যুক্তরাষ্ট্রের ছোট একটি অভিজাত কলেজ যেভাবে মামদানির প্রগতিশীল চিন্তাধারা প্রভাবিত করেছিল
 
জোহারান মামদানি কী বলছেন, তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ তিনি কীভাবে বলছেন।
গত জুনে হাইতির এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে উচ্ছ্বসিত জনতার উদ্দেশে নিউইয়র্কের মেয়র পদে ডেমোক্রেটিক পার্টির এই প্রার্থী বলেছিলেন, 'আমরা হাইতির পাশে দাঁড়াব, কারণ তোমরা পুরো বিশ্বকে স্বাধীনতার পাঠ শিখিয়েছো!'
তিনি 'হাইতি' শব্দটি উচ্চারণ করেছিলেন 'আহ-ই-তি'; ক্রেওল ভাষার প্রায় নিখুঁত উচ্চারণে। তার সাবেক অধ্যাপক ব্রায়ান পার্নেল সেই মুহূর্ত নিয়ে বলেন, 'যখন আমি তাকে এটি বলতে শুনলাম, হাসলাম।'
ব্রায়ানের মতে, মামদানির ওই বক্তব্য হাইতিকে দাসপ্রথা থেকে মুক্ত হয়ে গড়া প্রথম প্রজাতন্ত্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার ইঙ্গিত বহন করেছিল, যা আফ্রিকানা স্টাডিজে তারা শেখাতেন।
বর্তমানে মামদানির বোডইন কলেজের আফ্রিকানা স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারপার্সন ব্রায়ান হাসতে হাসতে বলেন, 'আমি এর কৃতিত্ব দাবি করব!'
জরিপে দেখা গেছে, নিউইয়র্কের পরবর্তী মেয়র হিসেবে জিতলে একাধিক রেকর্ড গড়বেন মামদানি। তিনি হবেন নিউইয়র্কের ইতিহাসে প্রথম মুসলিম মেয়র, প্রথম ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্ট মেয়র, এবং মাত্র ৩৪ বছর বয়সে অন্যতম কনিষ্ঠ মেয়র। একই সঙ্গে তিনি হয়ে উঠবেন নতুন প্রজন্মের প্রগতিশীলদের প্রতীক; যাদের চিন্তা গড়ে উঠেছে অভিজাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সামাজিক ও জাতিগত ন্যায়বিচারের আলোচনার মধ্যে।
২০১৪ সালে মেইনের ব্রান্সউইকে অবস্থিত বোডইন কলেজ থেকে আফ্রিকানা স্টাডিজে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন মামদানি। এই বিভাগে পড়ার অভিজ্ঞতা গড়ে তুলেছে তার রাজনৈতিক সচেতনতা ও সামাজিক দায়বদ্ধতাও।
তার অধ্যাপক ব্রায়ান পার্নেল বলেন, 'আফ্রিকানা স্টাডিজ মানে ইতিহাসকে অন্য চোখে দেখা, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অভিজ্ঞতা থেকে শেখা।'
এই বিষয়টি মূলত ১৯৬০-এর দশকে কৃষ্ণাঙ্গ আন্দোলনের সময় জন্ম নেয়, যখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ব্ল্যাক ইতিহাস ও দাসপ্রথাবিরোধী সংগ্রামকে মূল ধারায় আনার দাবি ওঠে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি নারীবাদ, উপনিবেশ-উত্তর রাজনীতি, এবং বর্ণবাদের মতো বিষয়েও বিস্তৃত হয়।
মার্কিন রক্ষণশীলদের অভিযোগ, এমন পাঠক্রম কলেজগুলোকে 'বামপন্থী রাজনীতির ঘাঁটি'তে পরিণত করছে। কেউ কেউ বলেন, আফ্রিকানা বা উইমেন স্টাডিজ-এর মতো বিষয়গুলো আমেরিকান ইতিহাসে ইতিবাচক কিছুই দেখতে চায় না।
ভাইস প্রেসিডেন্ট জে.ডি. ভ্যান্স এক বক্তৃতায় মামদানির নাম উল্লেখ করে বলেন, 'এমন তরুণ, শিক্ষিত, শহুরে ভোটাররা মূলত অভিজাত অসন্তুষ্টির ফল।'
কিন্তু মামদানির শিক্ষকেরা বলেন, বাস্তবতা তার বিপরীত। তারা জানান, মামদানি ছিলেন ভীষণ মনোযোগী এক ছাত্র; যিনি শুধু বামধারার চিন্তক নয়, রক্ষণশীল ও ক্লাসিক্যাল আমেরিকান দার্শনিকদের কাজও গভীরভাবে জানার চেষ্টা করতেন।
জোহরান মামদানি বড় হয়েছেন এমন এক পরিবারে, যেখানে রাজনীতি, ইতিহাস ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিয়ে আলোচনা ছিল নিত্যদিনের বিষয়। তার বাবা মাহমুদ মামদানি কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্বের অধ্যাপক, যিনি জাতি, উপনিবেশবাদ ও রাষ্ট্রীয় সহিংসতা নিয়ে গবেষণার জন্য বিশ্বজোড়া খ্যাতি পেয়েছেন।
ভারতীয় বুদ্ধিজীবী এই পরিবার বহু বছর উগান্ডা ও দক্ষিণ আফ্রিকায় বসবাস করেছে। ফলে ঔপনিবেশিক অভিজ্ঞতা ও বর্ণবাদের বাস্তবতা ছোটবেলা থেকেই জোহারানের পরিচিত।
 
বোডইনে পড়ার সময় জোহারান কেবল একজন মেধাবী ছাত্রই নয়, বরং একজন সক্রিয় সংগঠকও ছিলেন। তিনি 'স্টুডেন্টস ফর জাস্টিস ইন প্যালেস্টাইন' নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন এবং ইসরায়েলি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একাডেমিক বয়কটের প্রস্তাব দেন, যা তীব্র বিতর্ক সৃষ্টি করে।
তবে তার শিক্ষকরা বলেন, এসব কর্মকাণ্ড তার পড়াশোনার স্বাভাবিক পরিণতি। ইতিহাস, বর্ণবাদ ও ন্যায়বিচার বিষয়ে যে প্রশ্নগুলো তিনি ক্লাসে তুলতেন, তা তার রাজনৈতিক চিন্তায়ও প্রতিফলিত হতো।
তার লেখা বিশ্ববিদ্যালয়ের পত্রিকা বোডইন অরিয়েন্ট-এ নিয়মিত প্রকাশিত হতো। এক নিবন্ধে তিনি লেখেন, 'ক্লাসরুমে আমি অনেক সময় একমাত্র অশ্বেতাঙ্গ ছাত্র, এটা ক্লান্তিকর। আমাদের প্রয়োজন এমন শিক্ষা, যা শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যের কাঠামো ভাঙতে শেখায়।'
২০১৩ সালে রক্ষণশীল সংগঠন ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অফ স্কলার্স বোডইন কলেজের পাঠ্যক্রম নিয়ে ৩৭৬ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাদের অভিযোগ, বোডইন শিক্ষার্থীদের 'বদ্ধমনের গোঁড়ামি' শেখাচ্ছে এবং 'কুইয়ার গার্ডেনস'–এর মতো কোর্সের মাধ্যমে রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব ছড়াচ্ছে।
কলেজ প্রশাসন এই প্রতিবেদনকে 'নিম্নমানের' ও 'ব্যক্তিগত আক্রমণ' বলে অভিহিত করে। শিক্ষার্থীরা বলেন, প্রতিবেদনটি বাস্তবতার সঙ্গে কোনো সম্পর্কই রাখে না।
তবুও এই বিতর্ক মার্কিন রাজনীতি ও উচ্চশিক্ষায় চলমান মতাদর্শগত লড়াইয়ের প্রতীক হয়ে ওঠে, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল শিক্ষাকে অনেকে সন্দেহের চোখে দেখেন।
মামদানির শিক্ষক প্যাট্রিক রেল বলেন, 'জোহারান সব সময় ইতিহাসকে মানুষের চোখ দিয়ে দেখতে চাইত; কে ন্যায়বিচার পায়, কে পায় না, সেটা তার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু ছিল।'
প্যাট্রিক বলেন, 'আমেরিকার ইতিহাসের যেসব চিন্তাবিদ; হেনরি ডেভিড থোরো, ফ্রেডরিক ডগলাস, মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রম ন্যায়বিচার নিয়ে কথা বলেছেন, জোহারানের ভাবনা তাদের সঙ্গেই মিলে যায়।'
ব্রায়ান যোগ করেন, 'বোডইনে এসে কেউ যদি প্রথমেই বলে, 'আমি আফ্রিকানা স্টাডিজে মেজর করতে চাই', তা খুবই বিরল। কিন্তু জোহারান তা জানত, এবং এটাও জানত কেন সে এটা করতে চায়।'
ব্রায়ান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী আমেরিকার নগর রাজনীতি নিয়ে যে কোর্স পড়াতেন, তাতে 'ব্রোকেন উইন্ডোজ থিওরি'ও ছিল একটি বিতর্কিত ধারণা, যা শেখায় যে, ছোটখাটো অপরাধ দমন না করলে বড় অপরাধ বাড়ে। এই তত্ত্ব নিউইয়র্কের সাবেক মেয়র রুডি জুলিয়ানি অনুসরণ করেছিলেন, যদিও প্রগতিশীলদের কাছে এটি বেশ অজনপ্রিয়।
ব্রায়ান বলেন, 'উচ্চশিক্ষার পরিসরে নানা মত থাকা জরুরি। বাম হোক বা ডান, উভয় দৃষ্টিকোণ থেকেই শিখতে হবে।'
মামদানি পরে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, বোডইনের শিক্ষা তার চিন্তাভাবনায় গভীর প্রভাব ফেলেছে। তিনি বলেন, 'আমি শিখেছি, শহরের সমস্যাগুলো কেবল যেমন আছে তা নয়, সেগুলো কে তৈরি করেছে, সেটাই বোঝা দরকার।'
ছাত্র সংগঠকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, 'নিজের আবেগকে ভয় পেও না। কোনো অবস্থানকেই খুব উগ্র মনে করো না, যদি সেটি ন্যায়ের পক্ষে হয়।'
আজ যখন জোহারান মামদানি নিউইয়র্কের মেয়র প্রার্থী হিসেবে আলোচনায়, তার গল্প কেবল একজন তরুণ রাজনীতিকের নয়, এটি আমেরিকার উচ্চশিক্ষা ও প্রগতিশীল রাজনীতির এক প্রজন্মের প্রতিচ্ছবি।
ক্যাম্পাসের ক্লাসরুম থেকে শহরের রাজনীতিতে, তার যাত্রা বোঝায়, কীভাবে ধারণা, শিক্ষা আর ইতিহাসের বোধ একজন তরুণকে সমাজ পরিবর্তনের পথে চালিত করতে পারে।

 
             
 
 
 
 
