ভারত ও পাকিস্তানে বলিউডের নতুন চলচ্চিত্র নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে
একটি নতুন বলিউড স্পাই চলচ্চিত্র যেমন ভারত ও পাকিস্তান জুড়ে প্রশংসা কুড়াচ্ছে এবং একই সাথে অস্বস্তিরও কারণ হচ্ছে। কারণ, এতে দক্ষিণ এশিয়ার এই দুই প্রতিবেশীর দীর্ঘদিনের শত্রুতার একটি বিতর্কিত চিত্র ফুটে উঠেছে। খবর বিবিসির।
গত সপ্তাহে সিনেমা হলে মুক্তি পাওয়া 'ধুরন্ধর' চলচ্চিত্রের গুপ্তচরবৃত্তি, গ্যাং যুদ্ধ এবং দেশপ্রেমের টানটান উত্তেজনাময় এক জগতে ডুব দিতে দেখা যায় দর্শকদের।
বলিউড তারকা রণবীর সিং এতে হামজা নামের একজন ভারতীয় গুপ্তচরের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। চলচ্চিত্রে তাকে পাকিস্তানের করাচিতে একটি বিপজ্জনক মিশনে কাজ করতে দেখা যায়। তার দাপুটে অভিনয়ে ভর করে ছবিটি অপরাধী চক্র, রহস্যময় গুপ্তচর এবং ব্যক্তিগত সমস্যার বিরুদ্ধে তার লড়াইকে তুলে ধরেছে - যার পুরো প্রেক্ষাপট জুড়ে রয়েছে ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা।
যদিও ছবিটির অ্যাকশন-প্যাকড সিকোয়েন্স এবং আকর্ষণীয় প্লট অনেক দর্শকের প্রশংসা কুড়িয়েছে, তবুও পরিচালক আদিত্য ধর পরিচালিত এই ছবিটির রাজনৈতিক বার্তা এবং ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোর উপস্থাপনা তীব্র সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।
আদিত্য ধর ২০১৯ সালে তার প্রথম ছবি উরি: দ্য সার্জিক্যাল স্ট্রাইক দিয়ে প্রথম জাতীয় মনোযোগ আকর্ষণ করেন। তার এ চলচ্চিত্রটি ছিল ২০১৬ সালে পাকিস্তানে ভারতের বিমান হামলার উপর ভিত্তি করে তৈরি একটি নাটকীয় চিত্রায়ণ। ছবিটি বক্স অফিসে বিশাল সাফল্য লাভ করে এবং এর জন্য তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান।
'ধুরন্ধর' তার দ্বিতীয় পরিচালিত ছবি হলেও, তিনি অন্যান্য চলচ্চিত্রের সহ-লেখক ও প্রযোজনা করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে গত বছরের আর্টিকেল ৩৭০ — ২০১৯ সালে কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন বাতিলের উপর ভিত্তি করে নির্মিত। এটিতে তিনি বড় সফলতা পেয়েছেন এবং চলচ্চিত্রটি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিরও প্রশংসা অর্জন করেছিল।
দুই দশকের মধ্যে ভারত-পাকিস্তান সামরিক সংঘাতের সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির কয়েক মাস পরে মুক্তি পাওয়া 'ধুরন্ধর' মুক্তির মধ্য আদিত্য আরও বড় পরিসরে রাজনৈতিক-থ্রিলার চলচ্চিত্রে নিয়ে ফিরেছেন।
গুমোট ঘরে মারাত্মক মারামারি শুরু হয়, জনাকীর্ণ গলিতে গুলি চলে, পিছনে পড়ে থাকে লাশের স্তূপ, এবং নির্যাতনের দৃশ্যগুলো অস্বস্তিকরভাবে দীর্ঘস্থায়ী হয়। এই সহিংসতা অত্যন্ত স্পষ্ট এবং সংকীর্ণ, শ্বাসরুদ্ধকর ফ্রেমে চিত্রায়িত হয়েছে, যা অস্বস্তির অনুভূতিকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
অনলাইনে, প্রশংসা এবং সমালোচনা সমানভাবে আসছে - কেউ কেউ ছবিটির সিনেম্যাটিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং উত্তেজনাপূর্ণ প্লটে মুগ্ধ, আবার অন্যরা এর অতি-জাতীয়তাবাদী সুর এবং সহিংসতার ব্যবহারকে বিচলিতকর ও উস্কানিমূলক বলে মনে করছেন।
এই বিতর্ক এতটাই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে যে কিছু সমালোচককে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে। 'ধুরন্ধর'-এর সমর্থকরা তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন যে তারা ছবিটির সিনেমাটিক যোগ্যতার ভিত্তিতে বিচার না করে রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের মাধ্যমে বিচার করছেন।
চলচ্চিত্র সমালোচকদের একটি সংগঠন, 'দ্য ফিল্ম ক্রিটিকস' গিল্ড, এই সপ্তাহে একটি বিবৃতি জারি করে 'ধুরন্ধর'-এর সমালোচনা করার জন্য চলচ্চিত্র সমালোচকদের প্রতি নির্দেশিত "লক্ষ্যভিত্তিক আক্রমণ, হয়রানি এবং ঘৃণার" নিন্দা জানিয়েছে।
কিন্তু এই মেরুকৃত প্রতিক্রিয়া সত্ত্বেও, ছবিটি বিপুলসংখ্যক দর্শক টানছে এবং ইতোমধ্যেই এটি এই বছরের সবচেয়ে বড় হিটগুলোর একটিতে পরিণত হয়েছে।
তবে এটি অপ্রত্যাশিত নয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, ভারতীয় সিনেমায় জাতীয়তাবাদী ব্লকবাস্টারদের একটি ঢেউ দেখা গেছে, যেগুলোতে প্রকাশ্যে সরকারি নীতি এবং ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোর উল্লেখ রয়েছে।
দ্য কাশ্মীর ফাইলস এবং দ্য কেরালা স্টোরি-এর মতো চলচ্চিত্রগুলো তাদের ঐতিহাসিক নির্ভুলতা এবং রাজনৈতিক বার্তা নিয়ে তীব্র বিতর্কের জন্ম দিলেও, সেগুলো বাণিজ্যিকভাবে হিট হয়েছে।
স্পাই থ্রিলারগুলোও দীর্ঘদিন ধরে ভারতীয় সিনেমায় একটি বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছে। এই ধরনের চলচ্চিত্রগুলোতে প্রায়শই পাকিস্তানকে ভারতের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হিসেবে দেখানো হয়। অবশ্য এসব দুই দেশের মধ্যে কয়েক দশক ধরে চলা ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনার গভীরে প্রথিত একটি সুপরিচিত ধারণা হিসেবেই ধরা হয়।
এই চলচ্চিত্রগুলোর নির্মাতারা মনে করেন, এগুলো দর্শকদের কাছে সমাদৃত হয় কারণ তারা এমন ঐতিহাসিক ঘটনা এবং সমসাময়িক বিষয়গুলোকে তুলে ধরে যা মূলধারার বাণিজ্যিক সিনেমা প্রায়শই উপেক্ষা করে যায়।
গত বছর দ্য কেরালা স্টোরি-এর পরিচালক সুদীপ্ত সেন বিবিসিকে বলেন, "আমার সিনেমা রাজনৈতিক নয়, এগুলো মানুষের আগ্রহের বিষয়।" ২০২৩ সালের এই ছবিটি দাবি করেছিল যে এটি হিন্দু ও খ্রিষ্টান নারীদের ইসলামে ধর্মান্তরিত করে ইসলামিক স্টেট (আইএস)-এ যোগদানের 'সত্য ঘটনা' বলছে।
কিন্তু সমালোচকরা বলছেন যে এই ধরনের চলচ্চিত্রগুলো, প্রধান ঘটনাগুলোর সম্পূর্ণ মিথ্যা রচনার মাধ্যমে, বিনোদন এবং প্রচারণার মধ্যেকার রেখাটি ক্রমশ অস্পষ্ট করে দিচ্ছে। জটিল ইতিহাসকে তারা অতি-সরলীকৃত গল্পে পরিণত করছে।
চলচ্চিত্র সমালোচক উদয় ভাটিয়া মনে করেন, 'ধুরন্ধর' ছবিটি হলো এমন এক ধরনের গুপ্তচর থ্রিলার, যা আজকাল খুব চলছে। এই ছবিতে প্রবলভাবে জাতীয়তাবাদী মনোভাব দেখানো হয়েছে এবং এই কারণেই এটি সেই জনপ্রিয় ধারার অন্তর্ভুক্ত।
মুক্তি পাওয়ার আগেই ছবিটি আইনি যাচাই-এর সম্মুখীন হয়েছিল। একজন প্রয়াত সেনা কর্মকর্তার পরিবার অভিযোগ করেছিল যে ছবির গল্পের কিছু অংশ অনুমতি না নিয়েই তার জীবনীর ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে। আদিত্য এই অভিযোগ অস্বীকার করেন এবং অবশেষে ভারতের সেন্ট্রাল বোর্ড অফ ফিল্ম সার্টিফিকেশন ছবিটিকে একটি কল্পিত চিত্রনাট্য হিসাবে অনুমোদন দেয়।
তবুও, এই চলচ্চিত্রটি বেশ কিছু বাস্তব ঘটনা এবং ঐতিহাসিক উত্তেজনাপূর্ণ মুহূর্তকে অবাধে গল্পের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ২০০১ সালে ভারতীয় পার্লামেন্টের উপর হামলা এবং ২৬/১১ মুম্বাই সন্ত্রাসী হামলার খবরের ফুটেজ ও আসল অডিও রেকর্ডিং।
আসলে, ছবির গল্পটি শুরুই হয় ১৯৯৯ সালে একটি ভারতীয় যাত্রীবাহী বিমান হাইজ্যাকের ঘটনার রেফারেন্স দিয়ে।
আমরা দেখি, আর মাধবনের অভিনীত চরিত্র, ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান অজয় সান্যাল, হাইজ্যাকের প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তানের মাটিতে আঘাত হানার প্রতিজ্ঞা করছেন।
তাই তিনি তার সেরা লোক হামজাকে পাঠান করাচির গ্যাংস্টার এবং সন্ত্রাসী নেটওয়ার্কগুলোর মধ্যে কথিত সংযোগ ছিন্ন করতে। চলচ্চিত্রের ভাষ্য অনুসারে, গ্যাংস্টার ও সন্ত্রাসী নেটওয়ার্কগুলো পাকিস্তান সরকারের নীরব সমর্থনে পরিচালিত হয়।
আদিত্য করাচিকে হতাশাজনকভাবে চিত্রায়িত করেছেন। দেখানো হয়েছে, শহরটিকে একটি বিশাল আইনশৃঙ্খলাহীন শহর। এখানে অপহরণ এবং নির্যাতন ব্যাপকভাবে প্রচলিত এবং প্রতিদ্বন্দ্বী গ্যাংগুলোর মধ্যে প্রতিশোধমূলক হত্যাকাণ্ড নির্মমতার সাথে ঘটে চলেছে।
কিছু সমালোচক বাস্তব গ্যাং-এর ইতিহাসের সাথে সিনেমাটিক অতিরঞ্জনের মিশ্রণের সমালোচনা করেছেন। মি. ভাটিয়া বলেন, "এই ছবিতে পাকিস্তানকে একটি আইনহীন, প্রায় বর্বর ভূমি হিসেবে দেখানো হয়েছে। আর দেশটিকে ভারতের প্রতি জন্মগতভাবে বৈরী দেখানো হয়েছে। এটি আন্তঃসীমান্ত সংঘাতকে ধর্মীয় প্রেক্ষাপটেও তুলে ধরেছে।"
তবে অন্যরা মনে করেন এই চিত্রায়নগুলো ছিল চমকপ্রদভাবে সঠিক। ইন্ডিয়া টুডে-এর ওয়েবসাইটে বিনীতা কুমার লিখেছেন, "আদিত্য যেখানে সবচেয়ে বড় ঝুঁকি নিয়েছেন তা হলো পাকিস্তানের চিত্রায়ণে। এটি ব্যঙ্গাত্মক নয়, বরং আশ্চর্যজনকভাবে সূক্ষ্ম, বিশেষত রাজনৈতিকভাবে।"
এই মিশ্র প্রতিক্রিয়া কেবল ভারতেই নয় — পাকিস্তানেও 'ধুরন্ধর' নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।
কয়েক দশক ধরে সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান সীমিত, এবং প্রায়শই সিনেমার ওপরই এর সবচেয়ে বড় আঘাত এসেছে। ২০১৯ সালে পাকিস্তানে ভারতীয় চলচ্চিত্র নিষিদ্ধ করা হয়। অন্যদিকে ভারত প্রায়শই পাকিস্তানি চলচ্চিত্র এবং সংগীতের ওপর বাধা সৃষ্টি করে।
তা সত্ত্বেও, বলিউড পাকিস্তানে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় এবং দর্শকরা প্রায়ই ভিপিএন (ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক) ব্যবহার করে বা অবৈধভাবে চলচ্চিত্র ডাউনলোড করে দেখেন।
'ধুরন্ধর'-এর ক্ষেত্রে, ডন সংবাদপত্রসহ বিভিন্ন সম্পাদকীয়তে পাকিস্তানের নেতিবাচক চিত্রায়ণের সমালোচনা করা হয়েছে। একই সাথে আক্ষেপ প্রকাশ করে বলা হয়েছে, স্থানীয় চলচ্চিত্র নির্মাতারা প্রায়শই তাদের নিজস্ব ইতিহাসকে উপেক্ষা করেন, যার ফলে বলিউডকে সেই গল্পগুলো নিজেদের মতো ব্যাখ্যা করার সুযোগ পায়।
সমালোচকরা কিছু তথ্যগত ভুলও তুলে ধরেছেন, যেমন করাচির লিয়ারি গ্যাং-এর চিত্রায়ণ। এই গ্যাং সাধারণত চাঁদাবাজি, অপহরণ এবং মাদক পাচারের সাথে জড়িত, কিন্তু ছবিতে তাদের ভারতের সাথে আন্তঃসীমান্ত উত্তেজনায় যুক্ত দেখানো হয়েছে।
করাচিতে বেড়ে ওঠা কনটেন্ট নির্মাতা বিলাল হুসেন বলেন, এই গ্যাংটিকে ছবিতে দেখানো হয়েছে দেখে তিনি অবাক হয়েছেন। তবে তিনি আরও বলেন, ছবিটি "প্রপাগান্ডামূলক" হওয়া সত্ত্বেও এর অ্যাকশন, অভিনয় এবং সঙ্গীত উপভোগ করা যেতে পারে।
সবচেয়ে তীব্র সমালোচনা এসেছে সিন্ধু প্রদেশ শাসক পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) -এর পক্ষ থেকে। এই সমালোচনা কারণ এতে পিপিপি-এর একটি কাল্পনিক সমাবেশের দৃশ্য দেখানো হয়েছে। এখানে দলীয় পতাকা এবং ২০০৭ সালে নিহত সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর ছবি ব্যবহার করা হয়েছিল।
পার্টির একজন নেতা চলচ্চিত্রটিকে "বিদ্বেষপূর্ণভাবে বিকৃতি" বলে অভিহিত করেছেন। তিনি অভিযোগ করেন পিপিপিকে জঙ্গিদের প্রতি সহানুভূতিশীল হিসাবে চিত্রিত করার চেষ্টা করেছে।
তবে, ভাষ্যকাররা বলছেন যে, এর তথ্যগত ভুল থাকা সত্ত্বেও, এই ছবিটি এর আগের অনেক চলচ্চিত্রের মতোই পাকিস্তানে বলিউডের জনপ্রিয়তা কমাতে পারবে না, কারণ পাকিস্তানে তুলনামূলকভাবে ভালো স্থানীয় চলচ্চিত্র শিল্পের অভাব রয়েছে।
এই মনোভাব ভারতেও কিছুটা প্রতিফলিত হয়েছে। সেখানে অনেক দর্শক ছবিটি নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং বলেছেন যে তারা এটিকে নিছক বিনোদনের জন্য দেখছেন।
ভাটিয়া বলেন, "দিন শেষে এটি একটি কল্পকাহিনি এবং যা খুশি তা তৈরি করতে পারে।"
তিনি আরও বলেন, "তবে এতে যে একটি একপেশে ও নির্বাচিত দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করেছে এবং তা স্পষ্টভাবেই ছবিতে খুবই কৌশলে তুলে ধরা হয়েছে।"
