আপাত আশাবাদী মন্তব্যের আড়ালে, ট্রাম্প কি ইউক্রেনকে পরিত্যাগ করতে চলেছেন?

রাশিয়ার কাছ থেকে নিজেদের সব ভূখণ্ড ফিরে পেতে ইউক্রেনকে সমর্থন জানিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মন্তব্য স্বস্তি ও সংশয়ের মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। অনেকের ধারণা, এ মন্তব্যের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ইউক্রেনকে সহায়তার ক্ষেত্রে ইউরোপের ওপর আরও বেশি দায়িত্বে চাপিয়ে দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
'ট্রুথ সোশ্যাল'-এ দেওয়া পোস্টে ট্রাম্প তার আগের অবস্থান থেকে বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিয়েছেন।
এর আগে তিনি যুদ্ধ অবসানে ইউক্রেনকে নিজের কিছু ভূখণ্ড ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন এবং গত মাসে আলাস্কায় ভ্লাদিমির পুতিনকে আনুষ্ঠানিকভাবে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন।
তবে ট্রাম্প তার বক্তব্য অনুযায়ী কোনো নীতিগত পরিবর্তন আনবেন কি না, তা স্পষ্ট নয়। এখন থেকে ইউক্রেনের অস্ত্র ও অর্থায়নের চাহিদা মেটাতে ইউরোপকে আরও বেশি দায়িত্ব নিতে হতে পারে। কারণ এক্ষেত্রে ওয়াশিংটনের ভূমিকা ধীরে ধীরে কমছে।
রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের (রুসি) আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা পরিচালক নিল মেলভিন রয়টার্সকে বলেন, 'আমার মনে হয় মানুষ কিছুটা আশাবাদী, কারণ এটি ইঙ্গিত দিচ্ছে যে ট্রাম্পের এই সংঘাত নিয়ে বোঝাপড়া বদলেছে।'
তিনি বলেন, 'তিনি [ট্রাম্প] স্বীকার করেছেন যে সংঘাতটি জটিল এবং তিনি পুতিনকে নিয়ে স্পষ্টতই বিরক্ত। তাই এটি ইউক্রেন ও ইউরোপীয় কূটনীতির জন্য একটি সাফল্য বলা যেতে পারে।'
তবে ট্রাম্প এখনও সংঘাত নিয়ে একটি কৌশলগত দ্ব্যর্থতা বজায় রাখছেন, ইউক্রেনকে উৎসাহ দিচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু মার্কিন সমর্থনের বিষয়ে পরিষ্কার কিছু বলছেন না বলে জানান মেলভিন।
তিনি বলেন, 'তার [ট্রাম্প] ভাষা বদলেছে, কিন্তু এখনও মনে হচ্ছে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের চাপ কমিয়ে ইউরোপের ওপর দায়িত্ব চাপিয়ে দিচ্ছেন।'
ইউরোপের জন্য বাড়তি দায়িত্ব নেওয়া সহজ হবে না
জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী জোহান ওয়াডেফুল ট্রাম্পের মন্তব্যকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, ইউরোপের আরও এগিয়ে আসার সময় এসেছে।
জার্মানির 'ডয়চল্যান্ডফাঙ্ক' রেডিওকে তিনি বলেন, 'আমরা আরও অনেক কিছু করতে পারি। সব ইউরোপীয় দেশ ইউক্রেনকে যা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তা পূরণ করেনি।'
তিনি আরও বলেন, 'আমাদের দেখতে হবে আর কী ধরনের আর্থিক ও সামরিক বিকল্প আমাদের হাতে আছে।'
তবে তিনি স্বীকার করেন, ইউরোপের পক্ষে নিরাপত্তা জোরদার করা সহজ হবে না।
রয়টার্সকে দুই কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ট্রাম্প হয়তো ইঙ্গিত দিচ্ছেন যে এখন ইউরোপেরই ইউক্রেনকে সাহায্য করার দায়িত্ব বেশি।
এক পশ্চিম ইউরোপীয় কর্মকর্তা বলেন, 'তিনি [ট্রাম্প] মনে হচ্ছে বিদায় জানাচ্ছেন। তবে কালই তিনি মত পাল্টাতে পারেন। আমাদের করণীয় স্পষ্ট।'
একজন জ্যেষ্ঠ পূর্ব ইউরোপীয় কূটনীতিক বলেন, ট্রাম্পের মন্তব্য শুনে মনে হচ্ছে তিনি ইউরোপকে জানাতে চাইছেন, এখন এটি তাদের সমস্যা।
নিউইয়র্কে পোল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট ক্যারোল নাভরোকি বলেন, তিনি ট্রাম্পকে বলেছেন তার ভাষণ ছিল 'চমৎকার'।
ইউক্রেন ইস্যুতে ট্রাম্পের অবস্থান প্রসঙ্গে নাভরোকি বলেন, তিনি মনে করেন এটি ট্রাম্পের অবস্থানের মৌলিক কোনো পরিবর্তন নয়।
পোল্যান্ডের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র রয়টার্সকে বলেন, ট্রাম্পের সর্বশেষ মন্তব্য ইতিবাচক এবং 'এবার তার বক্তব্য আরও স্পষ্ট'।
ট্রাম্পের মন্তব্যের পর বুধবার সকালে ইউরোপীয় প্রতিরক্ষা খাতের শেয়ারের দাম বেড়েছে, তবে ইউক্রেনের আন্তর্জাতিক বন্ডের দাম কমেছে।
ইউক্রেনীয় বন্ডে বিনিয়োগ করা অ্যাবারডিন ইনভেস্টমেন্টসের পোর্টফোলিও ম্যানেজার ভিক্টর স্যাবো বলেন, ট্রাম্পের মন্তব্য সবসময় সন্দেহের সঙ্গে দেখা উচিত এবং বন্ড বাজার এখনও ইউক্রেনের অর্থনীতি নিয়ে আশাবাদী নয়।
ইতোমধ্যে ইউরোপ বড় ভূমিকা পালন করছে
দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার আগে ট্রাম্প দাবি করেছিলেন, তিনি পুনর্নির্বাচিত হলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ করতে পারবেন।
ফেব্রুয়ারিতে ওভাল অফিসে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে এক ব্যর্থ বৈঠকের পর, ইউরোপীয় নেতারা তাকে নিজেদের পক্ষে আনার জন্য তৎপরতা বাড়ান।
তারা ট্রাম্পকে বোঝাতে চেষ্টা করেছেন যে যুদ্ধের সম্পূর্ণ দায় মস্কোর। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ার পূর্ণমাত্রার আগ্রাসনের মাধ্যমে যুদ্ধ শুরু হয়।
চ্যাথাম হাউসের ইউক্রেন ফোরামের গবেষক জারোস্লাভা বার্বিয়ারি রয়টার্সকে বলেন, 'ট্রাম্প এখন বুঝতে শুরু করেছেন যে পুতিন তাকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে চালাচ্ছেন। আমার মনে হয় ট্রাম্প এখন এমন একটি পথ খুঁজছেন যাতে তিনি নিজেকে কার্যকর শান্তি মধ্যস্থতাকারী হিসেবে তুলে ধরতে পারেন এবং দোষ চাপাতে পারেন রাশিয়া ও ইউরোপের ওপর—যাতে যুদ্ধ শেষ না হলেও দায় তার ওপর না পড়ে।'
যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে ইউক্রেনের সবচেয়ে বড় মিত্র এবং অস্ত্র সরবরাহকারী। তবে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ট্রাম্প জোর দিয়ে আসছেন যে ইউরোপকে নিজেদের প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে তিনি ইতোমধ্যে কিছুটা হলেও সফল হয়েছেন।
ন্যাটো সদস্য ইউরোপীয় দেশগুলো তাদের প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়িয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র ভাণ্ডার থেকে কিয়েভকে অস্ত্র দেওয়ার জন্য নতুন একটি ব্যবস্থার অধীনে বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সরবরাহ করেছে।
তবু মেলভিন বলেন, ইউরোপের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ট্রাম্পের ভাষা আবারও পরিবর্তন হতে পারে।
তিনি বলেন, 'এখনও পুতিন একটি ফোন দিলেই ট্রাম্পের অবস্থান পাল্টে যেতে পারে। মূলত প্রথম আট মাসেই [ট্রাম্পের প্রতি] ইউরোপের আস্থা কমেছে এবং খুব দ্রুতই সেই আস্থা পুরোপুরি ফিরবে বলে মনে হয় না।'