গাজায় মার্কিন সামরিক বাহিনীর জড়িত হওয়া আরেকটি ভুল পদক্ষেপ

ওয়াশিংটনে সামরিক উত্তেজনার দামামা আরও জোরে বাজছে। গাজার সংঘাত যখন অব্যাহত, তখন যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী মহল থেকে শুরু করে রাজনৈতিক মঞ্চ পর্যন্ত—সব জায়গায়ই বাড়ছে সেখানে সরাসরি মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপের দাবি।
গাজার যুদ্ধবিরতি চুক্তি পর্যবেক্ষণের নামে ইতোমধ্যেই প্রায় ২০০ মার্কিন সেনা মোতায়েন করা হয়েছে ইসরায়েলে। এই সেনারা লজিস্টিকস ও নিরাপত্তা বিষয়ে বিশেষজ্ঞ; তাদের কাজ হবে ইসরায়েলে একটি সিভিল-মিলিটারি সমন্বয় কেন্দ্র পরিচালনা করা।
কিন্তু মার্কিন নীতিনির্ধারকদের এখনই থামা উচিত এবং নিজেদেরকে এক মৌলিক প্রশ্ন করা উচিত: গাজায় মার্কিন সেনাদের জীবন ঝুঁকিতে ফেলার মতো কৌশলগত স্বার্থ আসলে কী?
সামরিক হস্তক্ষেপের পক্ষে সাধারণত দুটি যুক্তি দেওয়া হয়—মানবিক দায়বদ্ধতা ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা রক্ষা। এই যুক্তিগুলো আবেগতাড়িতভাবে শক্তিশালী হলেও বাস্তবসম্মত বিশ্লেষণের পাল্লায় টেকে না।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর বহু মানবিক সংকটে সামরিকভাবে জড়িত হয়নি। যদি মানবিকতা সত্যিই আমেরিকান পররাষ্ট্রনীতির চালিকা শক্তি হতো, তাহলে মার্কিন বাহিনী পৃথিবীর প্রায় সব প্রান্তে স্থায়ীভাবে মোতায়েন থাকত।
কিন্তু বাস্তবে তা নয়, কারণ মানবিক উদ্বেগ যত গুরুত্বপূর্ণই হোক, তা কখনোই নির্ধারণ করে না আমেরিকা কোথায় যুদ্ধ করবে।
বর্তমানে যা দেখা যাচ্ছে তা মূলত এক পুরনো রোগ—"মিশন ক্রিপ"—অর্থাৎ ছোট একটি উদ্দেশ্য থেকে শুরু হয়ে ক্রমে বড় ও জটিল সামরিক অভিযানে পরিণত হওয়া। যার শুরু হয় উপদেষ্টা ও গোয়েন্দা সহায়তা দিয়ে, এরপর আসে বিমান সহায়তা। কিছুদিনের মধ্যেই মার্কিন সেনারা "সহায়ক" ভূমিকায় মাটিতে নামে, আর সেখান থেকেই শুরু হয় সরাসরি যুদ্ধ।
এটা অনুমান নয়; এটা আমেরিকান হস্তক্ষেপবাদের চেনা ইতিহাস—ভিয়েতনাম থেকে ইরাক, আফগানিস্তান পর্যন্ত। প্রতিটি যুদ্ধই শুরু হয়েছিল সীমিত লক্ষ্য নিয়ে, কিন্তু শেষ হয়েছে অস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি, বাড়তে থাকা হতাহতের সংখ্যা ও অনির্দিষ্ট সমাপ্তির মাধ্যমে।
গাজার ক্ষেত্রেও কৌশলগত হিসাব-নিকাশে একই সমস্যা। এই সংঘাতের শিকড় এমন রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক ইস্যুতে—ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি, ইসরায়েলের নিরাপত্তা, ভূমির দাবি, ও আঞ্চলিক শক্তির প্রতিযোগিতা—যা কোনো সামরিক শক্তি দিয়ে সমাধান সম্ভব নয়।
এই সমস্যাগুলোর সমাধান কেবল কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক উপায়ে সম্ভব। সামরিক শক্তি তা কেবল আরও জটিল করে তুলবে, আলোচনার পথ রুদ্ধ করবে, ও বিদ্বেষ বাড়াবে।
তদুপরি, সরাসরি মার্কিন জড়িততা এই সংঘাতের রূপ সম্পূর্ণ পাল্টে দেবে। এটি প্রচারযুদ্ধকারীদের হাতে এক "উপহার" হয়ে যাবে—যেখানে সংঘাতকে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ইস্যু নয়, বরং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বনাম ফিলিস্তিন বা আরব বিশ্বের সংঘাত হিসেবে তুলে ধরা হবে।
এতে করে যুদ্ধের পরিধি বিস্তৃত হবে এবং পুরো অঞ্চলে জঙ্গি সংগঠনগুলোর জন্য নতুন নিয়োগ-বিষয়ক প্রচারণা তৈরি হবে। মার্কিন সেনারা কেবল স্থানীয় নয়, বরং ইরান-সমর্থিত মিলিশিয়া ও অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তিরও লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠবে, যারা গাজাকে প্রক্সি যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করবে।
এর সঙ্গে জড়িত আরেকটি বিষয় হলো সম্পদের অপচয়। মার্কিন সামরিক ও আর্থিক সম্পদ সীমিত। গাজায় খরচ করা প্রতিটি ডলার ও মোতায়েন করা প্রতিটি সেনা যুক্তরাষ্ট্রের অন্য সম্ভাব্য সংকট বা প্রতিশ্রুতি থেকে সরিয়ে এনেই দিতে হবে।
যখন চীনের সঙ্গে পরাশক্তির প্রতিযোগিতা যুক্তরাষ্ট্রের "প্রধান কৌশলগত অগ্রাধিকার" হিসেবে বিবেচিত, তখন গাজার মতো জটিল ও সীমাহীন সংঘাতে জড়ানো কি কোনোভাবে যৌক্তিক? কঠিন হলেও সত্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গাজা সংকটকে সামরিকভাবে নিয়ন্ত্রণ বা সমাধান করতে পারবে না।
বরং এতে ক্ষতি হবে—সম্পদ নষ্ট হবে, প্রাণহানি ঘটবে, মিত্রদেশগুলো ক্ষুব্ধ হবে, আর যুক্তরাষ্ট্র জড়িয়ে পড়বে এমন এক সংঘাতে, যেখানে তার কৌশলগত স্বার্থ স্থানীয় পক্ষগুলোর কাছে গৌণ।
যদি সত্যিই মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতা চাওয়া হয়, তবে একমাত্র পথ হলো কূটনীতি—যতই তা নিস্তেজ বা কম আকর্ষণীয় মনে হোক না কেন। যুদ্ধবিরতি আলোচনায় সহায়তা করা, মানবিক সহায়তা সহজতর করা এবং আঞ্চলিক শক্তিগুলোকে নিজেদের রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে নিতে সুযোগ দেওয়া—এই পথই বাস্তবসম্মত।
এটা সামরিক হস্তক্ষেপের "নিয়ন্ত্রণের মরীচিকার" মতো সন্তোষজনক না হলেও অনেক বেশি বিচক্ষণ পদক্ষেপ। ইতিহাস বলছে, ওয়াশিংটন প্রায়ই এই প্রজ্ঞার পথ এড়িয়ে যায়—কারণ শক্তি প্রদর্শনের প্রলোভন সব সময়ই তার কাছে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে।
কিন্তু প্রথম মার্কিন সেনা গাজায় পা রাখার আগে নীতিনির্ধারকদের উচিত নিজেদের প্রশ্ন করা: তারা কি স্পষ্ট কৌশলগত লক্ষ্য, বাস্তবসম্মত সময়সীমা ও নির্ধারিত প্রস্থান কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে, নাকি কেবল আরেকটি অন্তহীন যুদ্ধে অন্ধভাবে ঢুকে পড়ছে?
যদি সৎ উত্তর দ্বিতীয়টি হয়, তাহলে সংযম দেখানো—যতই কঠিন হোক না কেন—সবচেয়ে বুদ্ধিদীপ্ত পথ।
লেখক: লিওন হাদার একজন পররাষ্ট্রনীতি বিশ্লেষক ও স্যান্ডস্টর্ম: পলিসি ফেইলিওর ইন দ্য মিডল ইস্ট গ্রন্থের লেখক। এশিয়া টাইমসে প্রকাশিত তার মূল নিবন্ধ থেকে পরিমার্জিত ও সংক্ষেপিত আকারে বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের পাঠকের জন্য এটি অনূদিত করা হলো।