এআইয়ের জোয়ার কেন ‘ডটকম বুম’ এর মতো নয়
নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি শুরু হওয়া 'ডটকম বাবল' বা ইন্টারনেটের সেই উন্মাদনার কথা মনে আছে? সেই অতি উৎসাহ আর হুজুগই আজকের আধুনিক প্রযুক্তিবিশ্বের ভিত্তি গড়ে দিয়েছিল। কিন্তু ২০০০ সালের মার্চে যখন সেই বুদবুদ ফাটল, তখন পরিস্থিতি বেশ লেজেগোবরে হয়েছিল।
সিলিকন ভ্যালির সেই সংকট ছড়িয়ে পড়েছিল পুরো অর্থনীতিতে, দেখা দিয়েছিল মন্দা। শেয়ারবাজার থেকে উধাও হয়ে গিয়েছিল ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের সম্পদ। বেকারত্বের হার ৪ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৬ শতাংশে। হয়তো ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ ধস সেটি ছিল না, তবে সেই ধাক্কা সামলাতে বেশ কয়েক বছর সময় লেগে যায়।
বর্তমানে সিলিকন ভ্যালিতে চলছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআইয়ের জোয়ার। ডটকম বুদবুদের সঙ্গে এর বেশ মিল খুঁজে পাওয়া যায়। সেই সময়ের মতোই এবারও শোনা যাচ্ছে নতুন এক সোনালি ভবিষ্যতের বুলি। সেই একই প্রযুক্তিবিদেরা আবারও পাহাড়সমান সম্পদ গড়ছেন। গতকালও যেসব কোম্পানির অস্তিত্ব ছিল না, আজ তাদের আকাশচুম্বী দাম হাঁকানো হচ্ছে।
এত সব মিল থাকার পরও এমন অনেক কারণ আছে, যা নির্দেশ করছে এবারের ফলাফল ভিন্ন হতে পারে। প্রধান কারণটি হলো—এবারের এআই বিপ্লবের নিয়ন্ত্রণ মাইক্রোসফট, গুগল ও মেটার মতো ট্রিলিয়ন ডলারের কোম্পানিগুলোর হাতে। ডটকম আমলের ভুঁইফোড় স্টার্টআপগুলোর মতো এদের হুট করে দেউলিয়া হওয়ার বা ফুস করে নিভে যাওয়ার ভয় নেই। নব্বইয়ের দশকের কোম্পানিগুলোর সম্বল ছিল কেবল একটি আইডিয়া আর একদল প্রকৌশলী।
কিন্তু এখনকার চিত্র আলাদা। এআই ডেটা সেন্টারের পেছনে শত কোটি ডলার খরচ করলেও আমাজনের টুথপেস্ট বিক্রি কমছে না। কিংবা মৌলিক এআই মডেল তৈরি করতে গিয়ে গুগলের বিজ্ঞাপনের আয়েও টান পড়ছে না। তাদের আয়ের ভিত্তি মজবুত।
আরেকটা বড় পার্থক্য হলো রাজনীতি ও নিয়মকানুন। এআইয়ের পথে এখন আইনি বাধা নেই বললেই চলে। নব্বইয়ের দশকে ক্লিনটন প্রশাসন মাইক্রোসফটের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিয়েছিল। আর এখন ট্রাম্প প্রশাসন এআইয়ের ভবিষ্যৎ সুগম করতে সব ধরনের সহায়তাই করছে।
ডটকম ধসের পুনরাবৃত্তি না হওয়ার পেছনে আরেকটি মনস্তাত্ত্বিক কারণও আছে। বিষয়টি অনেকটা উল্টো—পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে কি না, তা নিয়ে সবাই চিন্তিত। এই দুশ্চিন্তাই প্রমাণ করে যে পরিস্থিতি আসলে এখনো নিয়ন্ত্রণের বাইরে যায়নি। অন্তত এখনো না।
এ বিষয়ে ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট বেন হরোউইটজ এক ই-মেইলে লিখেছেন, 'বুদবুদ তখনই তৈরি হয়, যখন সবাই বিশ্বাস করতে শুরু করে যে দাম আর কখনোই কমবে না। কিন্তু আমরা যে আসলে এখনো কোনো বুদবুদের মধ্যে নেই, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো—সবাই এখনই 'বুদবুদ' নিয়ে কথা বলছে।'
সেক্ষেত্রে বিপদটা আসলে কখন আসবে? বেন বলছেন, যখন দেখবেন এআই নিয়ে সব সমালোচনা থেমে গেছে এবং কট্টর সমালোচকেরাও ভুল স্বীকার করে এআই কোম্পানিতে বিনিয়োগ করতে শুরু করেছেন, তখনই বুঝবেন বিপদ আসন্ন। অর্থাৎ, পালানোর পথ খোঁজার সময় তখনই। তবে আশার কথা হলো, এখনো সেই পরিস্থিতি বা আত্মসমর্পণ আমরা দেখিনি।
ডটকম ও এআই—দুটি জোয়ারেরই একটা বড় মিল হলো বিনিয়োগের ধরন। ২০০০ সালে ভেঞ্চার ক্যাপিটাল বা নতুন ব্যবসায় বিনিয়োগের ৮০ শতাংশই গিয়েছিল ইন্টারনেট কোম্পানিগুলোতে। আর চলতি বছর মোট বিনিয়োগের ৬৪ শতাংশই গেছে এআই স্টার্টআপগুলোর পকেটে। 'সব ডিম এক ঝুড়িতে' রাখার মতো ঝুঁকিপূর্ণ বাজি এটি।
তবে আকারের দিক থেকে দুই আমলের পার্থক্য আকাশ-পাতাল। ডটকম যুগের শীর্ষ তিন কোম্পানি—সিসকো, মাইক্রোসফট ও ইনটেলের বাজারমূল্য ছিল ৫০০ বিলিয়ন ডলারের আশপাশে। এরা ইন্টারনেট স্টার্টআপগুলোকে প্রযুক্তি সহায়তা দিত। আর এখন এআই বিপ্লবের নেপথ্য নায়ক চিপ নির্মাতা এনভিডিয়ার বাজারমূল্যই সাড়ে ৪ লাখ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে।
এনভিডিয়া, আমাজন, গুগল, মেটা ও ওপেনএআইয়ের সম্মিলিত মূল্য ২০০০ সালের পুরো শেয়ারবাজারের (১৭ ট্রিলিয়ন ডলার) চেয়েও বেশি।
এই বিশাল আকার একই সঙ্গে ভয়ের এবং স্বস্তির। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভের চেয়ারম্যান জেরোম পাওয়েল অবশ্য এআই কোম্পানিগুলোর এই বিপুল সম্পদ ও ক্ষমতায় ভয়ের কিছু দেখছেন না। গত অক্টোবরে তিনি বলেছিলেন, 'এসব কোম্পানির মজবুত ব্যবসায়িক কাঠামো আছে, তারা প্রচুর মুনাফাও করছে। তাই ডটকম বাবলের সঙ্গে এর তুলনা চলে না।'
ডটকম জোয়ার ছিল অনেকটা 'নিচ থেকে ওপরে ওঠা' বিপ্লবের মতো। ১৫০ বছর আগের 'গোল্ড রাশ' বা সোনার খনি খোঁজার হুজুগের মতো মানুষ তখন ব্যাগ গুছিয়ে সান ফ্রান্সিসকোয় ছুটত ভাগ্য ফেরাতে। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালের মধ্যে ২ হাজার ২০০-এর বেশি ডটকম কোম্পানি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছিল। সংখ্যাটা তখন অনেক বড় মনে হতো।
ডটকম বুমের সঙ্গে বর্তমানের এআই জোয়ারের একটি বড় পার্থক্য হলো জনসাধারণের অংশগ্রহণ। নব্বইয়ের দশকে ইন্টারনেটের জোয়ার ছিল অনেকটা গণমানুষের বিপ্লবের মতো। কিন্তু এআই এখন পর্যন্ত অভিজাত বা বিশেষজ্ঞদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
ওপেনএআই, গুগল, মেটা ও মাইক্রোসফটের মতো কোম্পানিগুলো মেধাবী কর্মী বা 'ট্যালেন্ট' পেতে রীতিমতো কাড়াকাড়ি করছে। যাদের বিশেষ দক্ষতা নেই, এই বাজারে তাদের সুযোগ কম। যদিও '.ai' ডোমেইন নিয়ে ৯ লাখ ৭২ হাজার কোম্পানি নাম লিখিয়েছে, তবে এর মধ্যে কতগুলো আসলে কাজের, তা নিয়ে সংশয় আছে।
বড় এআই বিনিয়োগকারী বেন হরোউইটজ তার ক্যারিয়ারের শুরুতে নেটস্কেপে কাজ করতেন। নব্বইয়ের দশকে ওয়েব ব্রাউজার জনপ্রিয় করতে নেটস্কেপের ভূমিকা ছিল আজকের ওপেনএআইয়ের মতোই। কিন্তু দুই সময়ের প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন।
বেন বলেন, '১৯৯৬ সালে ব্রাউজার মার্কেটের ৯০ শতাংশ নেটস্কেপের দখলে থাকলেও ব্যবহারকারী ছিল মাত্র ৫ কোটি। ইন্টারনেট ছিল ডায়াল-আপ বা ধীরগতির। তখন ইন্টারনেট সেবা তৈরির সফটওয়্যার, হার্ডওয়্যার—সবই ছিল অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও অপরিণত।'
তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, 'ইভাইট' নামের একটি অনলাইন গ্রিটিংস কার্ড কোম্পানির জন্যই তখন ২৯০ জন প্রকৌশলী লাগত। খরচ বেশি আর ক্রেতা কম হওয়ায় ডটকম যুগের অনেক ব্যবসাই দাঁড়াতে পারেনি।
কিন্তু এআইয়ের চিত্র ভিন্ন। বেন ব্যাখ্যা করেন, ইন্টারনেট হলো একটি নেটওয়ার্ক, যত মানুষ যুক্ত হয়, এর মান তত বাড়ে। ১৯৯৬ সালে অনলাইন বিক্রেতারা খুব অল্প মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারতেন। আর এখন আমাজন সবার কাছে পৌঁছাতে পারে।
অন্যদিকে এআই হলো কম্পিউটারের মতো। এটি তাৎক্ষণিকভাবেই মূল্যবান। এআই পণ্যগুলো এত ভালো কাজ করছে যে আয়ের প্রবৃদ্ধি অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান রিফ্লেক্সিভিটির সহপ্রতিষ্ঠাতা জুসেপ্পে সেতে বলেন, ইন্টারনেটের শুরুর যুগের তুলনায় এআই প্রযুক্তি মানুষ ১৫ থেকে ৬০ গুণ দ্রুত গ্রহণ করছে। তিনি বলেন, 'আমি ঝুঁকি নিয়ে হলেও বলছি, এবারের পরিস্থিতি সত্যিই ভিন্ন।'
এআই নিয়ে অতি উৎসাহের ভিড়ে একটি শঙ্কার কথা প্রায়ই চাপা পড়ে যায়। সেটি হলো জালিয়াতি। ডটকম যুগে কোম্পানিগুলোর ওপর আয় বাড়ানো এবং নিজেদের আকাশচুম্বী দামের যৌক্তিকতা প্রমাণের প্রচণ্ড চাপ ছিল। কেউ কেউ সৎভাবে তা পেরেছিল, অনেকেই পারেনি।
যেমন হোমস্টোর ডটকম নামের ৬০০ কোটি ডলারের একটি কোম্পানি তাদের আয় ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখাতে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছিল। পরে তাদের ১১ জন নির্বাহীর বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ আনা হয়।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে শীর্ষ এআই কোম্পানিগুলোর নিজেদের মধ্যে জটিল সব লেনদেনের বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। জেপি মরগ্যানের বিশ্লেষকেরা বলছেন, ডটকম যুগের সঙ্গে এর পার্থক্য থাকলেও 'সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি'।
এআইয়ের এই জোয়ার টিকুক বা ফাটুক, সিলিকন ভ্যালি যে নিজের পথ নিজেই খুঁজে নেবে, তা নিশ্চিত। বেন হরোউইটজ বলেন, 'সব এআই পণ্যই জাদুকরী নয়, এমনকি সব কটি ঠিকঠাক কাজও করে না। টাকা ফুরিয়ে যাওয়ার আগে কোম্পানিগুলো সফল হবে কি না, তা-ও নিশ্চিত নয়। তাহলে কি কিছু কোম্পানির দাম বেশি ধরা হচ্ছে? সব সময়ই তা হয়। এভাবেই আমি ব্যবসায় টিকে থাকি।'
