যুদ্ধবিরতি চলছে, তবুও হলিউডে ইসরায়েল ও গাজা নিয়ে বিতর্ক থামছে না

গত দুই বছরে অনেক জনপ্রিয় তারকা ইসরায়েল এবং হামাসের মধ্যে স্থায়ী যুদ্ধবিরতির পক্ষে নিজের মতামত জানিয়েছেন।
যুদ্ধবিরতিটি যত ভঙ্গুরই হোক না কেন, তা কিন্তু প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু এ নিয়ে হলিউডে উত্তেজনা কমার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এই উত্তপ্ত পরিবেশে, আপনি অনলাইনে যা-ই পোস্ট করেন এবং যখনই পোস্ট করেন, তা সকলের নজরের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
নেটফ্লিক্সের হিট সিরিজ নোবডি ওয়ান্টস দিস-এর নির্মাতা এরিন ফস্টার এই সপ্তাহে ইনস্টাগ্রামে লিখেছেন, 'আমি বুঝতে পারছি না আজ সবাই কেন এত নিস্তব্ধ, কিন্তু এমন একটি চুক্তি হয়েছে যা শেষমেশ ফিলিস্তিনিদের শান্তি এনে দেবে। আপনারা কেন এটি উদযাপন করছেন না?'
অভিনেত্রী ডেব্রা মেসিং হলিউডের কট্টর ইসরায়েলপন্থী কণ্ঠস্বর। এ সপ্তাহে তিনি ইনস্টাগ্রামে লিখেছেন, দুই বছর ধরে 'এখনই যুদ্ধবিরতি' বলে চিৎকার করার পর এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে সেটা কখনো মূল সমস্যা ছিল না। আসল লক্ষ্য ছিল ইসরায়েলকে নিশ্চিহ্ন করা।'
তিনি আরও লেখেন, 'ফ্রি প্যালেস্টাইন' আন্দোলনের নীরবতা এখন বিরক্তিকর। আপনার এই নীরবতা একেবারে স্পষ্ট করে দিচ্ছে যে এটি কেবল ইহুদিদের ভয়ভীতি দেখানোর জন্যই করা হচ্ছে।'
ফিলিস্তিনিপন্থি ও যুদ্ধবিরোধী তারকারা রেড কার্পেট, অ্যাওয়ার্ড শো এবং তাদের সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে ফিলিস্তিনিদের প্রতি মনোযোগ ধরে রেখেছেন। উদাহরণস্বরূপ, অভিনেতা মার্ক রুফালো এই সপ্তাহে ফিল্ম ওয়ার্কাস ফর প্যালেস্টাইনের একটি বার্তা পুনঃপ্রকাশ করেছেন। সেখানে বলা হয়েছে, "গাজার ফিলিস্তিনিদের মধ্যে স্বস্তি দেখা যাচ্ছে যে ইসরায়েলের নির্বিচারের করা হত্যাযজ্ঞ হয়তো শেষ হতে চলেছে।"
এক সপ্তাহ আগে তিনি আর্টিস্ট৪চেজফায়ার গ্রুপের একটি নোটও পুনঃপ্রকাশ করেছিলেন, যেখানে যুদ্ধবিরতির আশা এবং ইসরায়েলে বন্দিদের নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের কথা বলা হয়েছিল। তবে, এই সপ্তাহের শুরুতে ইসরায়েলি বন্দিরা মুক্তি পাওয়ার পর তিনি তাদের প্রত্যাবর্তন উদযাপন না করায় সমালোচনার মুখে পড়েন।
একইভাবে, অভিনেত্রী সিনথিয়া নিক্সন ৯ অক্টোবর একটি বার্তা পোস্ট করেছিলেন। সেখানে তিনি লেখেন, "সমস্ত বন্দিদের মুক্তি দাও এবং ফিলিস্তিনকে মুক্তি দাও।"
তবে ইসরায়েলপন্থি সমর্থকরা বলেছিলেন যে তিনি ইস্রায়েলি নাগরিক বন্দিদের প্রত্যাবর্তনকে স্বীকৃতি দেননি। এ সমর্থকরা আরও যুক্তি দিয়েছিলেন যে এই তারকারা গাজার রাস্তায় হামাসের হাতে ফিলিস্তিনিদের ফাঁসির বিরুদ্ধে কোনো কথা বলেননি।
গাজার এই মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের মতো হত্যাকাণ্ড যুদ্ধবিরতি ভাঙার সম্ভাবনা সৃষ্টি করতে পারে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই সপ্তাহে হামাসকে সতর্ক করেছিলেন যে 'আমাদের তাদের হত্যা করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না, আমাদের অবশ্যই হস্তক্ষেপ করতে হবে,'—যা এই ভঙ্গুর সময়ে উত্তেজনা বাড়াচ্ছে।
ইসরায়েলপন্থি তেল আবিব ইনস্টিটিউট-এর সিনিয়র ফেলো হেন মাজিজগ বলেন, 'যারা এই সংঘর্ষ নিয়ে এতটাই উচ্ছ্বাসিত এবং প্রায় প্রতিদিনই ইসরায়েলের সমালোচনা করে আসছিল, তারা যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার পর গাজার ফিলিস্তিনিদের নির্মম হত্যার বিষয়ে চুপ হয়ে গেছে।'
তিনি দাবি করেছেন যে এই আন্দোলনকারীরা ফিলিস্তিনিদের নিয়ে সত্যিকারের যত্নশীল নয়, বরং কেবল এই বিষয়কে ব্যবহার করে ইসরায়েলকে আক্রমণ করতে চাইছে। তিনি বলেন, 'মুখোশ খুলে গেছে: আমরা ঠিক জানি তারা কী জন্য দাঁড়িয়েছে এবং এর মূল উদ্দেশ্য কী—এটি স্পষ্ট যে তাদের প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করা হয়েছে ইসরায়েলকে আক্রমণ করার জন্য।'
অভিনেতা জাভিয়ের বারদেম — যিনি হলিউডে ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় সমালোচক এবং ফিলিস্তিনিদের সবচেয়ে কট্টর সমর্থক—সম্প্রতি গাজার মৃত্যুদণ্ডের ঘটনা সম্পর্কে সিএনএন-এর সঙ্গে কথা বলেছেন।
বারদেম এক বিবৃতিতে বলেছেন, 'অবশ্যই, আমি হামাসের দ্বারা ফিলিস্তিনিসহ কারো মৃত্যুদণ্ডের সম্পূর্ণ বিরোধী। এটি একটি নৃশংস হিংসাত্মক কাজ।'
তিনি জোর দিয়ে বলেন, 'প্রত্যেকেরই ন্যায়সঙ্গত বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে, যেখানে অভিযোগগুলো দেখানো এবং প্রমাণিত হয়, এবং তারপরই ন্যায়সংগত আইন অনুযায়ী যথাযথভাবে দায়ী করা হয়, যা স্পষ্টভাবে মৃত্যুদণ্ডকে অন্তর্ভুক্ত করে না।'

বয়কটের ডাক স্টুডিও ও তারকাদের একে অপরের বিরুদ্ধে দাঁড় করাচ্ছে
গত মাসে ইসরায়েলি চলচ্চিত্র প্রতিষ্ঠান বয়কটের অঙ্গীকারে স্বাক্ষরকারী প্রায় চার হাজার হলিউড ব্যক্তিত্বের মধ্যে বারদেম একজন। অঙ্গীকারে বলা হয়েছে যে ইসরায়েলি চলচ্চিত্র নির্মাণ শিল্প "ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে গণহত্যা এবং বর্ণবাদে লিপ্ত।"
গত মাসে এমি এওয়ার্ড অনুষ্ঠানের রেড কার্পেটে বারদেম একটি কেফিয়া পরেছিলেন এবং ফিলিস্তিনের জনগণের সমর্থনে একাধিক সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। তিনি ভ্যারাইটিকে বলেন, "আমি এমন কারো সাথে কাজ করতে পারি না যে গণহত্যাকে সমর্থন করে। এটা এতটাই সহজ। এবং আমাদের এই শিল্পে বা অন্য কোনও শিল্পে তা করতে দেওয়া উচিত নয়।"
গত মাসে ফিল্ম ওয়ার্কার্স ফর প্যালেস্টাইন আয়োজিত ইসরায়েলি চলচ্চিত্র বয়কটের প্রতি এমা স্টোন, জোয়াকিন ফিনিক্স, আয়ো এদেবিরি, ইলানা গ্লেজার, সুসান সারান্ডন, রাফালো, নিক্সন এবং বারদেমসহ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শীর্ষস্থানীয় তারকাদের সমর্থন ছিল।
ইসরায়েলি চলচ্চিত্র বয়কটের প্রতিক্রিয়ায় হলিউডের আরেকটি শিল্পী গোষ্ঠির মধ্যে লিভ শ্রাইবার, জিন সিমন্স, শ্যারন ওসবার্ন, জেরি ও'কনেল, হাউই ম্যান্ডেল, মাইম ব্যালিক এবং ডেব্রা মেসিং একটি খোলা চিঠি প্রকাশ করেছেন। তারা বয়কটের সমালোচনা করে বলেছেন যে, গাজার যুদ্ধের কারণে ইসরায়েলি চলচ্চিত্র প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ বন্ধ করার আহ্বান 'সেন্সরশিপ এবং শিল্প মুছে ফেলার প্রচারের' সামিল।
যারা ইসরায়েলি চলচ্চিত্র বয়কটের ডাক দিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থানের ডাক দিয়েছে ইসরায়েলিপন্থি সিইও ডেভিড এলিসন এবং ডেভিড জাস্লাভের নেতৃত্বাধীন স্টুডিও প্যারামাউন্ট এবং ওয়ার্নার ব্রাদার্স। তারা এ বিষয়ে তাদের স্পষ্ট অবস্থানও জানিয়ে দিয়েছে।
এখন, তাদের সৃজনশীল সম্প্রদায়ের হাজার হাজার শিল্পীর সাথে লড়াই করতে হবে যারা তাদের কোম্পানির অবস্থানের সাথে একমত নন।
বারদেম সিএনএনকে বলেন, ইসরায়েলি চলচ্চিত্র প্রতিষ্ঠান বয়কটের জন্য ফিল্ম ওয়ার্কার্স ফর প্যালেস্টাইনের অঙ্গীকারের উদ্দেশ্য হলো এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য দায়ী করা।
বরডেম বলেন, "আমি খুব স্পষ্ট করে বলতে চাই। আমরা কোনও ব্যক্তির সাথে তাদের জাতীয়তা, জাতি, ধর্ম বা লিঙ্গের ভিত্তিতে বৈষম্য করি না। আমরা অবশ্যই বিশ্বাস করি যে কোনও ধরণের বৈষম্য ভুল এবং এটি সমর্থন করি না এবং এটি পুনরাবৃত্তি করে চলেছি। আমরা গাজায় ফিলিস্তিনি জনগণের গণহত্যা এবং পশ্চিম তীরে অবৈধ বসতি স্থাপনে তাদের জড়িত থাকার এবং অংশগ্রহণের জন্য ব্যক্তিদের নয়, বরং বিশ্বজুড়ে কোম্পানি এবং প্রতিষ্ঠানগুলোকে জবাবদিহি করার পক্ষে।"