চীনকে কি তার শিখর থেকে নামানো সম্ভব?

বছরকয়েক আগেও মনে হচ্ছিল যুক্তরাষ্ট্র ও চীন বৈশ্বিক আধিপত্য নিয়ে এক নতুন স্নায়ুযুদ্ধে নামবে। কিন্তু সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা সেই সম্ভাবনাকে অনেকটাই ম্লান করে দিয়েছে — বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের নিজের সিদ্ধান্ত ও আচরণগুলোর কারণে।
ট্রাম্প প্রশাসনের দ্বিতীয় দফার শুরুতেই ওয়াশিংটনের পররাষ্ট্রনীতি মিত্রদের বিমুখ করে তুলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজার ও উৎপাদনশক্তিকে চীনের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার জন্য যেসব দেশ প্রয়োজন ছিল — ইউরোপ, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান — তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ক্রমেই দুর্বল হয়েছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র এখন দাঁড়িয়ে আছে একা, এমন এক প্রতিদ্বন্দ্বীর বিপরীতে যার উৎপাদনমূলক অর্থনীতি তার চেয়ে চার গুণ বড়।
এদিকে বাণিজ্যযুদ্ধে শুল্কনীতির আঘাতে মার্কিন উৎপাদন খাত আরও দুর্বল হয়েছে। ট্রাম্প ক্ষমতায় ফেরার কয়েক মাসের মধ্যেই "গণতান্ত্রিক বিশ্বের নেতৃত্বে চীনের উত্থান ঠেকানো" ধারণাটি প্রায় অবাস্তব মনে হচ্ছে। বিপরীতে, বেইজিং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় ক্রমেই প্রভাবশালী অবস্থানে চলে গেছে।
ফলত, চীন এখন কার্যত বিশ্বের প্রধান শক্তি — "চীনের শতাব্দী" শুরু হয়েছে বললেই চলে। তবে এটি "আমেরিকান সেঞ্চুরি"-র মতো হবে না, কারণ চীন তার ক্ষমতা ও প্রভাব প্রয়োগ করবে ভিন্নভাবে — রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত, প্রযুক্তিনির্ভর এবং জাতীয় স্বার্থকেন্দ্রিকভাবে।
ইতিহাসের শিক্ষা: উত্থান ও পতনের পরস্পরবিরোধিতা
অবশ্য ইতিহাস বলে, সব উত্থানই স্থায়ী হয় না। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে চারটি শক্তি — যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, জাপান ও রাশিয়া — সমানতালে উঠেছিল। এর মধ্যে কেবল যুক্তরাষ্ট্রই টিকে থাকতে পেরেছিল। জার্মানি ও জাপান নিজেদের ধ্বংস করেছিল অজেয় শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করে, আর রাশিয়া ভেঙে পড়েছিল রাজনৈতিক অদক্ষতা ও অর্থনৈতিক অপশাসনে।
তাই চীনও তার শিখরেই হোঁচট খেতে পারে — হয়ত আমেরিকার কারণে নয়, বরং নিজের অভ্যন্তরীণ সীমাবদ্ধতার কারণে। এই সম্ভাবনা ক্ষীণ হলেও তা অস্বীকার করা যায় না।
জনসংখ্যাগত সংকট: ভবিষ্যতের ভূত
চীনের সমালোচকরা দীর্ঘদিন ধরেই জনসংখ্যা সংকটকে তার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হিসেবে দেখছেন। দেশটির প্রজনন হার এখন বিশ্বের অন্যতম নিম্ন — নারী প্রতি সন্তান জন্মদানের হার নেমে এসেছে মাত্র ১- এ, যা জাপান, ইউরোপ কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও কম।
এর মানে হলো, এক প্রজন্মের ব্যবধানে চীনের জনসংখ্যা অর্ধেকে নেমে আসতে পারে। এর প্রভাব হবে বহুমাত্রিক — তরুণ কর্মীদের ওপর বৃদ্ধদের বোঝা বাড়বে, উৎপাদনশীলতা কমবে, বিনিয়োগে আগ্রহও হ্রাস পাবে।
অনেকে যুক্তি দেন, রোবট ও অটোমেশন এই ঘাটতি পূরণ করবে। কিন্তু শ্রম ও পুঁজির মধ্যে পরিপূরক সম্পর্ক থাকলে মানুষের বিকল্প তৈরি করা কঠিন। আর যদি রোবটই পুরো শ্রমশক্তি দখল করে নেয়, তবে চীনের সবচেয়ে বড় সুবিধা — তার বিপুল শিক্ষিত মানবসম্পদ — মূল্যহীন হয়ে পড়বে।
তবে সংকটটি এখনই তীব্র নয়। বিশাল বেবি বুম প্রজন্মের "ইকো প্রজন্ম" এখনো শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে। ফলে ২০২৭ সালের আগে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী কমবে না বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রকৃত চাপ দেখা দেবে ২০৪০-এর দশকের মাঝামাঝি।
সামষ্টিক অর্থনীতির জটিলতা
চীনের অর্থনীতির বর্তমান সংকট মূলত রিয়েল এস্টেট খাতের ধস থেকে শুরু। তিন বছর আগে ফেটে পড়া এই বুদবুদের পরিণতিতে দেখা দিয়েছে অগণিত মন্দ ঋণ, স্থানীয় সরকারের রাজস্ব ঘাটতি, মূল্যস্ফীতি নয় বরং মূল্যসংকোচন।
সাধারণত এমন অবস্থায় সরকার অর্থ ছাপিয়ে উদ্ধার প্যাকেজ দেয়। বেইজিংও সেই পথে হাঁটছে — ব্যাংক, স্থানীয় সরকার, এমনকি বড় নির্মাতাদেরও সহায়তার উদ্যোগ চলছে।
কিন্তু একইসঙ্গে সরকার নতুনভাবে প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে ব্যাংকগুলোকে বিপুল পরিমাণ ঋণ দিতে বলেছে উৎপাদন খাতে। এতে যে "অতিরিক্ত প্রতিযোগিতা" তৈরি হয়েছে, তা এখন বড় সমস্যা।
সরকারি ভর্তুকি ও সস্তা ঋণের জোয়ারে অসংখ্য কোম্পানি একই পণ্য উৎপাদন করছে — ইলেকট্রিক গাড়ি, সৌর প্যানেল, রোবট ইত্যাদি। এতে বাজারে সরবরাহ অতিরিক্ত বেড়ে গেছে, দাম কমছে, অনেকেরই লাভের মার্জিন পৌঁছেছে শূন্যের কাছাকাছি।এই অতিরিক্ত উৎপাদন মূল্য সংকোচনের চাপ সৃষ্টি করেছে, ব্যাংক ও কর্পোরেট ঋণ পরিশোধ কঠিন হয়ে উঠেছে। নতুন করে আবারও মন্দ ঋণের পাহাড় জমছে। চীনের ঋণ-জিডিপি অনুপাত এখন রেকর্ড উচ্চতায়।
সরকার এখন "মূল্যযুদ্ধ" ঠেকাতে কোম্পানিগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ বাড়াচ্ছে — যা একধরনের সরকারি মূল্যনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। এটি অস্থায়ী স্বস্তি দিলেও দীর্ঘমেয়াদে উৎপাদনশীলতা কমাতে পারে, যেমনটা ঘটেছিল জাপানের "হারানো দশকে"।
অর্থনৈতিকভাবে এটি এক জটিল ভারসাম্য: অদক্ষ কোম্পানি বন্ধ করলে বেকারত্ব বাড়বে, আবার তাদের বাঁচিয়ে রাখলে পুঁজির অপচয় চলবে। বিশাল ভৌগোলিক বৈচিত্র্য ও প্রাদেশিক স্বার্থের কারণে চীনের জন্য সিদ্ধান্তটি আরও সংবেদনশীল।
ফলে চীন এখন এমন এক "ম্যাক্রোইকোনমিক ফাঁদে" পড়েছে, যেখানে সংকোচন থামাতে গেলে রাজনৈতিক ঝুঁকি, আর সংকোচন চলতে দিলে অর্থনৈতিক স্থবিরতা নিশ্চিত।
যুদ্ধ ও অভ্যন্তরীণ বিভাজন: ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি!
ইতিহাস বলছে, বড় শক্তিগুলোর পতন সাধারণত দুটি কারণে হয় — যুদ্ধ বা অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা। ইউরোপের ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো যেমন অতিরিক্ত যুদ্ধের ভারে ভেঙে পড়েছিল, তেমনি চীনের তাং রাজবংশ ও মঙ্গোল সাম্রাজ্যও ধ্বংস হয়েছিল অন্তর্কলহে।
আজকের চীনের ক্ষেত্রেও সেই ঝুঁকি অস্বীকার করা যায় না। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নীতিতে মিত্ররা ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে — ইউরোপ, ভারত, কোরিয়া বা জাপানের সঙ্গে আগের মতো ঐক্য আর নেই। ফলে চীনের বিরুদ্ধে একত্রিত সামরিক জোট গঠনের সম্ভাবনা এখন ক্ষীণ।
অন্যদিকে, বেইজিংয়ের আসল ঝুঁকি এখন ঘরের ভেতরেই — নেতৃত্ব সংকট ও রাজনৈতিক বিভাজন। ৭২ বছর বয়সী শি জিনপিং এখনও উত্তরসূরি নির্ধারণ করেননি। ক্ষমতার ভারসাম্য নষ্ট হওয়ায় দলের অভ্যন্তরে অসন্তোষ বাড়ছে, এবং শি সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ক্রমেই কঠোর হচ্ছেন।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সেনাবাহিনীসহ প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ে ব্যাপক শুদ্ধি অভিযান চালিয়েছেন তিনি। দ্য ইকোনমিস্ট–এর তথ্য অনুযায়ী, মহামারি পরবর্তী সময়ে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তদন্তের হার তিনগুণ বেড়েছে।
ইতিহাস বলে, এমন আত্মবিনাশী ক্ষমতাদ্বন্দ্ব অনেক শক্তিশালী সাম্রাজ্যকেই ধ্বংস করেছে। চীনের ক্ষেত্রেও যদি এমন কিছু ঘটে, তা তার "চাইনিজ সেঞ্চুরি"-র সমাপ্তি ডেকে আনতে পারে।
তবে যদি শি জিনপিং বাস্তববাদী সিদ্ধান্ত নেন এবং পুনরায় নেতৃত্ব নির্বাচনের ঐতিহ্যবাহী কাঠামো ফিরিয়ে আনেন, চীন হয়তো তার স্থায়িত্ব আরও কয়েক দশক ধরে রাখতে পারবে।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।
সূত্র: এশিয়া টাইমসে প্রকাশিত মূল নিবন্ধের বিশ্লেষণ থেকে পরিমার্জিত ও ভাবানুবাদিত।