গাজায় ছেঁড়া নোট জোড়া দিয়ে জীবন চলছে যাদের
গাজা সিটির একপাশে জমজমাট এক বাজার। সেখানে টেবিল পেতে বসে মনোযোগ দিয়ে ১০০ শেকেলের (ইসরায়েলি মুদ্রা) একটি পুরোনো নোট পরীক্ষা করছেন এক তরুণ। নোটটি বেশ জীর্ণ, হলুদ রংও চটে গেছে। যত্ন করে নোটটি সোজা করলেন তিনি, এরপর পেনসিল দিয়ে আলতো করে ঘষে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করলেন হারিয়ে যাওয়া রং।
তিনি বারা আবু আল-আউন। এই বয়সে তার থাকার কথা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুমে। কিন্তু পরিস্থিতি তাকে নামিয়ে এনেছে পথের ধারে। রাস্তার পাশে টেবিল পেতে তিনি এখন টাকা 'মেরামত' করেন। সামান্য কিছু অর্থের বিনিময়ে সচল রাখেন অন্যের অচল বা ছেঁড়া নোট।
গাজায় এখন টাকার নোট মেরামত করা একটি জমজমাট ব্যবসা। গাজায় ইসরায়েলের একের পর এক বিধ্বংসী হামলার পর গাজায় নগদ অর্থের সরবরাহ বন্ধ করে দেয় ইসরায়েল।
ইসরায়েলি হামলায় গাজার অধিকাংশ ব্যাংক ধ্বংস হয়ে গেছে, অনেক ব্যাংক হয়েছে লুটপাটের শিকার। সাত সপ্তাহ আগে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর ব্যাংকের কিছু শাখা খুললেও এটিএম বুথগুলো এখনো অচল।
অথচ খাবার বা নিত্যপণ্য কিনতে মানুষের নগদ টাকা চাই। এই সুযোগে অনানুষ্ঠানিক অর্থ ব্যবসায়ীরা ডিজিটাল ট্রান্সফারের বদলে নগদ টাকা দিতে চড়া কমিশন নিচ্ছেন। ফলে ই-ওয়ালেট বা মানি ট্রান্সফার অ্যাপের ব্যবহার বাড়লেও নগদ টাকার হাহাকার কমেনি।
এমন পরিস্থিতিতে প্রতিটি টাকার নোটই গাজাবাসীর কাছে অমূল্য, তা যতই ছেঁড়া-ফাটা হোক না কেন। আর এখানেই বারা আল-আউনের মতো তরুণদের কদর।
বারা বলেন, 'আমার কাজের সরঞ্জামগুলো খুবই সাধারণ; একটি স্কেল, পেনসিল, রং পেনসিল আর আঠা। যুদ্ধবিরতির পরও আর্থিক পরিস্থিতির খুব একটা বদলায়নি। আমি এখন মূলত মানুষের সেবা করছি। তাদের হাতে থাকা টাকা সচল রাখতে সাহায্য করছি।'
জাতিসংঘের নতুন এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুই বছরের টানা যুদ্ধে গাজার অর্থনীতি এতটাই ভেঙে পড়েছে যে সেখানকার ২০ লাখ মানুষই এখন দারিদ্র্যসীমার নিচে।
জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক সম্মেলনের তথ্যমতে, গাজায় এখন প্রতি পাঁচজনের চারজনই বেকার। যাদের হাতে কিছু সঞ্চয় বা আয়ের উৎস আছে, নগদ টাকার অভাবে তারাও দিশাহারা।
উত্তর গাজার জাবালিয়া থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে গাজা সিটিতে আশ্রয় নেওয়া নুমান রায়হান বলেন, 'চারদিকে শুধু ভোগান্তি আর হাহাকার। আয় নেই, হাতে টাকা নেই, ব্যাংক থেকেও টাকা তোলার উপায় নেই।'
যুদ্ধের শুরুর দিকে হামাসের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তুলে ব্যাংকগুলোতে হামলা চালিয়েছিল ইসরায়েল। এরপর সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো ব্যাংকের ভল্ট লুট করে। ফিলিস্তিন মনিটারি অথরিটির (পিএমএ) তথ্যমতে, ব্যাংকগুলো থেকে প্রায় ১৮ কোটি ডলার চুরি হয়েছে।
গাজার সীমান্ত নিয়ন্ত্রণকারী ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা সংস্থা 'কোগাট' জানায়, রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণেই গাজায় নগদ অর্থ ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। তাদের দাবি, হামাস সামরিক কার্যক্রম চালাতে নগদ অর্থের ওপর নির্ভর করে বলেই এই কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
গাজা সিটির বাজারের দোকানি জাকারিয়া আজুর জানান, নগদ টাকার অভাবে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ই বিপদে পড়েছেন। টাকার নোট একটু জীর্ণ বা টেপ লাগানো থাকলে কেউ তা নিতে চায় না। আর নিলেও সেটির পূর্ণ মান ধরতে চায় না।
জাকারিয়া বলেন, 'অনেকে শুধু গাড়ি ভাড়ার খুচরা টাকার জন্য আমার কাছে আসেন, কিন্তু আমি দিতে পারি না।' তিনি আরও জানান, ১০ শেকেলের কয়েন বা মুদ্রা এখন পাওয়াই যায় না। আর পাওয়া গেলেও টাকার সংকটে দ্রব্যমূল্য বা মুদ্রাস্ফীতি এতটাই বেড়েছে যে এই কয়েনের কার্যত কোনো মূল্য নেই।
গাজা সিটিতে এখন ব্যাংক অব প্যালেস্টাইনের সামনে দীর্ঘ সারি। পাঁচটি ব্যাংকের মোট ৯টি শাখা নতুন করে খুললেও সেখানে টাকা তোলার সুযোগ নেই। গ্রাহকেরা কেবল তাদের ফ্রোজেন অ্যাকাউন্ট সচল করতে, নতুন অ্যাকাউন্ট খুলতে বা ব্যাংকিং অ্যাপ চালু করতে পারছেন।
আসমা আল-লাদা নামের এক নারী ব্যাংকে এসেছেন নতুন অ্যাকাউন্ট খুলতে, যাতে বিদেশে থাকা স্বজনদের পাঠানো টাকা তিনি সরাসরি পেতে পারেন। আসমা বলেন, 'এখানে শুধুই ভিড় আর বিশৃঙ্খলা। বাচ্চাদের তাঁবুতে রেখে ভোর ছয়টায় উঠে সব কাজ ফেলে ব্যাংকে এসেছি।'
গাজার দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর খান ইউনিসের ব্যাংকগুলো এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যে তা আর খোলার উপায় নেই। বাধ্য হয়ে ব্যাংকের কাজে সেখান থেকে গাজার মাঝপ্রান্তে গিয়েছিলেন আবু খলিল। কিন্তু সারা দিন লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও ব্যাংকের ভেতরে ঢুকতে পারেননি তিনি। আবার সেখানে যাওয়ার কথা ভাবতেই হতাশায় ভেঙে পড়ছেন এই বৃদ্ধ।
ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে মাসে দুই হাজার শেকেল বেতন পান তিনি। কিন্তু তার আক্ষেপ, বেতনের প্রায় অর্ধেকই চলে যায় ব্যবসায়ী বা মুদ্রা বিনিময়ের কারবারিদের কমিশন দিতে। তিনি বলেন, 'বাড়তি এই টাকা দেওয়া ছাড়া তো আর কোনো উপায় নেই।'
যুদ্ধের সময় নগদ টাকার তীব্র সংকট তৈরি হওয়ায় ছোট ব্যবসায়ীরা মানি ট্রান্সফার বা অর্থ বিনিময়ের ব্যবসায় নেমেছেন। ডিজিটাল লেনদেন থেকে হাতে নগদ টাকা পেতে গ্রাহকদের কাছ থেকে তাঁরা চড়া কমিশন নিচ্ছেন। কোনো কোনো সময় এই কমিশনের হার ৫০ শতাংশেও পৌঁছেছিল, যদিও সম্প্রতি তা কিছুটা কমেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক মুদ্রা ব্যবসায়ী জানান, বাজারের পরিস্থিতির ওপরই নির্ভর করে এই কমিশনের হার। তিনি বলেন, 'পণ্য ও ত্রাণ প্রবেশের সঙ্গে আমাদের কাজের সরাসরি যোগ আছে। যখন পণ্য আসে এবং কেনাবেচা বাড়ে, তখন কমিশন অনেকটাই কমে আসে, এমনকি ২০ শতাংশেও নামে। কিন্তু সীমান্ত বন্ধ থাকলেই কমিশনের হার আবার বেড়ে যায়।'
ছোটখাটো কেনাকাটার জন্য গাজাবাসীর এখন অন্যতম ভরসা ব্যাংকিং অ্যাপ বা মোবাইল ব্যাংকিং। দোকানদাররা সামান্য ফি নিয়ে অ্যাপের মাধ্যমে পেমেন্ট নিচ্ছেন। ফিলিস্তিন মনিটারি অথরিটি (পিএমএ) স্থানীয় ব্যাংকগুলোর মধ্যে তাৎক্ষণিক লেনদেনের ব্যবস্থা চালু করেছে।
যাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই, তাদের জন্য 'ই-ওয়ালেট' সুবিধা এনেছে ব্যাংক অব প্যালেস্টাইন। গাজায় এখন এই সেবা ব্যবহার করছেন ৫ লাখেরও বেশি মানুষ। ইন্টারনেট বা অ্যাপ ছাড়াও সাধারণ মোবাইল ফোনে এসএমএসের মাধ্যমেই এই লেনদেন করা সম্ভব।
ইউনিসেফ ও বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) মতো মানবিক সংস্থাগুলো এই ই-ওয়ালেটের মাধ্যমেই অভাবী পরিবারগুলোর কাছে সহায়তা পাঠাচ্ছে। ইউনিসেফ জানিয়েছে, তারা প্রায় ১০ লাখ মানুষের কাছে এভাবে নগদ অর্থ পৌঁছে দিয়েছে, যার অর্ধেকই শিশু। বিশেষ করে অঙ্গহানি হওয়া শিশু, এতিম এবং অন্তঃসত্ত্বা বা দুগ্ধদানকারী মায়েদের অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।
ইউনিসেফের জোনাথন ক্রিক্স বলেন, 'মুদিদোকানে ফোনটিই এখন পেমেন্ট কার্ড হিসেবে কাজ করছে।' তিনি জানান, মানুষ এই টাকার ৯৯ শতাংশই খরচ করছে খাবার ও পানির জন্য। এরপর সাবান বা জেনারেটরের বিদ্যুতের জন্য খরচ করা হচ্ছে।
বাজারের ভয়াবহ পরিস্থিতির কথা তুলে ধরে জোনাথন বলেন, তিনি নিজের চোখে দেখেছেন, ২ কেজি টমেটো বিক্রি হচ্ছে ৮০ ডলারে এবং ৫ কেজি পেঁয়াজ ৭০ ডলারে।
গাজা সিটি থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে গাজার মাঝপ্রান্তে আশ্রয় নেওয়া হানান আবু জাহেল সম্প্রতি ইউনিসেফ থেকে ১ হাজার ২০০ শেকেল (৩৬৭ ডলার) সহায়তা পেয়েছেন। এই টাকায় চাল, ডাল ও পাস্তার মতো শুকনা খাবার কিনেছেন।
হানান বলেন, 'বাচ্চাদের জন্য ফল, মাংস বা ডিম খুব দরকার। ছোট ছেলেটা ডিম খেতে চায়। কিন্তু দাম এত বেশি যে ১২ জনের মুখের খাবার জোগাড় করতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে।'
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার ২০ দফার শান্তি পরিকল্পনায় গাজাকে অর্থনৈতিকভাবে পুনর্গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সেখানে মধ্যপ্রাচ্যের আধুনিক ও সমৃদ্ধ শহরগুলোর আদলে গাজাকে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখানো হয়েছে।
তবে ট্রাম্পের পরিকল্পনায় কর্মসংস্থান বা উন্নয়নের কথা বলা হলেও কীভাবে তা বাস্তবায়ন করা হবে, তার কোনো স্পষ্ট রূপরেখা নেই। অথচ জাতিসংঘের বাণিজ্য সংস্থা সতর্ক করে বলছে, গাজা এখন ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
গাজা সিটির সেই রাস্তায় ফিরে আসা যাক। বারা আবু আল-আউন মেরামত করা নোটটি আলোর বিপরীতে তুলে ধরে পরখ করছেন। নিপুণ হাতে কাজ করেন তিনি। তার দোকানের সাইনবোর্ডে লেখা—'এখানে কোনো রকম টেপ ছাড়াই অত্যন্ত পেশাদারত্বের সঙ্গে টাকা মেরামত করা হয়।' এই সাইনবোর্ড দেখে তার সামনে ভিড় করছেন অনেক গ্রাহক।
কাজের ফাঁকে তিনি স্বপ্ন দেখেন স্বাভাবিক জীবনে ফেরার। যেখানে পড়ালেখা শেষে ভালো কোনো চাকরি করবেন, থাকবে নিশ্চিত ভবিষ্যৎ।
আবু আল-আউন বলেন, 'আমি শুধু চাই এই যুদ্ধ পুরোপুরি শেষ হোক। অবশেষে একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে চাই, যাতে পড়াশোনা শেষ করে ডিগ্রি নিয়ে কাজ করতে পারি।'
দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বলেন, 'গাজায় আমরা কোনো রকমে শুধু টিকে আছি। আমরা যেন আর মানুষ নই।'
