পত্রিকায় ছাপা ভুল মৃত্যুসংবাদে যেভাবে বদলে গেল উইল, জন্ম হলো নোবেল পুরস্কারের

১৮৮৮ সালের এপ্রিল মাস। সকালে খবরের কাগজ খুলতেই আলফ্রেড নোবেল দেখলেন এক অদ্ভুত খবর—তার নিজেরই মৃত্যু সংবাদ! ভুলবশত ছাপা হওয়া সেই শোকসংবাদটি তাকে এতটাই নাড়া দিয়েছিল যে, তিনি তার রেখে যাওয়া কীর্তি এবং আবিষ্কারের প্রভাব নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে বসেন। আর সেই একটি মুহূর্তই জন্ম দিয়েছিল বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানজনক পুরস্কার—নোবেল পুরস্কারের।
কে ছিলেন আলফ্রেড নোবেল?
১৮৩৩ সালে স্টকহোমের একটি ছোট শহরে জন্মগ্রহণ করেন আলফ্রেড নোবেল। তিনি এক সুশিক্ষিত কিন্তু দরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান ছিলেন। নোবেলের জন্মের বছরেই তার বাবা দেউলিয়া হয়ে যান এবং পরে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে একটি বিস্ফোরক কারখানা স্থাপন করেন। জীবনের বেশিরভাগ সময় নোবেল বাড়িতেই ব্যক্তিগত শিক্ষকের কাছে পড়াশোনা করেন। তিনি ফরাসি, জার্মান, রাশিয়ান এবং ইংরেজির মতো ভাষাগুলো খুব দ্রুত শিখে ফেলেন। তিনি যেমন কবিতা ভালোবাসতেন, তেমনই বিজ্ঞানের প্রতিও তার ছিল তীব্র অনুরাগ।
বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে, তিনি নিজেও একজন উদ্ভাবক হয়ে ওঠেন। ১৮৬৬ সালে আসে তার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ আবিষ্কার: ডিনামাইট। সেই সময়ে বিশ্বজুড়ে চলছিল বড় বড় নির্মাণযজ্ঞ—খনি, বন্দর, রাস্তা, সেতু, বাঁধ, রেলপথ, সুয়েজ খালের মতো বিশাল সব প্রকল্প। মাটি সরানো, পাহাড়ের মধ্য দিয়ে সুড়ঙ্গ করা বা বিশাল পাথর গুঁড়ো করার জন্য ডিনামাইটের শক্তি ছিল অপরিহার্য।
নোবেল খুব দ্রুত ইউরোপ এবং আমেরিকায় তার ডিনামাইটের পেটেন্ট করান এবং এর মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক হন। তিনি বিয়ে করেননি এবং জীবনের বেশিরভাগ সময় প্যারিসেই কাটিয়েছিলেন।
'যুদ্ধবাজ মুনাফাখোর' থেকে পুরস্কারের জন্ম
নোবেল হয়তো ভাবতেন, একজন রসায়নবিদ, উদ্ভাবক এবং ব্যবসায়ী হিসেবে বিশ্বে তার অবদান যথেষ্ট। কিন্তু একটি ভুল শোকসংবাদ শীঘ্রই তার সেই ধারণা ভেঙে চুরমার করে দেয়।

১৮৮৮ সালের এপ্রিলে, প্রতিদিনের মতো সকালের সংবাদপত্র 'লা ফিগারো' পড়ার সময়, নোবেল দেখলেন তার নিজেরই মৃত্যু সংবাদ! আসলে মারা গিয়েছিলেন তার ভাই লুডভিগ, কিন্তু সংবাদপত্র ভুল করে আলফ্রেড নোবেলের নাম ছেপে দেয়।
আর সেই শোকসংবাদে যা লেখা ছিল, তা ছিল অত্যন্ত অপমানজনক: 'একজন ব্যক্তি, যাকে মানবজাতির জন্য উপকারী হিসেবে দেখাটা খুবই কঠিন... গতকাল কানে মারা গেছেন। তিনি ছিলেন মিস্টার নোবেল, ডিনামাইটের উদ্ভাবক।'
তাকে নির্মমভাবে একজন 'যুদ্ধবাজ মুনাফাখোর' হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছিল, যিনি মানুষ হত্যা ও পঙ্গু করার নতুন নতুন উপায় আবিষ্কার করে ধনী হয়েছেন।
বদলে গেল উইল
এই 'মরণোত্তর' খ্যাতি নোবেলকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। তিনি চাননি, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাকে এভাবে মনে রাখুক। তাই ১৮৯৬ সালের ডিসেম্বরে, ৬৩ বছর বয়সে মৃত্যুর এক বছর আগে, তিনি তার উইলটি পুরোপুরি বদলে ফেলেন।
নতুন উইলে তিনি তার বিশাল সম্পদের মাত্র ৩ শতাংশ আত্মীয়-স্বজনদের জন্য রাখেন। বাকি ৯৭ শতাংশ সম্পদই তিনি উৎসর্গ করেন একটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার তহবিল গঠনের জন্য। এই পুরস্কার দেওয়া হবে পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, চিকিৎসাবিজ্ঞান, সাহিত্য এবং শান্তিতে অসাধারণ কৃতিত্বের জন্য।
প্রথম নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয় ১৯০১ সালে। এরপর ১৯৬৮ সালে, সুইডেনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থনীতি বিজ্ঞানে একটি নতুন পুরস্কার প্রতিষ্ঠা করে। প্রতি বছর ১০ ডিসেম্বর নতুন নোবেল পুরস্কার বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হয়।
অনেকেই প্রশ্ন করেন, নোবেল কেন তার জীবদ্দশায় এই পুরস্কারগুলো প্রতিষ্ঠা করেননি। এর উত্তর হয়তো তার অন্তর্মুখী চরিত্রের মধ্যেই লুকিয়ে আছে। যে মানুষটিকে কেউ চিনত না, তিনি হয়তো চেয়েছিলেন এমন একজন পরোপকারী হতে, যাকে কেউ চিনবে না। মরণোত্তর উদারতার ব্যবস্থা করে, তিনি তার গোপন ব্যক্তিগত জীবনকে জনসাধারণের চোখের আড়ালে রেখেই বিদায় নিয়েছিলেন।
অনুবাদ: নাফিসা ইসলাম মেঘা