‘সব আশা শেষ’: বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে যুক্তরাষ্ট্র ফেরত অবৈধ ভারতীয় অভিবাসী
যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরত পাঠানো একাধিক অবৈধ ভারতীয় অভিবাসী সম্প্রতি বিবিসি পাঞ্জাবি দেওয়া সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন তাদের লজ্জা, ঋণ আর ভেঙে যাওয়া স্বপ্নের গল্প। খবর বিবিসির
রোববার দেশটির রাজধানী দিল্লিতে অবতরণ করেন কমপক্ষে ৫৪ জন ভারতীয় পুরুষ, যারা যুক্তরাষ্ট্রে অনুপ্রবেশ করেছিলেন তথাকথিত "ডঙ্কি রুট" বা মানবপাচারকারীদের ব্যবহৃত বিপজ্জনক পথ দিয়ে।
২৫ থেকে ৪০ বছর বয়সী এসব পুরুষ সবাই ভারতের উত্তরাঞ্চলীয় হরিয়ানা রাজ্যের বাসিন্দা, এবং এদের সবাই নিজ নিজ বাড়িতে ফিরেছেন বলে পুলিশ জানিয়েছে। ভারত সরকার এখনো এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান পরিচালনা করছে, এরই অংশ হিসেবে অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করা ভারতীয়দেরও ফেরত পাঠানো হচ্ছে। শুধু এ বছরই ২,৪০০-র বেশি ভারতীয়কে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরত পাঠানো হয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের বহু মানুষ যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে পৌঁছাতে এই "ডঙ্কি রুট" ব্যবহার করেন — যা একাধিক সীমান্ত পাড়ি দিয়ে মূল গন্তব্যের দেশে বিপজ্জনক ভ্রমণের অংশ।
অনেকে ভালো জীবনের আশায় বা পরিবারের ভবিষ্যৎ সুরক্ষায় নিজেদের জমি বিক্রি করে ও ঋণ নিয়ে এ যাত্রায় নামেন।
রোববার ভারতে ফেরা ৫৪ জনের মধ্যে, বিবিসি পাঞ্জাবি হরিয়ানার কাইথাল জেলায় ১৫ জনের সঙ্গে কথা বলেছে, যারা এখন তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর দুশ্চিন্তাগ্রস্ত।
হরজিন্দর সিং, এক কৃষক, জানান তিনি চার বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রে যেতে ৩৫ লাখ রুপি (প্রায় ৩৯,৬০০ ডলার) খরচ করেছিলেন। সন্তানদের পড়াশোনার খরচ চালিয়ে যাবেন এই আশায় সেখানে তিনি বাবুর্চির কাজ করতেন।
তিনি বলেন, "আমার সব আশা ভেঙে গেছে। দুঃখ লাগে, কিছুই করতে পারলাম না। ফেরত পাঠানোর সময় যে অপমান সহ্য করেছি, তা ভোলার নয়।"
এদিকে হাতের সমস্ত সঞ্চয় শেষ হয়ে যাওয়ায় হরজিন্দর এখন সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত।
নরেশ কুমার নামে যুক্তরাস্ত্র-ফেরত আরেকজন বলেন, তিনি জমি বিক্রি করে ৫৭ লাখ রুপি এজেন্টদের দিয়েছিলেন, যারা তাকে যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।
তিনি ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ব্রাজিলের উদ্দেশে রওনা দেন, সেখান থেকে নানা পথে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করেন। "যাত্রাপথে আত্মীয়রা আমাকে মাঝে মাঝে টাকা পাঠাত," বলেন নরেশ।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের পরপরই অবৈধভাবে প্রবেশের অভিযোগে গ্রেপ্তার হন তিনি। "আমি ১৪ মাস জেলে ছিলাম, তারপর আমাকে ভারতে ফেরত পাঠানো হয়।"
বিবিসি পাঞ্জাবি যুক্তরাষ্ট্রের ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (আইস) সংস্থার সঙ্গে মন্তব্যের জন্য যোগাযোগ করেছে।
হরিয়ানার কারনাল জেলার রজত পাল অবৈধ অভিবাসন পথ ধরে পানামার হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যান, তিনি ওই যাত্রাকে "অত্যন্ত বিপজ্জনক" বলে উল্লেখ করেন।
রজত পাল জানান, ২০২৪ সালের মে মাসে যাত্রা শুরু করে ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছাতে সক্ষম হন।
তিনি কীভাবে ভ্রমণ করেছেন তা স্পষ্ট নয়, তবে জানা যায় এই রুটে যাত্রীদের বাস, নৌকা ও জঙ্গলের মধ্য দিয়ে বিপজ্জনক পদযাত্রা করতে হয়, এবং প্রতিটি ধাপে পাচারকারীরা অভিবাসন যাত্রীদের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে সরিয়ে নিয়ে যায়।
কাইথালের এক জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তা জানান, ফেরত আসা কোনো ব্যক্তি এখনো সেই এজেন্টদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেননি, তবে "অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে"।
ভারত সরকার জানিয়েছে, নিরাপদ ও বৈধ অভিবাসন সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে অব্যাহত প্রচেষ্টা চলছে। দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আগেও সতর্ক করেছেন যে তরুণ ভারতীয়দের বড় স্বপ্ন ও প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে পাচারকারীরা প্রতারণা করছে।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২,৪১৭ ভারতীয়কে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরত পাঠানো হয়েছে।
এর আগে, এ বছরের শুরুতে ৭৩ বছর বয়সী হারজিত কউরকে ফেরত পাঠানোর ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের শিখ সম্প্রদায় ক্ষোভ প্রকাশ করে, কারণ তিনি তিন দশক ধরে সেখানেই বসবাস করছিলেন।
এছাড়া ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বিমানে একযোগে ১০০-র বেশি ভারতীয় নাগরিককে ফেরত পাঠানো হয়। তাদের একজন বিবিসিকে জানান, পুরো ৪০ ঘণ্টার ফ্লাইটে হাতকড়া পরানো ছিল। ঐ ঘটনাও ব্যাপক সমালোচনা সৃষ্টি করে।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর পরে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভারতে "ডিপোর্টেশন ফ্লাইট বহু বছর ধরেই চলছে", এবং তাদের প্রক্রিয়ায় হ্যান্ডকাফ ব্যবহার অনুমোদিত।
পিউ রিসার্চ সেন্টারের ২০২২ সালের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে ৭ লাখ ২৫ হাজারের বেশি অবৈধ ভারতীয় অভিবাসী রয়েছে। প্রতিবেশী মেক্সিকো ও এল সালভাদরের পর ভারতীয়রাই যুক্তরাষ্ট্রে তৃতীয় বৃহৎ অবৈধ অভিবাসনকারী।
