পাঠকের চাহিদা থাকলে এআইয়ের লেখা বইও বিক্রি করবে বিখ্যাত বই বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান ওয়াটারস্টোনস
পাঠকরা যদি চায় এবং বইয়ের গায়ে যদি স্পষ্ট করে লেখা থাকে, তবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই দিয়ে লেখা বই বিক্রি করতে আপত্তি নেই যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত বইয়ের চেইন শপ ওয়াটারস্টোনসের। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান জেমস ডন্ট এ কথা জানিয়েছেন।
যদিও তিনি ব্যক্তিগতভাবে মনে করেন না যে সহসাই এমন পরিস্থিতি তৈরি হবে।
জেমস ডন্ট বলেন, 'বর্তমানে প্রচুর এআই কনটেন্ট বা লেখা তৈরি হচ্ছে, যার বেশির ভাগই আমাদের দোকানে রাখার মতো মানসম্মত নয়।' তবে বিষয়টি শেষ পর্যন্ত পাঠকদের ওপরই নির্ভর করবে বলে জানান তিনি।
প্রকাশনাশিল্পে এআইয়ের ব্যবহার বৃদ্ধি নিয়ে বর্তমানে চলছে তুমুল বিতর্ক। এআইয়ের দাপটে নিজেদের রুজিরোজগার ও সৃজনশীলতা হুমকির মুখে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন লেখকরা।
জেমস বলেন, ওয়াটারস্টোনস তাদের লজিস্টিক বা পণ্য পরিবহনের ব্যবস্থাপনায় এআই ব্যবহার করে। তবে এআই দিয়ে লেখা বই দোকান থেকে দূরে রাখারই চেষ্টা করে তারা।
তিনি জানান, ওয়াটারস্টোনসের সাফল্যের মূলমন্ত্র হলো স্থানীয় ম্যানেজারদের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়া। কোন এলাকায় কোন বই চলবে, তা সেখানকার ম্যানেজাররাই ঠিক করেন। প্রধান কার্যালয়ের কাজ শুধু বইগুলো সময়মতো পৌঁছে দেওয়া, কিন্তু কোথায় কীভাবে সাজানো হবে—তা চাপিয়ে দেওয়া নয়।
কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গত মাসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অর্ধেকের বেশি প্রকাশিত লেখক তাদের কাজ হারানোর শঙ্কায় আছেন। তাদের ভয়, এআই হয়তো তাদের জায়গা দখল করে নেবে।
জরিপে অংশ নেওয়া দুই-তৃতীয়াংশ লেখক অভিযোগ করেছেন, জেনারেটিভ এআই বা লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেলকে প্রশিক্ষিত করতে তাদের লেখা অনুমতি ছাড়াই ব্যবহার করা হচ্ছে। এর জন্য কোনো সম্মানীও তারা পাচ্ছেন না।
তবে অনেক লেখক গবেষণার কাজে, উপন্যাস সম্পাদনায়, এমনকি পুরো বই লিখতেও এখন এআইয়ের সাহায্য নিচ্ছেন।
এ প্রসঙ্গে জেমস বলেন, 'আমাদের বই বিক্রেতারা কি এ ধরনের বই দোকানের সামনের সারিতে বা গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় সাজিয়ে রাখবেন? এমনটা হলে আমি অবাকই হব।'
তবে প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলা কঠিন। জেমস বলেন, 'কে জানে কী হবে! প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো এআইয়ের পেছনে হাজার হাজার কোটি ডলার ঢালছে। হয়তো একদিন এআই-ই 'ওয়ার অ্যান্ড পিস'-এর মতো কালজয়ী কোনো উপন্যাস লিখে ফেলবে।'
তিনি আরও বলেন, 'পাঠক যদি সেই বই পড়তে চান, তবে তা এআইয়ের লেখা হলেও আমরা বিক্রি করব। শর্ত একটাই, বইটিকে অন্য কিছু বলে চালিয়ে দেওয়া যাবে না।'
তবে ব্যক্তিগতভাবে এবং বই বিক্রেতা হিসেবে এআইয়ের লেখা বইয়ের প্রতি একধরনের 'স্বাভাবিক অনীহা' বোধ করেন জেমস। তিনি মনে করেন, পাঠকেরা লেখকের সঙ্গে একধরনের আত্মিক যোগাযোগ খোঁজেন, যার জন্য একজন 'রক্ত-মাংসের মানুষ' প্রয়োজন। তাই এআইয়ের লেখা কোনো বই বিক্রি হলে তার গায়ে বিষয়টি স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকতে হবে।
মৃদুভাষী জেমস পেশায় ছিলেন ব্যাংকার। তবে প্রথা ভাঙার সাহস তার পুরোনো। ২০১১ সালে ওয়াটারস্টোনসের দায়িত্ব নিয়ে তিনি এক বড় ঝুঁকি নিয়েছিলেন। তখন প্রকাশকরা টাকা দিলে তাদের বই দোকানের ভালো জায়গায় সাজিয়ে রাখা হতো। জেমস এসেই এই নিয়ম বন্ধ করে দেন।
এতে তাৎক্ষণিকভাবে কোম্পানি ২ কোটি ৭০ লাখ পাউন্ডের রাজস্ব হারায়, প্রকাশকদের মধ্যেও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ডন্টের কৌশলই জিতেছে। ২০১৬ সালে কোম্পানিটি আবার মুনাফার মুখ দেখে।
এখন ওয়াটারস্টোনসের কর্মীরাই ঠিক করেন কোন বই পাঠকের ভালো লাগবে। 'বুক অব দ্য মান্থ' বা মাসের সেরা বই তারাই বাছাই করেন। এমনকি টেবিলের ওপর কোন বইগুলো সাজানো থাকবে, সেই সিদ্ধান্তও নেন স্থানীয় দোকানের ম্যানেজার। বইয়ের পাশাপাশি কলম, রিডিং লাইট, নানা ধরনের খেলা ও স্টেশনারি পণ্যও বিক্রি হয় সেখানে।
এই কৌশলে ভর করেই টিকে আছে ওয়াটারস্টোনস। বছরে গড়ে ১০টি নতুন শোরুম খুলছে তারা। ২০২৪ সালে ৫২ কোটি ৮০ লাখ পাউন্ড বিক্রির বিপরীতে তাদের মুনাফা হয়েছে ৩ কোটি ৩০ লাখ পাউন্ড। হেজ ফান্ড এলিয়ট অ্যাডভাইজার্সের মালিকানাধীন এই গ্রুপের অধীনে ফয়েলস ও ব্ল্যাকওয়েলসের মতো বিখ্যাত বইয়ের দোকানও রয়েছে। জেমস ডন্ট বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের বড় চেইন শপ বার্নস অ্যান্ড নোবলেরও প্রধান নির্বাহী।
যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র—দুই জায়গাতেই সাফল্যের দেখা পাওয়ায় এখন গুঞ্জন চলছে, ওয়াটারস্টোনস ও বার্নস অ্যান্ড নোবল শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হতে পারে। জেমস মনে করেন, এটি একরকম অনিবার্য। তার মতে, কোনো প্রাইভেট ইকুইটি প্রতিষ্ঠানের কাছে বারবার হাতবদল হওয়ার চেয়ে শেয়ারবাজারে যাওয়াই ভালো। তবে লন্ডন নাকি নিউইয়র্ক—কোথায় তালিকাভুক্ত হবে, তা এখনো নিশ্চিত নয়।
