অত্যন্ত গতিশীল পরিবেশে বসবাস করি এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পক্ষে এর সঙ্গে মানিয়ে চলার কোনো উপায় নেই।'
এছাড়াও, ফেলিন যুক্তি দেন যে মানুষকে প্রতিদিন ডেটা ছাড়াই সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তিনি বলেন, 'এক অর্থে, আমরা ডেটার ওপর খুব বেশি গুরুত্ব দিয়েছি, কারণ আমাদের সামনে সব সময় সঠিক ডেটা থাকেনা। তাই আমাদের ভাবতে হয়, কীভাবে সেই ডেটা সংগ্রহ করা যায়, আর এটাই সৃজনশীলতার জন্ম দেয়।'
ফেলিন এআই সম্পর্কে কিছু বিশেষজ্ঞের মধ্যে তৈরি হওয়া 'আতঙ্ক' নিয়েও সতর্ক করেছেন। যেমন, গবেষণায় লেখকরা এআইয়ের অন্যতম 'পথপ্রদর্শক' এবং ২০১৮ সালের টিউরিং অ্যাওয়ার্ড বিজয়ী জিওফ্রে হিন্টনের কথা উল্লেখ করেন।
হিন্টন ধারণা করেছিলেন যে বড় ল্যাঙ্গুয়েজ মডেলগুলো শেষ পর্যন্ত এক ধরনের বুদ্ধিমত্তা দেখাতে পারে। লেখকরা এই ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করে যুক্তি দিয়েছেন যে মানুষের মনকে এই ধরনের যন্ত্রের সঙ্গে তুলনা করা 'ধারণাগতভাবে ত্রুটিপূর্ণ এবং দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে সংকুচিত'।
তিনি মনে করেন, এআই হলো 'সীমাবদ্ধতাসহ একটি প্রযুক্তি, বিশেষ করে এমন ক্ষেত্রে যেখানে প্রকৃত সৃজনশীলতা, সমস্যা তৈরি করা এবং কৌশলগত, দূরদর্শী সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়োজন হয়।'
'এআই যেমন, তাকে তেমনই দেখা উচিত। এটি হলো পরিসংখ্যান এবং মেশিন লার্নিংয়ের ব্যবহারিক প্রয়োগ, এর পেছনে রহস্যময় কোনও কিছু নেই,' বলেন ফেলিন।
