ভারতের তালেবান প্রীতি: দুই চরমপন্থার এক অন্ধকার মিলন!

আফগানিস্তানের তালেবান সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি না দিয়েও তাদের সঙ্গে কূটনৈতিক যোগাযোগ স্থাপন করার ভারতের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত—দক্ষিণ এশিয়ার ইতোমধ্যেই ভঙ্গুর ভূরাজনৈতিক ভারসাম্যকে আরও অস্থির করে তুলেছে।
প্রথম দর্শনে অনেকের কাছেই একে মনে হতে পারে এক বাস্তববাদী রাজনৈতিক পদক্ষেপ—কাবুলে পাকিস্তানের দীর্ঘস্থায়ী প্রভাবকে ভারসাম্য করতে নয়াদিল্লির কৌশলগত প্রচেষ্টা। কিন্তু এর পেছনে লুকিয়ে আছে আরও অস্বস্তিকর এক সত্য: ভারতের হিন্দুত্ববাদী কট্টর ডানপন্থা ও আফগানিস্তানের ইসলামপন্থী তালেবান—দুইয়ের মধ্যেই এক ধরনের মতাদর্শিক সাদৃশ্য। একে বলা যেতে পারে—'অন্ধকারে ঐক্য'।
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) ও তালেবান যেন দুই বিপরীত মেরু—একটি চরম হিন্দু জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী, অন্যটি কঠোর ইসলামি ধর্মতন্ত্রে। কিন্তু ধর্মীয় আবরণের নিচে দেখা যায়, দুজনেই আধুনিকতা, বহুত্ববাদ এবং নারী স্বাধীনতার প্রতি গভীর বিদ্বেষ ধারণ করে।
উভয় মতবাদই এক পৌরাণিক অতীতকে মহিমান্বিত করে—যেখানে ধর্ম ছিল নির্মল, কর্তৃত্ব ছিল প্রশ্নাতীত, আর নারীরা ছিল নির্ধারিত ভূমিকার মধ্যে বন্দী। তাদের চোখে অগ্রগতি, বিশেষত নারীর মুক্তি, সভ্যতার সূচক নয় বরং সামাজিক শৃঙ্খলার হুমকি।
তালেবান যেমন নারীকে শিক্ষা, কর্মজীবন ও জনজীবন থেকে বাদ দিয়েছে, তেমনি আরএসএসের নারীবিষয়ক ধারণাও নারীকে কথিত ভারতীয় ঐতিহ্য, হিন্দু সংস্কৃতির নামে গৃহকেন্দ্রিক করে রাখে। পার্থক্য কেবল পদ্ধতিতে—তালেবান ভয় ও সহিংসতার মাধ্যমে তা করে, অন্যদিকে আরএসএস সামাজিক পুনর্গঠন, মিডিয়ার ব্যবহার ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার মাধ্যমে। কিন্তু ফলাফল এক—নারীর দেহ ও সামাজিক ভূমিকা ধর্মীয় আধিপত্যের অস্ত্র হয়ে ওঠে।
আরএসএসের প্রভাবের মধ্য দিয়ে ভারতের ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ধীরে ধীরে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রকে একটি হিন্দু রাষ্ট্রে (হিন্দু রাষ্ট্রে) রূপান্তরের পথে নিয়ে যাচ্ছে। পাঠ্যবই পুনর্লিখন করে প্রাচীন হিন্দু সাম্রাজ্যের গৌরবগাথা জোরালো করা হচ্ছে; 'লাভ জিহাদ' তত্ত্বে আন্তঃধর্মীয় বিয়ে নিন্দিত, ঘৃণাযোগ্য করে তোলা হচ্ছে। আবার রাষ্ট্রের নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রশ্ন করলে সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীদের 'দেশদ্রোহী' আখ্যা দেওয়া হচ্ছে।
অন্যদিকে আফগানিস্তানে তালেবান শাসন চালাচ্ছে তাদের নিজস্ব কঠোর ধর্মীয় অনুশাসনে—মানুষ কী পরবে, কী শিখবে, কীভাবে নামাজ পড়বে—সবকিছুর ওপর নির্দেশ জারি। কয়েক দশকের সামাজিক ও নারীর অগ্রগতি মুছে দিচ্ছে এক ঝটকায়।
দুই পক্ষই ধর্মকে ব্যবহার করছে রাজনৈতিক বৈধতা প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার হিসেবে। নিজেদের তুলে ধরছে, পশ্চিমা আধুনিকতা ও নৈতিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে 'দিব্য সত্যের রক্ষক'। কিন্তু বাস্তবতা হলো, যে ভারত এক সময় নারীশিক্ষা, ধর্মনিরপেক্ষতা ও মানবাধিকারের পক্ষে নেতৃত্ব দিয়েছিল, আজ সেই ভারতই এক নিষ্ঠুর শাসনের সঙ্গে হাত মেলাতে চলেছে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সিদ্ধান্ত—তালেবান পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে নয়াদিল্লিতে আমন্ত্রণ জানানো, যদিও অনানুষ্ঠানিকভাবে—একদিকে কৌশলগত বাস্তববাদ, অন্যদিকে নৈতিক দেউলিয়াত্বেরও ইঙ্গিত। দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব বাড়ানোর নামে ভারত হয়তো এক এমন শক্তিকে বৈধতা দিচ্ছে, যা তারই নিজস্ব গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিপরীতে দাঁড়িয়ে।
এই প্রবণতা শুধু ভারত ও আফগানিস্তানেই সীমিত নয়। পাকিস্তানে তেহরিক-ই-লাবাইক পাকিস্তান (টিএলপি) নামের উগ্র ধর্মীয় গোষ্ঠীও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ধর্মনিন্দা আইন ও রাস্তার রাজনীতি ব্যবহার করছে। তালেবান মুখপাত্র জবিহুল্লাহ মুজাহিদের টিএলপি আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ দেখায়, চরমপন্থা এখন সীমান্ত ছাড়িয়ে আদর্শগত একাত্মতা তৈরি করছে।
ইতোমধ্যে আফগানিস্তান তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি)–কে আশ্রয় দিচ্ছে, যারা সীমান্তের এপাড়ে পাকিস্তানে শত শত সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছে। ফলে টিএলপি ও টিটিপি–র মধ্যকার সহানুভূতি পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতাকেও হুমকির মুখে ফেলছে।
আরএসএস, তালেবান ও টিএলপি–কে এক করে রাখে ধর্ম নয়, বরং ভয় ও ঘৃণার রাজনীতি। তারা সবাই নিজেদের বিশ্বাসকে 'আক্রমণের শিকার' মনে করে। তারা সবাই ধর্মীয় 'পবিত্রতার প্রত্যাবর্তন'-এর প্রতিশ্রুতি দেয়—বিচার ও ভিন্নমতকে মুছে দিয়ে। এভাবে তারা ধর্মকে নৈতিক পথনির্দেশক নয়, বরং ক্ষমতার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে।
এই "অন্ধকারে ঐক্য"-র সবচেয়ে বড় বিপদ হলো তার স্বাভাবিকীকরণ। যখন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো কৌশলগত স্বার্থে মৌলবাদের সঙ্গে আপস করে, তখন তারা নিজেদের মূল মূল্যবোধই ক্ষয় করে। ধর্মীয় চরমপন্থা যখন রাজনীতির স্বীকৃতি পায়—সে গেরুয়া পোশাকে হোক বা কালো পাগড়িতে—তখন গণতন্ত্র ও ধর্মতন্ত্রের সীমারেখা মুছে যেতে শুরু করে।
অতীতে এই ভুল করেছিল পাকিস্তান, যার মাশুল তাঁকে গুনতে হয়েছে। ইসলামাবাদ অনেক পরে এসে তালেবানের সঙ্গে দূরত্ব রেখে চলতে শেখে।
কিন্তু আজ দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় হুমকি ধর্মীয় সংঘর্ষ নয়, বরং ধর্মনির্ভর রাজনীতি, যা গণতন্ত্রকে ভেতর থেকে ফাঁপা করে দিচ্ছে। এই শক্তিগুলো যখন বৈধতা পায়, তখন স্বাধীনতা ক্ষয়ে যায়, নাগরিকরা হয়ে ওঠে প্রজা, আর বিশ্বাস হয়ে যায় নিয়ন্ত্রণের অস্ত্র।
ভারত যদি তালেবানের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করতে থাকে, আর একই সঙ্গে দেশে আরএসএসকে ক্ষমতায় প্রভাবিত হতে দেয়, তবে হয়তো তাৎক্ষণিক কৌশলগত জয় পেতে পারে—কিন্তু নৈতিকভাবে হারাবে অনেক বড় কিছু।
দক্ষিণ এশিয়ার প্রকৃত বিপদ সীমান্তের সন্ত্রাস নয়, বরং ভেতরের অন্ধকার—যেখানে ধর্ম আর আধ্যাত্মিকতার নয়, বরং ক্ষমতার প্রতীকে পরিণত হয়।
শেষ পর্যন্ত বলা যায়, এই অন্ধকারবাদ অনেক চেহারায় আসে। আর যখন গণতন্ত্র তার সঙ্গে আপস করে, তখন সেই আলো নিভে যেতে শুরু করে—যে আলো একদিন তাদের পথ দেখিয়েছিল।
লেখক: অ্যাডভোকেট মাজহার সিদ্দিক খান লাহোর হাইকোর্টের একজন শীর্ষ আইনজীবী এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক। এশিয়া টাইমসে প্রকাশিত তার মূল নিবন্ধ থেকে ভাবানূদিত ও পরিমার্জিত অংশটি টিবিএসের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হয়েছে।