স্বর্ণের দামের ঊর্ধ্বগতির সবচেয়ে বড় সুফলভোগী দক্ষিণ এশীয় নারীরা

ফারজানা ঘানির কাছে থাকা স্বর্ণের প্রতিটি অলঙ্কারের সঙ্গে তার কোনো না কোনো স্মৃতি জড়িয়ে আছে। পাকিস্তানে নিজের বিয়ের সময় শ্বশুরবাড়ির দেওয়া ভারী গহনা সেট; হজ করার পর তার মায়ের দেওয়া একটি স্বর্ণের চেইন এবং মেয়ের জন্মদিন উপলক্ষ্যে পাওয়া কিছু স্বর্ণের কয়েন প্রভৃতি রয়েছে তার ব্যক্তিগত সংগ্রহে। দাম বাড়লেও এখনও আরও স্বর্ণ কিনতে চান তিনি।
ফ্লোরিডার মিয়ামির বাসিন্দা ৫৬ বছর বয়সী ফারজানা ঘানি বলেন, 'বন্ড বা নগদ অর্থের চেয়ে এখনও আমি স্বর্ণের কয়েন কিনতে বেশি আগ্রহী।'
দক্ষিণ এশিয়ায় বিয়েতে কনেরা ঐতিহ্যগতভাবে হার, দুল, নাকফুল, চুলের কাটা এবং হাতের বাজু প্রভৃতি স্বর্ণের অলঙ্কার পরে থাকেন। এগুলো তারা উত্তরাধিকার সূত্রে বা উপহার হিসেবে পেয়ে থাকেন।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই সংগ্রহ মেয়ের জন্মের আগেই শুরু হয়। কেননা মেয়েরা উত্তরাধিকার সূত্রে তাদের মায়ের স্বর্ণের গহনা পায়। এই প্রথা শহর বা গ্রাম, সামাজিক বা অর্থনৈতিক স্তর নির্বিশেষে সবখানেই প্রচলিত।
স্বর্ণ বহু যুগ ধরে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য নিরাপদ বিনিয়োগের মাধ্যম হিসেবে পরিচিত। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার মানুষদের কাছে স্বর্ণ শুধু বিনিয়োগ নয়, এটি এই অঞ্চলের সংস্কৃতির অংশ।
অনেকে তো আবার স্বর্ণের সুতা দিয়ে সূচিকর্ম করা শাড়িও পড়েন। নারীরা স্বর্ণকে দ্রুত নগদ অর্থে রূপান্তর করার বদলে পরিবারিক সম্পদ মনে করে গচ্ছিত রাখেন। কারণ স্বর্ণ খুব অল্প সম্পদের মধ্যে একটি, যা নারীর একেবারে নিজস্ব।
সম্প্রতি ইতিহাসে প্রথমবারের মতো প্রতি ট্রয় আউন্স স্বর্ণের দাম ৪ হাজার ডলারে পৌঁছেছে। চলতি বছরে এ পর্যন্ত স্বর্ণের দাম বেড়েছে ৫৪ শতাংশ। এই ঊর্ধ্বগতির পেছনে কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অস্থির শুল্কনীতি, ফেডারেল রিজার্ভের প্রধানের বিরুদ্ধে তার আক্রমণাত্মক মন্তব্য এবং ফেডের সুদের হার কমানোর প্রত্যাশাকে।
এদিকে, দীর্ঘদিন ধরে নিজেদের সম্পদের বেশির ভাগ অংশ স্বর্ণে বিনিয়োগ করা দক্ষিণ এশিয়ার নারীরা স্বর্ণের দামের এই ঊর্ধ্বগতিতে বোধ হয় সবচেয়ে লাভবান হয়েছেন।

টিকটকে দক্ষিণ এশিয়ার এক নারী বলেন, 'আমার সব অলঙ্কারই স্বর্ণের। ২৮ বছর আগে পাওয়া ২৪ ক্যারেটের চেইন দেখাচ্ছি। তখন এক গ্রাম স্বর্ণের দাম ছিল ১২ ডলার, এখন তার দাম ১০০ ডলার।'
ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের তথ্যানুযায়ী, ২০২৩ সালে চীনের পরে ভারত ছিল বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম স্বর্ণের গহনার বাজার। ২০২১ সালে ভারত ৬১১ টন স্বর্ণের অলঙ্কার কিনেছিল; অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্য কিনেছিল ২৪১ টন।
ভারতে স্বর্ণের চাহিদা মূলত বিয়ের অলঙ্কারের জন্য। কারণ প্রতি বছর দেশটিতে প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ থেকে ১ কোটি ৩০ লাখ বিয়ে হয়। তাই দেশটির মোট স্বর্ণের অলঙ্কারের অর্ধেকই বিয়েতে বিক্রি হয়।
যুক্তরাজ্যের স্বর্ণ সরবরাহকারী কোম্পানি সোলোমন গ্লোবালের মোট ক্রেতার প্রায় ১০ শতাংশ দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত। কোম্পানিটি জানিয়েছে, গত এক বছরে দক্ষিণ এশীয় নারীদের মধ্যে স্বর্ণ কেনার প্রবণতা বেড়েছে।
ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের সিনিয়র মার্কেট স্ট্র্যাটেজিস্ট জোসেফ কাভাতনি সিএনএনকে বলেন, 'গহনা যেমন ভোগ্যপণ্যের অংশ, তেমনি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সম্পদ হস্তান্তরেরও একটি নির্ভরযোগ্য উপায়।'
ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের ভারতীয় প্রধান নির্বাহী সচিন জৈন বলেন,'ভারতে মানুষ স্বর্ণকে বিলাসদ্রব্য নয়,বরং পারিবারিক সম্পদ মনে করে। সময়ের সঙ্গে যার মূল্য আরও বাড়ে।'
স্বর্ণের অলঙ্কার দক্ষিণ এশীয় নারীদের আর্থিক নিরাপত্তার প্রতীকও বটে। বিশেষত যেখানে কোটি কোটি নারী ব্যাংক হিসাব বা আনুষ্ঠানিক বিনিয়োগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
ইউগভ-এর মার্চ ২০২৩-এর জরিপ অনুযায়ী, ভারতে ৫০ শতাংশেরও কম নারী নিজেদের অর্থ নিজেরা ব্যবস্থাপনা করেন।
ঘানি এমন মানসিকতা নিয়েই বড় হয়েছেন। পাকিস্তানে তার মা সব সময় বলতেন, হাতে যা টাকা থাকবে তা জমিয়ে ২৪ ক্যারেটের সোনার কয়েন কিনে রাখবে।
ফারজানা ঘানি বলেন, 'আমরা পূর্বদেশীয় নারীরা সব সময় খারাপ দিনের জন্য প্রস্তুত থাকি। আমরা আজকের কথা ভাবি, কিন্তু আগামীর কথাও চিন্তা করি।'

বিশ্বজুড়ে স্বর্ণে বিনিয়োগ উন্মাদনা
২০২৫ সালে শুধু দক্ষিণ এশিয়ার নারীরাই নয়, সারাবিশ্বের বিনিয়োগকারীদের নজর এখন স্বর্ণে। ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধের ফলে বৈশ্বিক বাণিজ্যের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেছে, আর তাই বিনিয়োগকারীরা অস্থির মুদ্রা বাজার থেকে সরে এসে নিরাপদ সম্পদে আশ্রয় নিচ্ছেন।
চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে স্বর্ণের বাজার ১৯৮৬ সালের পর সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে রুপা ও প্লাটিনামের মতো অন্যান্য ধাতুর চাহিদাও বেড়েছে।
বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান স্যাভি অ্যাডভাইজার্সের ওয়েলথ ম্যানেজার জোশুয়া ব্যারন সিএনএনকে বলেন, 'সোনা নিরাপত্তা ও মূল্যের প্রতীক।'
যুক্তরাজ্যের অনলাইন স্বর্ণ বিক্রেতা বুলিয়নবাইপোস্টের তথ্য অনুযায়ী, গত ৫০ বছরে স্বর্ণের দাম প্রতি ট্রয় আউন্সে ২,৭০০ শতাংশ বেড়েছে। একই সময়ে রুপার দাম বেড়েছে এক হাজার শতাংশেরও বেশি।
ভারত ও চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোও রিজার্ভ শক্তিশালী করতে স্বর্ণ কিনছে।

সলোমন গ্লোবালের তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংক তার স্বর্ণের মজুত ৩৫ শতাংশ বাড়িয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ার মানুষ বরাবরই নিজেদের ঘরে স্বর্ণ জমিয়ে রাখেন।
ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের প্রধান সচিন জৈন জানান, ধারণা করা হয় ভারতের ঘরোয়া মজুতে ২৫ হাজার টনেরও বেশি সোনা রয়েছে।
তিনি বলেন, তবে দাম বাড়লেও ভারতীয়রা স্বর্ণ বিক্রি করতে আগ্রহী নন। আগে দাম বাড়লে বিক্রির প্রবণতা দেখা যেত, তবে এখন মানুষ তাদের স্বর্ণ ধরে রাখছেন।
ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের মার্কেট স্ট্র্যাটেজিস্ট জোসেফ কাভাতনি বলেন, 'পশ্চিমা বাজারে বিনিয়োগকারীরা সাধারণত ভয় বা অনিশ্চয়তার সময় স্বর্ণ কিনতে আগ্রহী হয়। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার পরিবারগুলো প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে স্বর্ণ মজুত রেখেছে। কারণ তারা জানে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে স্বর্ণের দামও বাড়ে।'
জৈন জানান, সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের তরুণ প্রজন্ম পুরোনো অলঙ্কার নতুন নকশায় রূপান্তর করছে। তারা এখন বিশাল বিয়ের সেট নয়, এমন গহনা চায় যা প্রতিদিন পরা যায়।
জৈন বলেন, 'আমার মনে হয় তরুণ প্রজন্ম এমন গহনা চায় যেগুলোর সঙ্গে তারা নিজের সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে, ভালোবাসতে পারে এবং নিজের জীবনের অংশ করতে পারে।'
গত ডিসেম্বরে মিয়ামিতে ফারজানা ঘানির মেয়ের বিয়ে হয়। সেসময় ঘানি পুরোনো স্বর্ণ ও কয়েন গলিয়ে মেয়ের জন্য আধুনিক ডিজাইনের নতুন গহনা তৈরি করেন। ভবিষ্যতে তার মেয়ে এই গহনা নিজের সন্তানদের দিতে পারবে।
এছাড়া, ছেলের জন্য তিনি কিছু স্বর্ণের কয়েন রেখেছেন।
ফারজানা ঘানি বলেন, 'ও [তার মেয়ে] কৃত্রিম গহনা পরতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি বলেছি স্বর্ণই সবচেয়ে মার্জিত ও রুচিশীল। অন্য কিছু পরিস না।'