কেন ভারতে শহর ছেড়ে গ্রামীণ অঞ্চলে এখন এআইকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে

দক্ষিণ ভারতের হাজার হাজার বছরের পুরোনো মন্দিরের শহর বিরুধুনগরে এখন শুধু প্রাচীন ঐতিহ্যই নয়, বরং অত্যাধুনিক প্রযুক্তির চর্চাও চলছে। এই শান্ত শহরটি পরিণত হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) বিকাশের এক নতুন কেন্দ্রে। এখানে এমন অনেকেই আছেন যারা এই নতুন প্রযুক্তির পেছনে কাজ করছেন, যাদের একজন মোহন কুমার।
মোহন কুমার জানান, তার কাজ হলো 'এআই অ্যানোটেশন' বা এআই মডেলের জন্য ডেটা প্রক্রিয়াকরণ করা। তিনি বিভিন্ন উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করেন, সেগুলোকে চিহ্নিত করেন এবং এআই মডেলকে প্রশিক্ষণ দেন, যাতে মডেলগুলো বস্তু শনাক্ত করতে ও পূর্বাভাস দিতে পারে। সময়ের সাথে সাথে এই মডেলগুলো আধা-স্বয়ংক্রিয় হয়ে ওঠে এবং নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হয়।
ভারত দীর্ঘদিন ধরেই আউটসোর্সড আইটি সহায়তার একটি প্রধান কেন্দ্র। বেঙ্গালুরু বা চেন্নাইয়ের মতো বড় শহরগুলো ঐতিহ্যগতভাবে এই কাজের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে পরিচিত। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মী ও স্থানের খরচ কমাতে প্রত্যন্ত অঞ্চলে তাদের কার্যক্রম সম্প্রসারিত করছে। ।
এটি 'ক্লাউড ফার্মিং' নামে পরিচিত এবং এআই এর উত্থান এটিকে আরও গতি দিয়েছে। বিরুধুনগরের মতো অসংখ্য ছোট শহরে এখন এআই নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠানগুলো ঘাঁটি গেড়েছে।
তবে বড় শহরে না থেকে ছোট শহরে কাজ করার জন্য মোহন কুমার নিজেকে পিছিয়ে পড়া মনে করেন না। তিনি বলেন, 'পেশাগতভাবে এর মধ্যে কোনো আসল পার্থক্য নেই। ছোট শহর বা মেট্রো শহরে, আমরা যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের একই বৈশ্বিক গ্রাহকদের সঙ্গে কাজ করি। প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ এবং দক্ষতাও একই।'
মোহন কুমার যে প্রতিষ্ঠানটির জন্য কাজ করেন, তার নাম 'দেশিক্রু' (Desicrew)। ২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠানটি 'ক্লাউড ফার্মিং'-এর এক অগ্রদূত। দেশিক্রুর প্রধান নির্বাহী মান্নিভানান জে কে বলেন, 'আমরা উপলব্ধি করেছি যে, কাজের সন্ধানে মানুষকে শহরে যেতে বাধ্য করার পরিবর্তে, আমরাই কাজকে মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে পারি।'

তিনি আরও বলেন, 'দীর্ঘদিন ধরে সুযোগ-সুবিধাগুলো শহরকেন্দ্রিক হওয়ায় গ্রামীণ তরুণদের পেছনে ফেলে রাখা হয়েছিল। আমাদের লক্ষ্য সবসময় ছিল বাড়ির কাছাকাছি বিশ্বমানের কর্মজীবনের সুযোগ তৈরি করা এবং একই সাথে প্রমাণ করা যে, মানসম্মত কাজ যেকোনো জায়গা থেকেই সরবরাহ করা সম্ভব।'
দেশিক্রু স্টার্ট-আপ সংস্থাগুলোর জন্য সফটওয়্যার টেস্টিং, এআই প্রশিক্ষণের জন্য ডেটাসেট তৈরি এবং কন্টেন্ট মডারেশনসহ বিভিন্ন ধরনের আউটসোর্সড কাজ করে থাকে। বর্তমানে তাদের ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কাজ এআই সম্পর্কিত। তবে জে কে আশাবাদী, 'খুব শিগগিরই এটি ৭৫ থেকে ১০০ শতাংশে উন্নীত হবে।'
এই এআই-সম্পর্কিত কাজের একটি বড় অংশ হলো ট্রান্সক্রিপশন বা অডিওকে লিখিত রূপ দেওয়া। জে কে ব্যাখ্যা করেন, 'মেশিন লেখা অনেক ভালোভাবে বোঝে।' তিনি আরও বলেন, 'এআই-কে স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে হলে, মানুষকে যেভাবে কথা বলতে দেখা যায়, সেগুলোর ভিন্নতা বোঝার জন্য মেশিনকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এ কারণেই ট্রান্সক্রিপশন এত গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ। এটি ভাষা, উপভাষা এবং বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে মেশিনকে বুঝতে এবং প্রতিক্রিয়া জানাতে একটি ভিত্তি তৈরি করে।'
জে কে-এর মতে, ছোট শহরে এই ধরনের কাজ করা কোনো অসুবিধা নয়। তিনি বলেন, 'মানুষ প্রায়শই ধরে নেয় যে গ্রামীণ মানে অনুন্নত, কিন্তু আমাদের কেন্দ্রগুলো সব দিক থেকেই শহুরে আইটি হাবগুলোর মতো—নিরাপদ ডেটা অ্যাক্সেস, নির্ভরযোগ্য সংযোগ এবং নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ। একমাত্র পার্থক্য হলো ভৌগোলিক অবস্থান।'
দেশিক্রুর প্রায় ৭০ শতাংশ কর্মী নারী। জে কে বলেন, 'অনেকের জন্যই এটি তাদের প্রথম বেতনভুক্ত চাকরি। আর্থিক নিরাপত্তা থেকে শুরু করে সন্তানদের শিক্ষা পর্যন্ত তাদের পরিবারের ওপর এর রূপান্তরকারী প্রভাব রয়েছে।'
২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত নেক্সটওয়েল্থ ও 'ক্লাউড ফার্মিং' বা প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে কাজ করানোর পথিকৃৎ। বেঙ্গালুরুতে সদর দপ্তর হলেও, ভারতের ছোট শহরগুলোতে এর ১১টি অফিসে ৫ হাজার কর্মী কর্মরত।
নেক্সটওয়েল্থের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিথিলি রমেশ বলেন, 'ভারতের ৬০ শতাংশ স্নাতকই আসে ছোট শহরগুলো থেকে, কিন্তু বেশিরভাগ আইটি কোম্পানি শুধু মেট্রো শহরগুলো থেকেই কর্মী নিয়োগ করে। এতে বিপুল সংখ্যক স্মার্ট, প্রথম প্রজন্মের স্নাতক পেছনে পড়ে থাকে।'
তিনি আরও বলেন, 'এই শিক্ষার্থীদের অনেকেই তাদের পরিবারের প্রথম স্নাতক। তাদের বাবা-মা কৃষক, তাঁতি, দর্জি, পুলিশ—যারা তাদের শিক্ষার জন্য ঋণ নিয়ে থাকেন।' নেক্সটওয়েল্থ বড় সংস্থাগুলির ব্যাক অফিস থেকে আউটসোর্সড কাজ দিয়ে শুরু করলেও, পাঁচ বছর আগে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দিকে মোড় নেয়।

রমেশ বলেন, 'বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত অ্যালগরিদমগুলো এখন ভারতের ছোট শহরগুলিতেই প্রশিক্ষিত ও যাচাই করা হচ্ছে।' তাদের প্রায় ৭০ শতাংশ কাজ আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে।
রমেশ ব্যাখ্যা করেন, 'চ্যাটজিপিটি-র মতো সিস্টেম থেকে শুরু করে ফেসিয়াল রিকগনিশন পর্যন্ত প্রতিটি এআই মডেলের জন্য প্রচুর পরিমাণে মানুষের লেবেল করা ডেটা প্রয়োজন। এটাই 'ক্লাউড ফার্মিং' কাজের মেরুদণ্ড।'
তিনি মনে করেন, এটি আগামীতে আরও অনেক কাজ আসবে। 'আগামী ৩-৫ বছরের মধ্যে, এআই এবং জেনএআই প্রশিক্ষণ, যাচাইকরণ এবং রিয়েল-টাইম হ্যান্ডলিংয়ে প্রায় ১০ কোটি নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করবে। ভারতের ছোট শহরগুলো এই কর্মীবাহিনীর মেরুদণ্ড হতে পারে।'
তিনি আশাবাদী যে, ভারত এই ধরনের কাজের কেন্দ্র হিসেবে টিকে থাকবে। তিনি বলেন, 'ফিলিপাইনের মতো দেশগুলি হয়তো আমাদের কাছাকাছি আসতে পারে, কিন্তু এআই সোর্সিংয়ে ভারতের ব্যাপকতা এবং প্রাথমিক শুরু আমাদের পাঁচ থেকে সাত বছরের সুবিধা এনে দিয়েছে। এই সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে, এর আগে ব্যবধান কমে যায়।'
কে এস বিশ্বনাথন, একজন প্রযুক্তি উপদেষ্টা এবং ভারতের সফটওয়্যার ও সার্ভিস কোম্পানিগুলোর জাতীয় সংস্থা ন্যাসকম-এর সাবেক কর্মী। তিনি বলেন, 'সিলিকন ভ্যালি হয়তো এআই ইঞ্জিন তৈরি করছে, কিন্তু সেই ইঞ্জিনগুলোকে নির্ভরযোগ্য রাখতে যে দৈনন্দিন কাজ প্রয়োজন, তা ক্রমবর্ধমানভাবে ভারতের 'ক্লাউড ফার্মিং' শিল্প থেকেই আসছে।'
তিনি আরও বলেন, 'আমরা সত্যিই একটি সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি। 'ক্লাউড ফার্মিং' যদি এভাবে বাড়তে থাকে, তাহলে দুই দশক আগে যেমন ভারতের ছোট শহরগুলো আইটি পরিষেবার কেন্দ্র হয়েছিল, তেমনি এবার এআই অপারেশনের বিশ্বের বৃহত্তম কেন্দ্রে পরিণত হতে পারে।'
তবে এই সাফল্যের পথ নিশ্চিত নয়। নেক্সটওয়েল্থ এবং দেশিক্রু উভয়ই নির্ভরযোগ্য ও সুরক্ষিত ইন্টারনেট সংযোগের সুবিধা থাকার কথা বললেও, বিশ্বনাথন জানান যে ভারতের ছোট শহরগুলোতে সবসময় এমনটা নাও হতে পারে।
তিনি বলেন, 'নির্ভরযোগ্য উচ্চ-গতির ইন্টারনেট এবং সুরক্ষিত ডেটা সেন্টারগুলো মেট্রো শহরগুলোর সমতুল্য নয়, যা ডেটা সুরক্ষাকে একটি উদ্বেগের কারণ করে তোলে।' এমনকি ভালো সংযোগ থাকলেও, গ্রাহকদের আস্থা অর্জনে কাজ করতে হবে। তিনি বলেন, 'বড় চ্যালেঞ্জটি প্রযুক্তিগত নয়, বরং ধারণাগত। আন্তর্জাতিক গ্রাহকরা প্রায়শই ধরে নেন যে ছোট শহরগুলো ডেটা নিরাপত্তার মান পূরণ করতে পারে না, এমনকি যখন সিস্টেমগুলো শক্তিশালী থাকে তখনও। আস্থা অর্জন করতে হয় কাজের মাধ্যমে।'
নেক্সটওয়েল্থের কর্মী ধনলক্ষ্মী বিজয় এআই 'ফাইন-টিউন' করেন। যেমন, যদি এআই দুটি দেখতে একই রকম জিনিস, যেমন একটি নীল ডেনিম জ্যাকেট এবং একটি নেভি শার্টের মধ্যে পার্থক্য করতে ভুল করে, তখন তিনি মডেলটি সংশোধন করেন।
বিজয় বলেন, 'এই সংশোধনগুলো তখন সিস্টেমের মধ্যে পুনরায় দেয়া হয়, মডেলটিকে ফাইন-টিউন করা হয়, যাতে পরের বার এটি একই ধরনের পরিস্থিতি দেখলে আরও ভালোভাবে কাজ করতে পারে। সময়ের সাথে সাথে, এআই মডেল অভিজ্ঞতা অর্জন করে, ঠিক যেমন নিয়মিত প্যাচ দিয়ে সফটওয়্যার আপডেট করে এটিকে আরও নির্ভুল এবং নির্ভরযোগ্য করা হয়।'
এই ধরনের কাজের বাস্তব জীবনে সরাসরি প্রভাব রয়েছে। তিনি বলেন, 'আপনার অনলাইন কেনাকাটার অভিজ্ঞতা সহজ এবং ঝামেলামুক্ত করতে এআই মডেলগুলোকে পরোক্ষভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজটি আমি এবং আমার দলই করে থাকি।'