গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর হামলা, যুদ্ধবিরতি চুক্তি হুমকির মুখে

ইসরায়েলি সেনাবাহিনী রবিবার (১৯ অক্টোবর) গাজার দক্ষিণাঞ্চলে বিমান হামলা ও গোলাবর্ষণ চালিয়েছে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় হওয়া যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠার আশা আরও ক্ষীণ হয়ে পড়েছে। এ হামলার জন্য ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাস একে অপরকে দোষারোপ করছে।
এ হামলাকে গত ১১ অক্টোবর কার্যকর হওয়া যুদ্ধবিরতির পর সবচেয়ে গুরুতর চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর এক বিবৃতিতে জানানো হয়, রাফাহ এলাকায় তাদের সেনাদের ওপর হামলা চালানো সশস্ত্র ব্যক্তিদের লক্ষ্য করে বিমান হামলা ও আর্টিলারি ফায়ার করা হয়েছে। এতে কয়েকটি সুড়ঙ্গপথ ও সামরিক স্থাপনা ধ্বংস করা হয়েছে বলেও জানায় সেনাবাহিনী।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, হামাসের যেকোনো হামলার জবাবে ইসরায়েল কঠোর প্রতিক্রিয়া জানাবে।
অন্যদিকে, হামাসের সশস্ত্র শাখা আল-কাসাম ব্রিগেড এক বিবৃতিতে জানায়, তারা গাজার সব এলাকায় যুদ্ধবিরতির প্রতি সম্পূর্ণ অঙ্গীকারবদ্ধ। সংগঠনটি দাবি করে, রাফা এলাকার সংঘর্ষের বিষয়ে তারা অবগত নয় এবং মার্চ মাসের পর থেকে ওই এলাকার কোনো গোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের যোগাযোগও হয়নি।
সংগঠনটির বিবৃতিতে বলা হয়, 'আমরা সব চুক্তি বাস্তবায়নে পূর্ণ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, যার মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হলো পুরো গাজা উপত্যকায় যুদ্ধবিরতি।'
হামলা সম্পর্কে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, রাফা অঞ্চলে বিস্ফোরণ ও গুলির শব্দ শোনা গেছে। খান ইউনুসের কাছে দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর আবাসানে ট্যাংক থেকে গোলাবর্ষণ এবং কেন্দ্রীয় শহর জাওয়ায়েদায় বিমান হামলার ঘটনাও ঘটে। এছাড়া দেইর আল-বালাহ এলাকায় একাধিক বিস্ফোরণে অন্তত পাঁচজন নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে আল-আকসা হাসপাতালের চিকিৎসকরা।
খান ইউনুসের স্থানীয়রা জানান, রবিবার বিকেলের দিকে রাফাহ এলাকায় ধারাবাহিক বিমান হামলার শব্দ শোনা গেছে।
এদিকে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় ইসরায়েলি হামলায় অন্তত আটজনের মৃত্যু হয়েছে।
রবিবার সকালেই এক ইসরায়েলি সামরিক কর্মকর্তা জানান, হামাস গাজার ভেতরে ইসরায়েলি বাহিনীর ওপর একাধিক হামলা চালিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে রকেট চালিত গ্রেনেড হামলা ও স্নাইপার হামলা। তিনি বলেন, 'এ ঘটনা ইসরায়েলি নিয়ন্ত্রিত এলাকায় ঘটেছে। এটি যুদ্ধবিরতির স্পষ্ট লঙ্ঘন।'
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ বলেন, 'যুদ্ধবিরতি চুক্তির আওতায় যে রেখা পর্যন্ত ইসরায়েলি বাহিনী পিছু হটেছে, সেটি স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা হবে।' তিনি সতর্ক করে বলেন, 'যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন বা ওই রেখা অতিক্রমের যেকোনো প্রচেষ্টার জবাব গুলি ছুড়ে দেওয়া হবে।'
হামাসের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ইজযাত আল-রিশেক বলেন, ফিলিস্তিনি আন্দোলনরত গোষ্ঠীগুলো যুদ্ধবিরতির চুক্তি মেনে চলছে, কিন্তু ইসরায়েলই বারবার চুক্তি ভঙ্গ করছে।'
শনিবার (১৮ অক্টোবর) গাজার সরকারি গণমাধ্যম কার্যালয় জানায়, যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পর থেকে ইসরায়েল মোট ৪৭টি লঙ্ঘন করেছে, যাতে ৩৮ জন নিহত ও ১৪৩ জন আহত হয়েছেন। তাদের বিবৃতিতে আরও বলা হয়, 'এই লঙ্ঘনের মধ্যে রয়েছে বেসামরিক নাগরিকদের লক্ষ্য করে গুলি চালানো, ইচ্ছাকৃত গোলাবর্ষণ ও টার্গেট হামলা। এমনকি কয়েকজন সাধারণ নাগরিককে গ্রেপ্তারের ঘটনাও রয়েছে এর মধ্যে।'
এদিকে ইসরায়েল জানিয়েছে, গাজা ও মিশরের মধ্যবর্তী রাফা সীমান্ত পারাপার অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। গত ২০২৪ সালের মে মাস থেকেই রাফা সীমান্ত প্রায় বন্ধ রয়েছে। যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে গাজায় মানবিক সহায়তা বৃদ্ধির বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত ছিল। আইপিসি গ্লোবাল হাঙ্গার মনিটরের তথ্যমতে, আগস্ট মাস পর্যন্ত গাজার লাখ লাখ মানুষ দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে ছিলেন। আগের যুদ্ধবিরতির সময় রাফা সীমান্ত মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর প্রধান পথ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল।
এছাড়া ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে মৃত জিম্মিদের দেহ ফেরত দেওয়া নিয়েও মতবিরোধ রয়েছে। ইসরায়েল দাবি করছে, হামাসের কাছে থাকা বাকি ২৮ জন জিম্মির মৃতদেহ হস্তান্তর করতে হবে।
হামাস জানায়, তারা ইতোমধ্যে জীবিত ২০ জন ও মৃত ১২ জন জিম্মিকে ফেরত দিয়েছে। অবশিষ্ট মৃতদেহ ফেরত দেওয়ার বিষয়ে সংগঠনটির কোনো আপত্তি নেই, তবে ধ্বংসস্তূপের নিচে থাকা মরদেহ উদ্ধার করতে বিশেষ সরঞ্জাম ও সময় প্রয়োজন।
অন্যদিকে, ট্রাম্প প্রশাসনের যুদ্ধ সমাপ্তির পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এখনও নানা জটিলতা রয়ে গেছে। হামাসের নিরস্ত্রীকরণ, গাজার ভবিষ্যৎ প্রশাসন, আন্তর্জাতিক বাহিনী গঠনের রূপরেখা এবং সম্ভাব্য ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের প্রশ্নে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
গাজায় নতুন করে সংঘাত শুরু এবং যুদ্ধবিরতি নিয়ে উদ্বেগের কারণে রবিবার তেল আবিবের শেয়ারবাজারের প্রধান সূচকগুলোর প্রায় ২ শতাংশ পতন হয়েছে।