কোটি মানুষকে অনাহার থেকে বাঁচিয়ে, সাম্রাজ্য গড়তে সাহায্য করে আলু যেভাবে বিশ্বকে বদলে দিয়েছে
যখন আলু গাছে ফুল ফোটে, তখন বেগুনি তারার মতো দেখতে পাঁচটি পাপড়ির সেই ফুলগুলো পুরো ক্ষেতকে ভরিয়ে তোলে। শোনা যায়, ফ্রান্সের রানি মারি অ্যান্তইনেত এই ফুল এতোটাই পছন্দ করতেন যে তিনি চুলে লাগিয়ে ঘুরতেন। তার স্বামী রাজা ষোড়শ লুই নিজের কোটের বোতামের ঘরে একটি আলুর ফুল গুঁজে রাখতেন। তাদের দেখাদেখি ফরাসি অভিজাতদের মধ্যে জামাকাপড়ে আলুর ফুল লাগানোর এক নতুন ফ্যাশন শুরু হয়ে যায়।
এই সবকিছুই ছিল ফরাসি চাষিদের আলু চাষে এবং সাধারণ মানুষকে এই অদ্ভুত নতুন সবজিটি খাওয়ানোর জন্য একটি প্রচেষ্টা। আজ গম, ভুট্টা, চাল এবং আখের পর আলু বিশ্বের পঞ্চম গুরুত্বপূর্ণ ফসল। কিন্তু অষ্টাদশ শতকে এই কন্দটি ছিল এক নতুন এবং আশ্চর্যজনক জিনিস। কেউ একে ভয় পেত, আবার কেউ অবাক হতো। ক্রিস্টোফার কলম্বাসের হাত ধরে পৃথিবীতে যে বিশাল পরিবেশগত পরিবর্তন শুরু হয়েছিল, আলু ছিল তারই একটি অংশ।
আজ থেকে প্রায় ২৫ কোটি বছর আগে, পৃথিবীর সমস্ত স্থলভাগ একসঙ্গেই ছিল, যার নাম ছিল প্যানজিয়া। ধীরে ধীরে ভৌগোলিক শক্তি এই প্যানজিয়াকে ভেঙে ফেলে এবং আজকের পরিচিত মহাদেশগুলো তৈরি হয়। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন কোণে সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন গাছপালা ও প্রাণীর জন্ম হয়। ইতিহাসবিদ আলফ্রেড ডব্লিউ ক্রসবির ভাষায়, কলম্বাসের সমুদ্রযাত্রা যেন প্যানজিয়ার সেই বিচ্ছিন্ন অংশগুলোকে আবার এক সুতোয় গেঁথে দিল।
ক্রসবি এই প্রক্রিয়াকে 'কলম্বিয়ান এক্সচেঞ্জ' নাম দিয়েছেন। এর ফলে, বিশ্বের দীর্ঘদিনের বিচ্ছিন্ন পরিবেশগুলো হঠাৎ করেই একে অপরের সাথে মিশে যায় এবং জীবজগতের এক বিশাল ওলটপালট শুরু হয়, যা আমাদের আজকের ইতিহাসের ভিত্তি তৈরি করেছে। রাজা ষোড়শ লুইয়ের কোটের বোতামের সেই আলুর ফুলটি, যা পেরু থেকে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে এসেছিল, ছিল এই কলম্বিয়ান এক্সচেঞ্জেরই একটি প্রতীক এবং অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
শস্যদানার তুলনায় কন্দ বা মাটির নিচের সবজি হিসেবে আলু অনেক বেশি উৎপাদনশীল। যদি গমের শীষ খুব বেশি বড় হয়ে যায়, তবে গাছটি নুয়ে পড়ে এবং নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু আলু যেহেতু মাটির নিচে বাড়ে, তাই এর আকার গাছের ওপর নির্ভর করে না। ২০০৮ সালে লেবাননের এক কৃষক প্রায় ২৫ পাউন্ড (প্রায় ১১ কেজি) ওজনের একটি আলু তুলেছিলেন, যা তার মাথার চেয়েও বড় ছিল!
অনেক গবেষক বিশ্বাস করেন যে, উত্তর ইউরোপে আলুর আগমনের ফলেই সেখানকার দুর্ভিক্ষ শেষ হয়ে গিয়েছিল। ইতিহাসবিদ উইলিয়াম এইচ. ম্যাকনিলের মতে, আলু সাম্রাজ্য তৈরিতেও সাহায্য করেছিল। আলু দ্রুত বাড়তে থাকা জনসংখ্যাকে খাবার জুগিয়েছিল, আর এই বাড়তি জনসংখ্যার জোরেই কয়েকটি ইউরোপীয় দেশ ১৭৫০ থেকে ১৯৫০ সালের মধ্যে সারা বিশ্বে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। এককথায়, আলু পশ্চিমা বিশ্বের উত্থানের পেছনে শক্তি জুগিয়েছিল।
ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় আলুর ব্যবহার আধুনিক কৃষিব্যবস্থার ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছিল। কলম্বিয়ান এক্সচেঞ্জ শুধু আলুকে আটলান্টিক পার করেই আনেনি, এটি বিশ্বের প্রথম কৃত্রিম সারও নিয়ে এসেছিল: পেরুর গুয়ানো বা পাখির বিষ্ঠা। আবার, যখন অন্য একটি আমদানি করা পোকা, কলোরাডো পটেটো বিটল, আলুর ফসল নষ্ট করতে শুরু করে, তখন আতঙ্কিত কৃষকরা প্রথম কৃত্রিম কীটনাশক ব্যবহার করতে শুরু করে, যা ছিল আর্সেনিকের একটি রূপ। এর ফলেই আধুনিক কীটনাশক শিল্পের জন্ম হয়।
আলুর আসল জন্মভূমি
আলুর জন্মস্থান হিসেবে আন্দিজ পর্বতমালা এক অবিশ্বাস্য জায়গা। এটি পৃথিবীর দীর্ঘতম পর্বতশ্রেণী। এখানকার আবহাওয়াও খুব অদ্ভুত। পাতলা বাতাসের কারণে উঁচু এলাকায় তাপমাত্রা কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ৭৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট থেকে হিমাঙ্কের নিচে নেমে যেতে পারে।
এই প্রতিকূল পরিবেশেই বিশ্বের অন্যতম সেরা একটি সংস্কৃতির জন্ম হয়েছিল। হাজার হাজার বছর ধরে, এখানকার বিভিন্ন জাতি ক্ষমতার জন্য লড়াই করেছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো ইনকা সভ্যতা, যারা বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল। এই সমস্ত পাহাড়ি সংস্কৃতির মূল খাদ্য ছিল কন্দ জাতীয় ফসল, যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল আলু।
বুনো আলুতে সোলানিন এবং টমাটিনের মতো বিষাক্ত পদার্থ থাকে। রান্না করলেও এই বিষ নষ্ট হয় না। আন্দিজের মানুষেরা এই বিষ থেকে বাঁচতে এক অদ্ভুত উপায় বের করেছিল। তারা দেখত যে, গ্লাইমাকো এবং ভিকুনার (লামার বুনো প্রজাতি) মতো প্রাণীরা বিষাক্ত গাছপালা খাওয়ার আগে কাদামাটি চেটে খায়। বিষাক্ত পদার্থগুলো কাদামাটির কণার সাথে আটকে গিয়ে হজম না হয়েই শরীর থেকে বেরিয়ে যায়। এই বুদ্ধি অনুকরণ করে পাহাড়ি মানুষেরা বুনো আলু একরকম কাদামাটির সস বা 'গ্রেভি'তে ডুবিয়ে খেতে শেখে। ধীরে ধীরে তারা কম বিষাক্ত আলুর জাত উদ্ভাবন করে। আজও পেরু এবং বলিভিয়ার বাজারে খাওয়ার জন্য কাদামাটির গুঁড়ো বিক্রি হয়।
আন্দিজের মানুষ শুধু সেদ্ধ বা বেকড আলুই খেত না। তারা আলু সেদ্ধ করে, খোসা ছাড়িয়ে, শুকিয়ে 'পাপাস সেকাস' তৈরি করত। আবার পচা পানিতে আলু গেঁজিয়ে 'তোকোশ' নামের এক ধরনের চটচটে ও দুর্গন্ধযুক্ত খাবারও বানাত। তবে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল 'চুনো'। এটি তৈরির জন্য রাতের কনকনে ঠান্ডায় আলু বাইরে বিছিয়ে রাখা হতো এবং সকালের রোদে গলতে দেওয়া হতো। বারবার ঠান্ডা ও গরমের এই প্রক্রিয়ায় আলু নরম এবং রসালো হয়ে যেত। এরপর চাপ দিয়ে পানি বের করে নিলে তৈরি হতো শক্ত, ফোমের মতো ছোট ছোট দানা, যা আসলে চুনো। চুনোকে ফ্রিজ ছাড়াই বছরের পর বছর সংরক্ষণ করা যেত। ইনকা সৈন্যদের প্রধান খাবারই ছিল এই চুনো।
ইউরোপে আলুর আগমন
১৫৩২ সালে স্প্যানিশ অভিযাত্রী ফ্রান্সিসকো পিজারোর দল প্রথম আন্দিজে আলু খেতে দেখে। ধীরে ধীরে এই নতুন খাবারের খবর ছড়িয়ে পড়ে এবং কয়েক দশকের মধ্যেই স্প্যানিশ কৃষকরা ইউরোপে আলু রপ্তানি শুরু করে।
কিন্তু ইউরোপের মানুষ এই অদ্ভুত খাবারটিকে সন্দেহের চোখে দেখত। কেউ ভাবত এটি কামোদ্দীপক, আবার কেউ ভাবত এর থেকে জ্বর বা কুষ্ঠরোগ হয়। ফরাসি দার্শনিক দনি দিদরো তার বিশ্বকোষে লিখেছিলেন, 'এটি কোনো মজাদার খাবার নয়, তবে যারা শুধু পেট ভরাতে চায়, তাদের জন্য এটি যথেষ্ট স্বাস্থ্যকর।'
ফ্রান্সে আলুর জনপ্রিয়তা বাড়াতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন আন্টোইন-অগাস্টিন পারমেন্তিয়ের। তিনি ছিলেন একজন ফার্মাসিস্ট এবং সাত বছরের যুদ্ধে প্রুশিয়ানদের হাতে পাঁচবার ধরা পড়েছিলেন। জেলে থাকাকালীন তিনি আলু ছাড়া প্রায় কিছুই খেতে পাননি, কিন্তু অবাক হয়ে দেখলেন যে তিনি বেশ সুস্থ আছেন। যুদ্ধের পর তিনি আলুর প্রচারে নিজের জীবন উৎসর্গ করেন।
পারমেন্তিয়ের একের পর এক প্রচার কৌশল ব্যবহার করতে থাকেন। তিনি সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের জন্য আলুর তৈরি এক ভোজসভার আয়োজন করেন, রাজা ও রানিকে আলুর ফুল পরতে রাজি করান এবং প্যারিসের বাইরে ৪০ একর জমিতে আলু চাষ করেন। তিনি জানতেন যে, ক্ষুধার্ত সাধারণ মানুষ সেগুলো চুরি করবে এবং এভাবেই আলুর স্বাদ সবার কাছে পৌঁছে যাবে।
একঘেয়ে চাষ এবং দুর্ভিক্ষের বিপদ
পারমেন্তিয়ের অজান্তেই একটি বড় পরিবর্তন এনেছিলেন। ইউরোপের সমস্ত আলু স্পেন থেকে আনা কয়েকটি মাত্র কন্দ থেকে জন্মেছিল। যখন বীজের বদলে কন্দের টুকরো থেকে চাষ করা হয়, তখন যে গাছগুলো জন্মায়, সেগুলো আসলে একে অপরের হুবহু নকল বা ক্লোন হয়। পারমেন্তিয়েরের প্রচারের ফলে বিশাল এলাকাজুড়ে একই জাতের আলু চাষের ধারণা জনপ্রিয় হয়, যা 'মনোকালচার' বা এক ফসলের চাষ নামে পরিচিত।
এর ফল ছিল আশ্চর্যজনক। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে ইউরোপে দুর্ভিক্ষ ছিল এক সাধারণ ঘটনা। কিন্তু আলুর কারণে ইউরোপের খাদ্য সরবরাহ প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। আয়ারল্যান্ড থেকে রাশিয়া পর্যন্ত দুর্ভিক্ষ প্রায় অদৃশ্য হয়ে গেল।
নতুন সারের জন্ম
তবে এই একঘেয়ে চাষের একটি ভয়ঙ্কর বিপদ ছিল। ১৮৪৫ সালে 'ফাইটোফথোরা ইনফেস্টানস' (যার মানে 'যন্ত্রণাদায়ক উদ্ভিদ ধ্বংসকারী') নামে একটি ছত্রাক পেরু থেকে সম্ভবত সারের জাহাজে করে ইউরোপে এসে পৌঁছায়। যেহেতু আয়ারল্যান্ডের প্রায় সমস্ত আলু ছিল একই জাতের ক্লোন, তাই এই ছত্রাকটি দ্রুত পুরো ফসলকে ধ্বংস করে দেয়।
ফসল নষ্ট হওয়ার পরের বছরগুলো ছিল আরও ভয়াবহ। এই দুর্ভিক্ষ ১৮৫২ সাল পর্যন্ত চলেছিল। এতে দশ লাখেরও বেশি আইরিশ মানুষ মারা যায়, যা ছিল জনসংখ্যার হিসাবে ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। আরও প্রায় কুড়ি লাখ মানুষ দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়।
আরেকটি আমদানিকৃত প্রজাতি ছিল কলোরাডো পটেটো বিটল। এই পোকাটি মেক্সিকো থেকে এসে আমেরিকার আলু ক্ষেতে আক্রমণ শুরু করে। কৃষকরা যখন একই জাতের আলু বিশাল জমিতে চাষ করে, তখন পোকামাকড়ের জন্য তা এক বিশাল ভোজের ক্ষেত্রে পরিণত হয়।
হতাশ কৃষকরা পোকা তাড়াতে সবকিছু চেষ্টা করতে থাকে। শেষে একজন কৃষক তার গাছে বেঁচে যাওয়া সবুজ রঙ ছুঁড়ে মারেন এবং অবাক হয়ে দেখেন যে পোকাগুলো মরে গেছে! সেই রঙে ছিল 'প্যারিস গ্রিন', যা আর্সেনিক এবং তামা দিয়ে তৈরি। এটিই ছিল আধুনিক কীটনাশকের শুরু।
কিন্তু পোকারাও ধীরে ধীরে বিষ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা অর্জন করে ফেলে। কৃষকরা আরও শক্তিশালী কীটনাশক ব্যবহার করতে শুরু করে, এবং পোকারাও আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এই চক্রটিকে 'টক্সিক ট্রেডমিল' বলা হয়, যা আজও চলছে।
আলু বিশ্বকে বদলে দিয়েছে। এটি কোটি কোটি মানুষকে অনাহার থেকে বাঁচিয়েছে, সাম্রাজ্য গড়তে সাহায্য করেছে এবং আধুনিক কৃষির জন্ম দিয়েছে। কিন্তু এর সাথে এটি মনোকালচার, দুর্ভিক্ষ এবং কীটনাশকের বিপজ্জনক চক্রও তৈরি করেছে। কলম্বাসের হাত ধরে শুরু হওয়া সেই আদান-প্রদান আজও আমাদের বিশ্বকে নানাভাবে প্রভাবিত করে চলেছে।
