পাসপোর্টের বিতর্কিত ইতিহাস: যা কারো জন্য স্বাধীনতা, কারো জন্য বোঝা
 
পাসপোর্টের ইতিহাস বেশ জটিল। বর্তমানে আন্তর্জাতিক ভ্রমণের এই পরিচয়পত্রটি মাইক্রোচিপ, হোলোগ্রাম, বায়োমেট্রিক ছবি ও বারকোডের মতো অত্যাধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে সুরক্ষিত থাকে। কিন্তু একসময় দেশসীমা অতিক্রমের নিয়ম ছিল অনেক সহজ। সেই সরল ও আস্থার যুগ থেকে বিশ্ব কীভাবে পৌঁছেছে আজকের কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থায়- সেটিই পাসপোর্টের দীর্ঘ ইতিহাস।
কয়েক শতাব্দী আগে ইউরোপে চালু হয়েছিল নিরাপদ যাত্রাপত্র বা 'সফ কন্ডুইট', যা শত্রুপক্ষকে আলোচনার জন্য কোনো রাজ্যে নিরাপদে প্রবেশ ও প্রস্থান করার অনুমতি দিত।
বিগত শতাব্দীর শুরুতে তোলা সাদা-কালো ছবি ও ঝিরঝিরে চলচ্চিত্রে দেখা যায় যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসীদের ব্যাপক ঢল। এসব অভিবাসীদের বেশিরভাগকেই যেতে হতো নিউইয়র্কের এলিস আইল্যান্ড দিয়ে, যেখানে স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও সংক্ষিপ্ত জিজ্ঞাসাবাদের পর অধিকাংশকেই দেশে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হতো।
তখনও আন্তর্জাতিকভাবে পরিচয়পত্রের কোনো মানদণ্ড ছিল না। ফলে এ প্রক্রিয়াটি ছিল তুলনামূলক সহজ। বিষয়টি এখনকার বাস্তবতায় কল্পনা করা কঠিন।
অবশ্য কোনো বিষয়ে যদি ঐকমত্য না থাকে, তাহলে সেটিকে নিয়মে পরিণত করা সহজ নয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন ঘটে পুরো বিশ্বে। ১৯২০ সালে লিগ অব নেশনস বৈশ্বিক পাসপোর্ট মানদণ্ড তৈরির উদ্যোগ নেয় এবং বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার অংশ হিসেবে বিবেচনা করে।
এর এক বছর পর, যুক্তরাষ্ট্র সুযোগ বুঝে ১৯২১ সালে ইমার্জেন্সি কোটা অ্যাক্ট এবং ১৯২৪ সালে ইমিগ্রেশন অ্যাক্ট পাশ করে। এসব আইনের উদ্দেশ্য ছিল অভিবাসীদের প্রবেশ সীমিত করা। মূলত আমেরিকান আধিপত্যের আদর্শের প্রতি সম্ভাব্য হুমকির আশঙ্কা থেকেই এমন নীতি প্রণয়ন করা হয়।
তবে শুরু থেকেই পাসপোর্টব্যবস্থা ছিল বিতর্কিত। কেননা কারও জন্য এটি ছিল স্বাধীনতার প্রতীক, আবার কারও জন্য ভারী বোঝা। বিশ শতকের প্রথম দিকে বিবাহিত মার্কিন নারীরা তাদের স্বামীর পাসপোর্টে ফুটনোট হিসেবে যুক্ত থাকতেন। তারা একা সীমান্ত পার হতে পারতেন না। বিপরীতে বিবাহিত পুরুষদের সে স্বাধীনতা ছিল।
কিছু দেশ তখনই এ ব্যবস্থার অন্ধকার দিক বুঝতে পেরে বিরোধিতা করে। বহু দেশ পাসপোর্ট ব্যবস্থা বাতিল করতে চাইলেও, কয়েকটি দেশের অনীহার কারণে শেষ পর্যন্ত কেউই তা করতে পারেনি।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাসপোর্ট নতুন এক জটিল বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছে। এটি এখন কেবল ভ্রমণপত্র নয়, বরং জমি বা শিল্পকর্মের মতোই এক উচ্চমূল্যের সম্পদে পরিণত হয়েছে।
চুরি ও জাল পাসপোর্টের কালোবাজারের পাশাপাশি কিছু দেশ অর্থবিত্তশালীদের জন্য নিজেদের সীমান্ত খোলা রেখেছে।
 যেমন, মাল্টা ও সাইপ্রাস চালু করেছিল 'গোল্ডেন পাসপোর্ট' কর্মসূচি- যেখানে ধনী বিদেশিরা প্রায় এক মিলিয়ন ইউরো বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়ে কার্যত ইউরোপীয় ইউনিয়নের নাগরিকত্ব কিনতে পারতেন।
যদিও এ উদ্যোগ পরে বাতিল করা হয়। পরে যুক্তরাষ্ট্রসহ আরও কয়েকটি দেশ একই ধরনের কথা ভেবেছে। যুক্তরাষ্ট্রের 'গোল্ড কার্ড' কর্মসূচিতে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বসবাসের অনুমতি ও নাগরিকত্বের সুযোগের কথা রয়েছে।
অন্যদিকে, বিশ্বজুড়ে নতুন রাষ্ট্র গঠন, সীমান্ত পরিবর্তন ও জাতিগত বৈষম্যমূলক নীতির কারণে এক শ্রেণির মানুষ ক্রমে রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়ছে। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনারের (ইউএনএইচসিআর) তথ্যমতে, বর্তমানে অন্তত ৪৪ লাখ মানুষ রাষ্ট্রহীন। তবে প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে।
এরা সাধারণত পাসপোর্ট পাওয়ার অধিকার থেকেও বঞ্চিত হন, ফলে স্বাধীনভাবে চলাচলের সুযোগ হারান। এই বৈষম্যগুলো নাগরিকত্ব ধারণার কঠিন বাস্তবতাকে স্পষ্ট করে।
জনপ্রিয় অনলাইন প্ল্যাটফর্ম 'পাসপোর্ট ইনডেক্স' এখন পাসপোর্ট তুলনা করার ইন্টারঅ্যাকটিভ টুল সরবরাহ করছে, যা অনেকটা 'ফুটবল স্কোরবোর্ড'-এর মতো। এছাড়া প্রতি বছরই বিভিন্ন সাময়িকী 'সবচেয়ে শক্তিশালী' ও 'দুর্বলতম' পাসপোর্টের তালিকা প্রকাশ করে। আর সেটা নিয়ে বিশ্বজুড়ে চলে আলোচনার ঝড়।
জন্মের ওপর ভিত্তি করে, একটি পাসপোর্ট আমাদের কাউকে অনেক সুযোগ-সুবিধা দিতে পারে আবার কাউকে চরম কষ্টের মধ্যে ফেলে দিতে পারে। এটি কখনও কারো জন্য নিরাপত্তার ছায়া, কারো জন্য বোঝা।
 

 
             
 
 
 
 
