পুতিনের সঙ্গে মনমালিন্যে পদ হারাচ্ছেন রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লাভরভ? গুঞ্জনের মধ্যে মুখ খুললো ক্রেমলিন
বেশ কিছুদিন ধরেই রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সেরগেই লাভরভকে জনসমক্ষে দেখা যাচ্ছে না। গত মাসে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে একটি সম্ভাব্য বৈঠক স্থগিত হওয়ার পর থেকেই রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে ঘিরে নানা গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছিল। পুতিনের সঙ্গে মনমালিন্যে পদ হারিয়েছেন লাভরভ এমন খবরও চড়াও হয়।
বুধবার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যখন পারমাণবিক পরীক্ষা পুনরায় চালুর সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করছিলেন, তখন রুশ নিরাপত্তা পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সেরগেই লাভরভের অনুপস্থিতি যেন এই গুঞ্জনে আরও ঘি ঢেলে দেয়।
তবে ক্রেমলিন গতকাল শুক্রবার এ ধরনের আশঙ্কার কথা প্রত্যাখ্যান করেছে। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, 'এইসব খবরের কোনো সত্যতা নেই। সেরগেই অবশ্যই পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।'
বুধবার রাশিয়ার প্রভাবশালী দৈনিক 'কমারসান্ত' 'অবহিত সূত্রের বরাত দিয়ে' জানায় যে, পুতিনের সঙ্গে উচ্চ পর্যায়ের ওই বৈঠকে লাভরভ 'সমঝোতার ভিত্তিতেই অনুপস্থিত' ছিলেন। পর্যবেক্ষকরাও লক্ষ্য করেন, নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যদের মধ্যে একমাত্র লাভরভই বৈঠকে ছিলেন না।
একই সাথে জানা যায়, এই মাসের শেষের দিকে জোহানেসবার্গে অনুষ্ঠিতব্য জি-২০ সম্মেলনেও রুশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন না লাভরভ। তার বদলে গত ৪ নভেম্বর পুতিন এক ডিক্রি জারি করে তুলনামূলক একজন জুনিয়র কর্মকর্তা, ম্যাক্সিম ওরেশকিনকে প্রতিনিধিদলের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেন।
এ ছাড়া দুই সপ্তাহ ধরে লাভরভের ভ্রমণ পরিকল্পনা ও বক্তৃতার সূচিও প্রকাশ করেনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
এরপরই মূলত পুতিনের সঙ্গে লাভরভের সম্পর্কের অবনতির জল্পনা ছড়িয়ে পড়ে। রুশ সরকারে রদবদল আসছে মনে করেন কেউ কেউ।
তবে শুক্রবার ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ এই জল্পনাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, 'খুব সংক্ষেপে বলব—এইসব প্রতিবেদনের কোনো সত্যতা নেই।' লাভরভ এখনও দায়িত্বে আছেন কি না—এমন প্রশ্নে তিনি যোগ করেন, 'অবশ্যই। লাভরভ এখনো পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে কাজ করছেন।'
এরও কয়েক সপ্তাহ আগে গত ২০ অক্টোবর লাভরভ মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওর সঙ্গে ফোনে কথা বলেন বুদাপেস্টে পুতিন–ট্রাম্প বৈঠক আয়োজনের বিষয়ে। ওই বৈঠকের ঘোষণা দিয়েছিলেন ট্রাম্প নিজেই। কিন্তু পরদিন ট্রাম্প জানিয়ে দেন, 'এটি সময়ের অপচয় হবে,' পরে আবার তিনি বলেন, 'ঠিক মনে হয়নি, তাই বাতিল করেছি।'
ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস এক প্রতিবেদনে সূত্রের বরাত দিয়ে লেখে, রুবিওর সঙ্গে লাভরভের কথোপকথনেই ওয়াশিংটনের আগ্রহ কমে যায়। সূত্রটি আরও বলে, 'লাভরভ এখন ক্লান্ত, তিনি মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলাপের চাইতে তার করার মতো অন্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ রয়েছে—পুতিন যাই ভাবুন না কেন।'
তবে রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা বলেন, ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসের প্রতিবেদনটি 'ইচ্ছাকৃতভাবে গুজব উসকে দিতে' প্রকাশ করা হয়েছে, যা রাশিয়ার বিরুদ্ধে তথাকথিত 'হাইব্রিড যুদ্ধের' অংশ।
তিনি আরও জানান, ইউক্রেন ইস্যুর বাইরে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্গঠন রাশিয়ার জাতীয় স্বার্থে—এমন অবস্থান পুতিনের বহুদিনের। কারণ, বিশ্বের সবচেয়ে বড় দুটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হিসেবে মস্কো ও ওয়াশিংটনের সহযোগিতাই বৈশ্বিক স্থিতিশীলতার জন্য জরুরি বলে মনে করেন পুতিন।
সেরগেই লাভরভ দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে রুশ কূটনীতির প্রধান মুখ। এর আগে তিনি জাতিসংঘে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০০৮ সালের রাশিয়া-জর্জিয়া যুদ্ধ, ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখল এবং ২০১৫ সালে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে রাশিয়ার প্রবেশের মতো পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে উত্তেজনার প্রতিটি মুহূর্তে তিনি পুতিনের প্রতি অনুগত থেকেছেন। ২০২২ সালে ইউক্রেন আক্রমণেরও তিনি একজন কট্টর সমর্থক।
৭৫ বছর বয়সী লাভরভ তার আগ্রাসী ও সংঘাতমূলক কূটনীতির জন্য পরিচিত, যা প্রায়শই পুতিনের সাম্রাজ্যবাদী আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে মিলে যায়।
তবে পুতিনের শাসনামলে আনুগত্য এবং ধারাবাহিকতাকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। যেমন, গত বছর যুদ্ধের ময়দানে ব্যর্থতার পরেও তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী সেরগেই শোইগুকে সরাসরি বরখাস্ত না করে নিরাপত্তা পরিষদের সচিবের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
মনে হচ্ছে, বড় ধরনের ধাক্কার মুখেও ক্রেমলিনের নেতার প্রতিক্রিয়া প্রায়শই হয় কেবল দায়িত্বের পুনর্বিন্যাস, সরাসরি পদচ্যুতি নয়।
