বৈশ্বিক উষ্ণতার জন্য দায়ী গ্যাসের নিঃসরণ কমানোর অঙ্গীকার চীনের; ২০৬০ সালের মধ্যে ‘কার্বন নিরপেক্ষ’ হওয়ার লক্ষ্য

বিশ্বের সবচেয়ে বেশি গ্রিনহাউস ও জলবায়ুর জন্য অন্যান্য ক্ষতিকর গ্যাস নিঃসরণকারী দেশ চীন প্রথমবারের মতো নিঃসরণ কমানোর সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ঘোষণা করেছে। খবর বিবিসি'র।
জাতিসংঘে দেওয়া এক ভিডিও বার্তায় চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং জানান, ২০৩৫ সালের মধ্যে দেশটি পুরো অর্থনীতিতে গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ ৭ থেকে ১০ শতাংশ কমাবে। তিনি আরও বলেন, চীন এর চেয়ে ভালো করারও চেষ্টা করবে।
এই ঘোষণা এল এমন এক সময়ে, যখন যুক্তরাষ্ট্র জলবায়ু প্রতিশ্রুতি থেকে সরে যাচ্ছে। মঙ্গলবার (২৩ সেপ্টেম্বর) মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জলবায়ু পরিবর্তনের ধারণাকে 'প্রতারণা' বলে মন্তব্য করেন।
তবে সমালোচকেরা মনে করছেন, বৈশ্বিক জলবায়ু লক্ষ্য পূরণে চীনের পরিকল্পনা যথেষ্ট উচ্চাভিলাষী নয়। গ্রিনপিস ইস্ট এশিয়ার বৈশ্বিক নীতি উপদেষ্টা ইয়াও ঝে বলেন, 'প্রত্যাশা যতই কম রাখা হোক না কেন, আজ যা ঘোষণা করা হলো, তা তবুও যথেষ্ট নয়।'
এ বছর নভেম্বরে ব্রাজিলে বসছে বিশ্বনেতাদের সম্মেলন 'কপ৩০'। তবে এর আগেই নিউইয়র্কে জাতিসংঘের বৈঠক গুরুত্ব পাচ্ছে, কারণ নতুন জলবায়ু পরিকল্পনা জমা দেওয়ার সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে।
প্যারিস জলবায়ু চুক্তি অনুযায়ী, প্রতি পাঁচ বছর পর দেশগুলোকে নতুন প্রতিশ্রুতি দিতে হয়। প্রায় ২০০ দেশ এই চুক্তিতে বৈশ্বিক উষ্ণতা সীমিত রাখার অঙ্গীকার করেছিল। নতুন প্রতিশ্রুতির সময়সীমা ছিল গত ফেব্রুয়ারি, যা ২০৩৫ সাল পর্যন্ত কার্বন নিঃসরণ কমানোর পরিকল্পনা নির্ধারণ করে। অনেক দেশ এখনও সেপ্টেম্বরে শেষ হওয়ার আগেই তা জমা দেওয়ার চেষ্টা করছে।
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বৈঠকের আগে বলেন, এই প্রতিশ্রুতিগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তার ভাষায়, 'দেশগুলোকে এমন পরিকল্পনা দিতে হবে, যাতে পুরো অর্থনীতি ও সব ধরনের গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ অন্তর্ভুক্ত থাকবে এবং যা ১.৫ ডিগ্রি লক্ষ্যর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে।' তিনি আরও সতর্ক করে বলেন, 'আগামী কয়েক বছরে নিঃসরণে বড় ধরনের হ্রাস না ঘটলে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস সীমা রক্ষা করা সম্ভব হবে না।'
চীন বিশ্বের সবচেয়ে বড় দূষণকারী দেশ হওয়ায় বৈশ্বিক জলবায়ু লক্ষ্যে তাদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২০২১ সালে প্রেসিডেন্ট শি ঘোষণা করেছিলেন, এই দশকের মধ্যেই চীনের নিঃসরণ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাবে এবং ২০৬০ সালের মধ্যে দেশটি 'কার্বন নিরপেক্ষতা' অর্জন করবে। সেই পথেই এবার প্রথমবারের মতো নির্দিষ্ট নিঃসরণ কমানোর লক্ষ্য ঘোষণা করল চীন। শি বলেন, 'এগুলো প্যারিস চুক্তির শর্ত অনুযায়ী চীনের সর্বোচ্চ চেষ্টা।'
ঘোষণায় শুধু কার্বন ডাই-অক্সাইড নয়, সব ধরনের গ্রিনহাউস গ্যাসকেই অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। নির্গমনের যে সময় 'সর্বোচ্চ পর্যায়ে' পৌঁছাবে, সেখান থেকে হিসাব শুরু হবে। তবে প্রেসিডেন্ট শি সেই সময় নির্দিষ্ট করে বলেননি। তিনি আরও জানান, চীন—
- ২০২০ সালের তুলনায় ছয় গুণ বেশি বায়ু ও সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন করবে,
- বনভূমির পরিমাণ ২৪ বিলিয়ন ঘনমিটারের বেশি বাড়াবে,
- নতুন গাড়ির বাজারে 'নতুন জ্বালানিচালিত গাড়িকে' প্রধান ধারায় আনবে।
১.৫ ডিগ্রির বাইরে চীন
চীনের নিঃসরণ এত বিপুল যে সামান্য হ্রাস হলেও বৈশ্বিক জলবায়ুতে তার প্রভাব বড় হয়। ২০২৩ সালে একাই তারা বৈশ্বিক উষ্ণায়ন সৃষ্টিকারী গ্যাসের এক চতুর্থাংশেরও বেশি নিঃসরণের জন্য দায়ী ছিল। এর পরিমাণ প্রায় ১৪ বিলিয়ন টন কার্বন ডাই-অক্সাইড সমতুল্য। নিঃসরণ মাত্র ১০ শতাংশ কমলেও তা বছরে ১.৪ বিলিয়ন টন হ্রাস পাবে—যা যুক্তরাজ্যের বার্ষিক নিঃসরণের প্রায় চার গুণ।
তবু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীনের নতুন লক্ষ্য আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ারের প্রধান বিশ্লেষক লাউরি মাইলিভির্তা বলেন, '৩০ শতাংশের কম নিঃসরণ হ্রাস ১.৫ ডিগ্রির লক্ষ্যর সঙ্গে মেলে না।' তার মতে, বৈশ্বিক উষ্ণতা ১.৫ কিংবা অন্তত ২ ডিগ্রির নিচে রাখতে হলে ২০৩৫ সালের মধ্যে চীনের আরও বড় কাটছাঁট করতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে তা ৫০ শতাংশের বেশি হতে হবে।
এতে স্পষ্ট হচ্ছে, জলবায়ু লক্ষ্য পূরণের জন্য যা করা প্রয়োজন ও দেশগুলোর বর্তমান পরিকল্পনার মধ্যে বড় ফারাক রয়ে গেছে।
এর আগে চলতি সপ্তাহে স্টকহোম এনভায়রনমেন্ট ইনস্টিটিউটও সতর্ক করে জানিয়েছে, বিশ্বের সরকারগুলো ২০৩০ সালে যে পরিমাণ জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদনের পরিকল্পনা করছে, তা ১.৫ ডিগ্রি সীমা ধরে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণের দ্বিগুণেরও বেশি।
নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসার
চীন অবশ্য বারবার প্রমাণ করেছে, তারা আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতির চেয়েও বেশি কিছু করতে সক্ষম। উদাহরণস্বরূপ, দেশটি ২০৩০ সালের মধ্যে ১ হাজার ২০০ গিগাওয়াট বায়ু ও সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু ২০২৪ সালেই তারা এই লক্ষ্য ছয় বছর আগে পূরণ করে ফেলেছে।
চায়না ক্লাইমেট হাবের পরিচালক লি শু বলেন, 'এই লক্ষ্যমাত্রাগুলোকে সীমা নয়, বরং ভিত্তি হিসেবে দেখা উচিত।' তার মতে, চীনের দ্রুত পরিচ্ছন্ন প্রযুক্তির বিকাশ আগামী দশকে দেশটিকে আরও অনেক এগিয়ে নেবে।
চ্যাথাম হাউসের সিনিয়র উপদেষ্টা বার্নিস লি বলেন, 'চীনের ২০৩৫ সালের লক্ষ্য দেশটির জ্বালানি পরিবর্তনের গতি সঠিকভাবে প্রকাশ করে না। আরও উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য নিলে চীন আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক প্রশংসা কুড়াতে পারত—যা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বড় পার্থক্য তৈরি করত।'
তবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি বাড়ালেও চীন এখনও ব্যাপকভাবে কয়লার ওপর নির্ভর করছে। গত বছর দেশটির বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লার ব্যবহার নতুন রেকর্ড গড়েছে। যদিও প্রাথমিক তথ্য বলছে, ২০২৫ সালের প্রথমার্ধে সৌরবিদ্যুতের প্রবৃদ্ধির কারণে কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমতে শুরু করেছে।
লি শু আরও বলেন, 'এখন ক্রমবর্ধমান প্রমাণ মিলছে যে চীনের নিঃসরণ স্থিতিশীল হতে শুরু করেছে। চলতি বছরের নিঃসরণ ২০২৪ সালের চেয়ে কম হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।' তিনি নতুন লক্ষ্যকে বর্ণনা করেন 'দ্রুত নিঃসরণ বৃদ্ধির যুগ শেষ করে কার্বন হ্রাসের যুগে প্রবেশ' হিসেবে।