স্থবির মার্কিন শ্রমবাজার, তবু ফের নীতি সুদহার কমাল ফেডারেল রিজার্ভ
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ সুদের হার কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কারণ এখন তাদের মূল উদ্বেগ মুদ্রাস্ফীতি নয়, বরং দুর্বল হয়ে পড়া শ্রমবাজার। সাধারণত মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সুদের হার বাড়ানো হয়, কিন্তু এবার উল্টোভাবে হার কমানো হয়েছে—যা ইঙ্গিত দিচ্ছে, অর্থনীতি মন্থর হয়ে পড়ছে এবং কর্মসংস্থানের বাজারও দুর্বল হচ্ছে। খবর বিবিসির।
তবে এই সিদ্ধান্তটি এসেছে এমন সময়ে, যখন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার প্রায় এক মাস ধরে অচল (শাটডাউন) অবস্থায় রয়েছে। এর ফলে সরকারি সংস্থাগুলোর অর্থনৈতিক তথ্য সংগ্রহ ব্যাহত হয়েছে। অর্থাৎ, পর্যাপ্ত ও হালনাগাদ তথ্য ছাড়াই ফেডারেল রিজার্ভকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে—অর্থনীতিবিদদের ভাষায়, তারা যেন 'অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াচ্ছে'।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক (ফেডারেল রিজার্ভ) বুধবার জানিয়েছে, তারা তাদের মূল ঋণের সুদের হার ০.২৫ শতাংশ কমিয়ে ৩.৭৫ থেকে ৪ শতাংশের মধ্যে নির্ধারণ করেছে।
গত মাসে মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডিসেম্বরের পর প্রথমবারের মতো সুদের হার কমিয়েছিল। অর্থনীতিবিদরা ধারণা করেছিলেন, এই পদক্ষেপ আরও কয়েক দফা সুদের হার কমানোর ইঙ্গিত দেবে। তবে সরকারি তথ্যপ্রবাহে ঘাটতি থাকায় (সরকারি শাটডাউনের কারণে) ভবিষ্যতে হার কমানোর ধারাটি এখন অনিশ্চিত বা অস্পষ্ট হয়ে পড়েছে।
বুধবারের বৈঠকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিনির্ধারণী কমিটির দুই ভোটিং সদস্য ব্যাংকের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন।
তাদের মধ্যে একজন, স্টিফেন মিরান, যিনি বর্তমানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাউন্সিল অব ইকোনমিক অ্যাডভাইজার্সের প্রধান পদ থেকে ছুটিতে আছেন। তিনি ০.২৫ শতাংশের পরিবর্তে ০.৫ শতাংশ সুদের হার কমানোর পক্ষে ভোট দেন। অন্যদিকে, জেফ্রি স্মিড, যিনি কানসাস সিটির ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের সভাপতি, তিনি সুদের হার অপরিবর্তিত রাখার পক্ষে ছিলেন।
মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাম্প্রতিক এই সুদের হার কমানোয় মূল ঋণের হার নেমে এসেছে গত তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন স্তরে, যার ফলে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ঋণ গ্রহণের খরচ কিছুটা সহজ বা কম হয়েছে।
চাকরির বাজারে নিয়োগের গতি কমে যাওয়ায় গত সেপ্টেম্বরে ফেডারেল রিজার্ভ আবারও সুদের হার কমানোর সাইকেল শুরু করে।
বুধবারের নীতিবিবৃতিতে ফেড জানায়, এ বছর চাকরির প্রবৃদ্ধি মন্থর হয়েছে, এবং বেকারত্বের হার এখনো তুলনামূলকভাবে কম থাকলেও গ্রীষ্মের শেষ নাগাদ তা ধীরে ধীরে বেড়েছে।
সুদের হার কমানোর সিদ্ধান্তের পর এক সংবাদ সম্মেলনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চেয়ারম্যান জেরোম পাওয়েল বলেন, শ্রমবাজার আগের তুলনায় কম গতিশীল এবং কিছুটা দুর্বল হয়েছে। তিনি আংশিকভাবে এর জন্য অভিবাসন হ্রাসকেই দায়ী করেন।
তবুও জেরোম পাওয়েল বলেছেন, শ্রমবাজারের দুর্বলতা দ্রুততর হচ্ছে এমন লক্ষণ এখনো দেখা যায়নি—অর্থাৎ বাজার মন্থর হলেও তা ভেঙে পড়েনি।
কিন্তু চলমান সরকারি শাটডাউনের কারণে সেপ্টেম্বর মাসের সরকারি চাকরির প্রতিবেদন প্রকাশ বন্ধ রয়েছে, ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিনির্ধারকরা সর্বশেষ বৈঠকের পর থেকে শ্রমবাজারের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাচ্ছেন না।
বিকল্প উৎস, বিশেষ করে বেসরকারি খাতের তথ্য, ইঙ্গিত দিচ্ছে যে নিয়োগপ্রবণতা এখনো দুর্বল। বেতন ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান এডিপি'র তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ৩২ হাজার চাকরি হারিয়েছে।
গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের শ্রম মন্ত্রণালয় সেপ্টেম্বর মাসের মুদ্রাস্ফীতির তথ্য প্রকাশ করেছে, যেখানে দেখা গেছে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় দাম বেড়েছে ৩ শতাংশ। অর্থনীতিবিদদের পূর্বাভাসের তুলনায় এই হার কিছুটা কম, যা ফেডারেল রিজার্ভ আবারও ঋণের সুদের হার কমাতে পারে—এমন সম্ভাবনাকে আরও জোরদার করেছে।
চলতি বছরের শুরুর দিকে শুল্কনীতিজনিত মুদ্রাস্ফীতি নিয়ে উদ্বেগই ছিল মূল আলোচ্য বিষয়। কারণ প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দেশের অনেক বড় বাণিজ্য অংশীদারের ওপর ব্যাপক শুল্ক আরোপ করেছিলেন। তখন এই শুল্কজনিত মুদ্রাস্ফীতিই ছিল প্রধান আশঙ্কা, কিন্তু এখন দৃষ্টি স্থানান্তরিত হয়েছে অর্থনৈতিক মন্থরতা ও দুর্বল শ্রমবাজারের দিকে।
যদিও মুদ্রাস্ফীতি এখনো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ২ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি, তবুও সেপ্টেম্বর মাসের তথ্য অনুযায়ী তা প্রত্যাশার তুলনায় তুলনামূলকভাবে কম। ব্যাংক অব আমেরিকার অর্থনীতিবিদরা বলছেন, শুল্কের কারণে কিছু পণ্যের দাম বেড়েছে, তবে সামগ্রিকভাবে মুদ্রাস্ফীতি এতটা তীব্র নয়, যা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সুদের হার কমিয়ে শ্রমবাজারে গতি ফেরানোর সুযোগ করে দিয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চেয়ারম্যান জেরোম পাওয়েল সাংবাদিকদের বলেন, শুল্কের প্রভাব বাদ দিলে মুদ্রাস্ফীতি আসলে আমাদের ২ শতাংশ লক্ষ্য থেকে খুব দূরে নয়। তিনি আরও জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আশাবাদ হলো, শুল্কের কারণে পণ্যমূল্য কেবল একবারই বেড়ে যাবে, অর্থাৎ এটি অস্থায়ী প্রভাব ফেলবে, স্থায়ী নয়।
বুধবার ফেডারেল রিজার্ভ ঘোষণা করেছে, তারা ১ ডিসেম্বর থেকে তাদের ব্যালান্স শিট সংকোচন বন্ধ করবে। এসব ব্যালেন্স শিটে সরকারি ঋণপত্র ও মর্টগেজ-সমর্থিত সিকিউরিটিজও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
গত তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের ব্যালান্স শিট কমানোর প্রক্রিয়া চালিয়ে আসছিল। এটি মূলত সেই সম্পদ বিক্রি বা মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার মাধ্যমে সম্পন্ন হচ্ছিল, যা মহামারি ও পূর্ববর্তী আর্থিক সংকটের সময় অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে এবং সুদের হার কমাতে ক্রয় করা হয়েছিল।
এখন, আর্থিক বাজারে চাপের ইঙ্গিত দেখা দেওয়ায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই সংকোচন প্রক্রিয়া বন্ধ করতে যাচ্ছে—যা অনেক বিশ্লেষকের ধারণামতেই ঘটছে।
ডিসেম্বরে সুদের হার কমানো নিয়ে তীব্র মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে।
বছরের শেষ বৈঠকে ফেডারেল রিজার্ভ আবারও ০.২৫ শতাংশ সুদের হার কমাবে—এমনটাই ধরে নিয়েছিল ওয়াল স্ট্রিটের বিনিয়োগকারীরা। তবে বুধবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চেয়ারম্যান জেরোম পাওয়েল স্পষ্ট করে বলেন, ডিসেম্বরে হার কমানোকে "আগেভাগে নিশ্চিত" ধরে নেওয়া ঠিক হবে না—বরং তা থেকে অনেক দূরেই রয়েছে।
অক্সফোর্ড ইকোনমিক্সের যুক্তরাষ্ট্রের উপপ্রধান অর্থনীতিবিদ মাইকেল পিয়ার্স বলেন, আগামী সিদ্ধান্তগুলো ক্রমেই বিতর্কিত হয়ে উঠছে। তার মতে, ফেড এখন থেকে সুদের হার কমানোর গতি ধীর করবে।
ফেডের পরবর্তী বৈঠকের আগে অজস্র পরিবর্তন ঘটতে পারে।
জেপি মরগানের প্রধান মার্কিন অর্থনীতিবিদ মাইকেল ফেরোলি লিখেছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক তিনটি নতুন চাকরির প্রতিবেদন পেতে পারে, যা শ্রমবাজারের মূল্যায়নকে উল্লেখযোগ্যভাবে ভালো বা খারাপ দিকে পরিবর্তন করতে পারে।
একই সময়ে, যদি সরকারি শাটডাউন অব্যাহত থাকে এবং সরকারি তথ্যের প্রাপ্যতা সীমিত থাকে, তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বছরের শেষ পর্যন্ত কোন পদক্ষেপ না নিয়ে অপেক্ষা করতেও পারে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চেয়ারম্যান জেরোম পাওয়েল এই পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে বলেন, "কুয়াশার মধ্যে যদি গাড়ি চালান, আপনি গাড়ি ধীরগতিতে চালাবেন।" বজায় রাখেন।" অর্থাৎ অনিশ্চয়তার মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সাবধানেই পদক্ষেপ নেবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চেয়ারম্যান জেরোম পাওয়েল সাংবাদিকদের বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কমিটির মধ্যে কীভাবে এগোতে হবে তা নিয়ে তীব্র মতপার্থক্য রয়েছে, এবং সুদের হার নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আগামী অর্থনৈতিক তথ্যের ওপর নির্ভর করবে। পাওয়েল আরও বলেন, আমরা যতটা সম্ভব সব তথ্য সংগ্রহ করব।
এছাড়াও উল্লেখ করা হয়েছে যে পাওয়েল প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের চাপের মুখে আছেন। ট্রাম্প বারবার সুদের হার কমানোর জন্য আহ্বান জানিয়ে আসছেন। সোমবার ট্রাম্প ইঙ্গিত দিয়েছেন যে তিনি বছরের শেষে পাওয়েলের স্থলাভিষিক্ত কারও নাম ঘোষণা করতে পারেন। পাওয়েলের মেয়াদ আগামী মে মাসে শেষ হচ্ছে।
