শিম্পাঞ্জিরা দিনে দুই-তিন বোতল বিয়ারের সমান অ্যালকোহল গ্রহণ করে: গবেষণা

শিম্পাঞ্জিরা পাকা ফল খাওয়ার মাধ্যমে প্রতিদিন নিজেদের শরীরের ওজনের তুলনায় অনেক বেশি পরিমাণে অ্যালকোহল গ্রহণ করে। বিজ্ঞান বিষয়ক জার্নাল 'সায়েন্স অ্যাডভান্সেস'-এ বুধবার প্রকাশিত নতুন এক গবেষণায় এমনটাই জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, বার্কলির একদল জীববিজ্ঞানী আফ্রিকার দুটি জাতীয় উদ্যানের জঙ্গল থেকে ২০টি ভিন্ন প্রজাতির গাছের ৫০০টিরও বেশি ফলের নমুনা পরীক্ষা করেছেন। এই উদ্যান দুটি হলো উগান্ডার কিবালে এবং আইভরি কোস্টের তাই। সেখানে দুই ধরনের শিম্পাঞ্জি—পূর্ব শিম্পাঞ্জি (Pan troglodytes schweinfurthii) এবং পশ্চিম শিম্পাঞ্জি (P. t. verus)—প্রতিদিন প্রায় সাড়ে চার কেজি ফল খায়। এই ফলগুলোতে গড়ে ০.৩১% থেকে ০.৩২% ইথানল বা অ্যালকোহল থাকে। এর ফলে, তারা প্রতিদিন ১৩ থেকে ১৫ গ্রাম অ্যালকোহল গ্রহণ করে। পুরুষ ও নারী উভয় শিম্পাঞ্জির জন্য এই পরিমাণটা একজন মানুষের দুই বা তিনটি বিয়ার খাওয়ার সমান।
গবেষকরা বলছেন, এই তথ্যটি 'ড্রাংকের মাংকি হাইপোথিসিস'কে সমর্থন করে। দুই দশকেরও বেশি আগে রবার্ট ডাডলি নামে এক বিজ্ঞানী এই তত্ত্বটি দিয়েছিলেন, যিনি এই নতুন গবেষণারও একজন লেখক। এই তত্ত্ব অনুসারে, অ্যালকোহলের প্রতি মানুষের টানের কারণ বিবর্তনের মধ্যে লুকিয়ে আছে। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে পাকা ফলের স্বাভাবিক গাঁজন প্রক্রিয়ার কারণে মানুষের পূর্বপুরুষরা অল্প পরিমাণে ইথানলের সংস্পর্শে এসেছিল। এর ফলে তাদের শরীরে কিছু শারীরিক পরিবর্তন আসে, যেমন অ্যালকোহল হজম করার জন্য আরও ভালো এনজাইম তৈরি হয়। সেই সাথে তাদের আচরণেও এর প্রতি একটি টান তৈরি হয়।
গবেষণাটি বলছে, প্রাইমেটদের খাদ্যের এই উপাদানটি হয়তো গন্ধের মাধ্যমে একটি সংকেত হিসেবে কাজ করে। অ্যালকোহলের গন্ধ তাদের বোঝায় যে আশেপাশে বেশি শক্তিযুক্ত খাবার আছে। এটি তাদের খাওয়ার ইচ্ছাকেও বাড়িয়ে তুলতে পারে। গবেষকদের মতে, অ্যালকোহলের হালকা প্রভাবের কারণে তারা হয়তো আরও বেশি খাবার খায়।
রবার্ট ডাডলি জোর দিয়ে বলেন যে, শিম্পাঞ্জিরা যা খায় তার ৮৫% হলো পাকা ফল। এই খাদ্যাভ্যাস স্বাভাবিকভাবেই তাদের গাঁজন থেকে তৈরি অ্যালকোহলের সংস্পর্শে আনে। তিনি বলেন, 'প্রথমে আমরা ভেবেছিলাম, তারা যা খায় তার সবকিছুতেই কিছু ইথানল থাকবে, কিন্তু আমরা পরিমাণটা জানতাম না। আমাদের ধারণা ছিল, যদিও প্রতিটি ফলে অল্প পরিমাণে অ্যালকোহল থাকে, কিন্তু তারা এত বেশি ফল খায় যে সারাদিনে তারা আসলে অনেক অ্যালকোহল গ্রহণ করবে।' 'ড্রাংকেন মাংকি হাইপোথিসিস'-এর শুরু হয়েছিল ২০০০ সালে। ডাডলি এখন বলেন, 'আমি অনেক বছর আগেই এই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলাম, কিন্তু আফ্রিকা গিয়ে এই সব গবেষণা করতে আমার অনেক সময় লেগে গেছে।'
বার্কলির এই ইন্টিগ্রেটিভ বায়োলজির অধ্যাপক ব্যাখ্যা করেন যে, এই গবেষণাটি আফ্রিকার রেইনফরেস্টে পাঁচ বছরের একটি প্রকল্পের ফল। সেখানকার জলবায়ু উষ্ণ এবং আর্দ্র হওয়ায় সারা বছর ফল পাওয়া যায়। কিন্তু দলটি লাতিন আমেরিকায় বসবাসকারী প্রাণীদের মধ্যেও সূত্র খুঁজে পেয়েছে। ডাডলি উল্লেখ করেন, 'আমরা পানামায় স্পাইডার মাঙ্কির খাবারের ওপর এই ধরনের পরিমাপ করেছি। আমরা জানি আমেরিকার প্রাইমেটদের ক্ষেত্রেও একই ধরনের ফলাফল পাওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি।'

শিম্পাঞ্জিরা কি মাতাল হয়?
মানুষের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত গাঁজনের প্রথম প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া যায় ৯,০০০ থেকে ১৩,০০০ বছর আগে, যথাক্রমে চীন এবং মধ্যপ্রাচ্যে। প্রাইমেট বিশেষজ্ঞ ফার্নান্দো কোলমেনারসের মতে, এই গবেষণার গুরুত্ব হলো এটি আমাদের প্রজাতির মধ্যে টিকে থাকা একটি আচরণের সাথে এর সংযোগ খুঁজে বের করে। তিনি বলেন, 'প্রবন্ধে যেমন বলা হয়েছে, শিম্পাঞ্জিরা আমাদের সবচেয়ে কাছের জীবিত আত্মীয়, এবং আমি এই কাজটিকে আকর্ষণীয় মনে করি কারণ এটি আমাদের ভাবতে সাহায্য করে যে, মানুষের মধ্যে আজ আমরা যা দেখি তার শুরুটা কীভাবে হয়েছিল।'
বিশেষজ্ঞরা জোর দেন যে, অ্যালকোহল গ্রহণের পরিমাণের সাথে তার শারীরিক ও আচরণগত প্রভাবকে যুক্ত করে দেখাটা জরুরি। শিম্পাঞ্জিদের ইথানল গ্রহণের মাত্রা জানা গেলেও, এটি তাদের আচরণে কীভাবে প্রভাব ফেলে সে সম্পর্কে যথেষ্ট বিস্তারিত তথ্য দেওয়া হয়নি। স্প্যানিশ প্রাইমেটোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা কোলমেনারস উল্লেখ করেন, 'এখনও জানা যায়নি যে এই পরিমাণ অ্যালকোহল তাদের কোনো বিশেষ আচরণ করতে বাধ্য করে কিনা, যেমনটা মানুষের ক্ষেত্রে মদ পান করলে দেখা যায়।'
ডাডলির মতে, শিম্পাঞ্জিদের আচরণে কোনো স্পষ্ট পরিবর্তন না দেখার একটি সহজ কারণ আছে: তারা সবসময় ফলের সাথে অ্যালকোহল গ্রহণ করে। তিনি বলেন, 'তারা একই সাথে খায় এবং পান করে, কিন্তু অ্যালকোহলের ঘনত্ব খুব কম থাকে। ফলে এমন পর্যায়ে পৌঁছানোর আগেই তাদের পেট ভরে যায়, যে পর্যায়ে গেলে একজন মানুষ মাতাল হয়ে পড়ে বা মাতালের মতো আচরণ করে।'
শিম্পাঞ্জিরা কি জেনেশুনে বেশি অ্যালকোহলযুক্ত ফল বেছে নেয়, নাকি তারা কম গাঁজনযুক্ত ফল পছন্দ করে, তা এখনও দেখার বিষয়। তবে, ডাডলির কাছে, মূল উপসংহারটি স্পষ্ট: 'অ্যালকোহল আমাদের উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া খাদ্যেরই একটি অংশ, এবং আমরা এর প্রতি আকৃষ্ট হই কারণ এটি আমাদের শক্তি জোগাতে সাহায্য করে। এটি কেবলই একটি স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া।'