মুরি ব্রিউয়ারি: পাকিস্তানের ১৬৫ বছরের মদ তৈরির ঐতিহ্য থেকে নতুন পথে যাত্রা
বাতাসে ছড়িয়ে থাকা এক তীব্র মল্ট ও ইস্টের গন্ধ জানান দেয় এখানেই চলছে পাকিস্তানের সবচেয়ে পুরনো ও বড় মদ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান মুরি ব্রিউয়ারির কার্যক্রম। ১৮৫৭ সালে ব্রিটিশদের হাত ধরে শুরু হওয়া এই প্রতিষ্ঠান এখন এক নতুন সন্ধিক্ষণে।
একটি ইসলামি রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানে মুসলমানদের জন্য মদ নিষিদ্ধ। শুধু অমুসলিম, যারা দেশটির ২৪ কোটি ১০ লাখ জনসংখ্যার মধ্যে প্রায় ৯০ লাখ, তাদের জন্যই সীমিত অনুমতির ভিত্তিতে অ্যালকোহল বিক্রির সুযোগ আছে।
১৯৭০-এর দশকে পাকিস্তানে মুসলমানদের জন্য মদ নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। সেই নিষেধাজ্ঞা এখনও বহাল।
তবুও মুরি ব্রিউয়ারির ব্যবসা ক্ষতির মুখে পড়েনি এতোকাল। ইতিহাস, সীমিত প্রতিযোগিতা এবং এক ক্ষুদ্র কিন্তু অভিজাত ও অনুগত গ্রাহকশ্রেণিকে ঘিরেই প্রতিষ্ঠানটি লাভজনকভাবে চলেছে।
তবে সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণ, কঠিন কাগজপত্র আর উচ্চ কর এই ব্যবসার ওপর জোর প্রভাব ফেলে।
আর তাই প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ইস্পানিয়ার বান্ধারা ব্রিউয়ারির কার্যক্রমকে এখন অ্যালকোহলের বাইরের জগতে ছড়িয়ে দিতে চাইছেন। বিশেষ করে কোমল পানীয়ের বাজারে এটি করা হচ্ছে, যেটি অনেক বড় হলেও তুলনামূলকভাবে কম লাভজনক এবং বেশি প্রতিযোগিতাপূর্ণ।

"আমার ২২০০ জন কর্মচারীকেও আমি বলি, আমরা কেবল মদ বিক্রি করে বসে থাকতে পারি না," বলেন বান্ধারা, যিনি তার পরিবারের তৃতীয় প্রজন্ম হিসেবে ব্রিটিশ আমলে প্রতিষ্ঠিত এই ১৬৫ বছরের পুরোনো ব্যবসা পরিচালনা করছেন।
"এটা সীমিত বাজার, তাই আমাদের মনোযোগ দিতে হবে নন-অ্যালকোহলিক সেক্টরে। আমি চাই এখানেই নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে, কৃতিত্ব নিতে। 'লিকার ব্যারন' হয়ে নয়।"
ব্রিউয়ারিটি ইতিমধ্যেই এনার্জি ড্রিংক, জুস ও মাল্টেড বেভারেজ উৎপাদন করছে। তবে এই পণ্যগুলো এখনো আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলোর মতো জনপ্রিয় নয়।
তবুও এই অংশে এখন দ্বিগুণ হারে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, আর বান্ধারা আশা করছেন—দেশের তরুণ জনগোষ্ঠী এই বৃদ্ধিকে আরও এগিয়ে নেবে। পাকিস্তানের জনসংখ্যার ৬৪ শতাংশই ৩০ বছরের নিচে।
সরকারের নিয়ন্ত্রণ কতটা?
পাকিস্তান সরকারই নির্ধারণ করে মদের দাম, কোথায় বিক্রি হবে এবং কারা কিনতে পারবে। শুধু গত বছরই কর বাবদ ব্রিউয়ারির আয় থেকে ৩৫ মিলিয়ন ডলার নিয়ে নিয়েছে সরকার। প্রতিষ্ঠানটি দেশের ভেতরে অ্যালকোহলজাত পণ্যের কোনো বিজ্ঞাপন দিতে পারে না, ব্যবসাও বাড়াতে পারে না। এমনকি অনলাইনে অর্ডার দেওয়ার সুযোগও নেই।
একমাত্র রপ্তানির অনুমতি আছে, তবে তা কেবল ওআইসি সদস্য দেশগুলো ছাড়া অন্যত্র।
"মুসলিম দেশগুলোতেও মদ আর বিয়ারের অনেক বড় চাহিদা আছে," বলেন বান্ধারা। "তবু সেসব দেশে আমরা রপ্তানি করতে পারি না।"
এদিকে পাকিস্তানিরা প্রতি বছর অনেক বেশি পরিমাণে কোমল পানীয় ও জুস পান করে—যার বাজার মূল্য কয়েক বিলিয়ন ডলার। পেপসিকো এবং কোকা-কোলার মতো বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো বাজারে আধিপত্য ধরে রেখেছে, যদিও কিছু দেশীয় ব্র্যান্ডও আছে।

"মাল্টিন্যাশনালরা পাকিস্তানে দারুণ ব্যবসা করছে," বলেন বান্ধারা। "লাভ কম হতে পারে, কিন্তু এটা নিরাপদ বাজার।"
মুরি ব্রিউয়ারির মাল্টেড ড্রিংক পণ্যের মোড়ক এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে, যা দেখতে অনেকটা বিয়ারের বোতলের মতো। স্বাদ মন্দ নয়—একটু মিষ্টি আর ইস্ট-ঘেঁষা।
পাকিস্তানে কীভাবে মদ পাওয়া যায়?
পাকিস্তানে মদ এখনো একটি নিষিদ্ধ বস্তু। এমনকি যেসব রান্নার উপকরণে সামান্য অ্যালকোহল থাকে—যেমন রেড ওয়াইন ভিনিগার কিংবা কাশির সিরাপ—তাও পাওয়া কঠিন।
বেশিরভাগ পাঁচতারকা হোটেলে ইন-রুম ডাইনিং মেনুর সঙ্গে গোপনে মদের তালিকা থাকে, আবার কেউ চাইলে মদ ঢেলে দেয়া হয় চা-পাত্রে। কিছু অভিজাত রেস্তোরাঁয় নিজের বোতল নিয়ে যাওয়া যায়, তবে তাদের অন্য গ্রাহকদের থেকে আলাদা করে বসানো হয়। বড় শহরে অনেক সময় জানালাবিহীন, বিশেষ ধরনের বার দেখা যায়।
অমুসলিম নাগরিক ও বিদেশিরা নির্দিষ্ট লাইসেন্সের ভিত্তিতে সীমিত পরিমাণ অ্যালকোহল কিনতে পারেন। কূটনীতিক, উচ্চবিত্ত শ্রেণি এবং প্রভাবশালী পরিবারের সদস্যদের কাছে মদের ভালো সংগ্রহ থাকে, অনেক সময় পুরো একটি ঘর মদের জন্য বরাদ্দ থাকে।
কিছু প্রদেশে অমুসলিমদের পরিচালনায় ওয়াইন শপও আছে, যেখান থেকে কেউ কেউ গাড়িতে বসেই পণ্য সংগ্রহ করেন। হোম ডেলিভারির ব্যবস্থাও রয়েছে।
"বিয়ার কিনতে খুব বেশি খরচ হয় না," বলেন সিন্ধ প্রদেশের ৩০-এর ঘরে থাকা এক মুসলিম, যিনি নিজের নাম শুধু 'ফয়সাল' হিসেবে উল্লেখ করেন। "একটা দেশি বিয়ার ৫০০ রুপি (১.৭৬ ডলার)। ঠাণ্ডা না নিলে ৫০ রুপি বাঁচে।পাকিস্তানে বিয়ার কফির চেয়েও সস্তা," বলেন তিনি।

পাকিস্তানে সরকারি অনুমতি ছাড়া মুসলিমদের মদ্যপান করলে সর্বোচ্চ শাস্তি ৮০ বেত্রাঘাতকরা হয়েছিলো। যদিও ২০০৯ সালে ফেডারেল শরিয়াহ কোর্ট এটিকে অইসলামিক ঘোষণা করে। কেননা ইসলাম ধর্মে একে নিষিদ্ধ বা পাপের কাজ বলা হলেও শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করা হয়নি।
মুরি ব্রিউয়ারির গুদামে এখনো সারি সারি অ্যালকোহলের বাক্স দেখা যায়। সম্প্রতি একদিন বিয়ারের বাক্সগুলো পাঠানো হচ্ছিল লাহোরের পার্ল কনটিনেন্টাল হোটেলে। হুইস্কির বাক্সগুলো যাচ্ছিল সিন্ধে—যেখানে হিন্দু ও পারসি সম্প্রদায়ের বাস বেশি।
বান্ধারা নিজে পারসি সম্প্রদায়ের মানুষ। তিনি ব্রিউয়ারির অ্যালকোহলজাত পণ্যের অন্যতম স্বাদ পরীক্ষক। পাকিস্তানি আইনে কেবল অমুসলিমরাই অ্যালকোহল স্বাদ নিতে পারেন। "আমরা কাউকে নিম্নমানের পানীয় দিতে পারি না," বলেন বান্ধারা। "জার্মান, চাইনিজ এবং ইউরোপীয় দূতাবাস যদি আমার গ্রাহক হয়, তবুও আমি নিশ্চিত, আমাদের মান নিয়ে সমস্যা নেই।"
প্রতিযোগিতা চীনের সাথে
পাকিস্তানে শত শত ডিস্টিলারি ইথানল তৈরি করে, যা রপ্তানির জন্য ব্যবহৃত হয়। কিছু হোম-ব্রুয়ারও রয়েছে, যারা নিজেদের মতো করে মদ তৈরি করে। তবে অনেক সময় এই ঘরোয়া মদে বিষাক্ত মিথানল থাকে, যার কারণে বহু মৃত্যু ঘটেছে।
মুরির সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী এখন চীনা মালিকানাধীন হুই কোস্টাল ব্রিউয়ারি অ্যান্ড ডিস্টিলারি লিমিটেড, যারা ২০২১ সালে বেলুচিস্তানে বিয়ার উৎপাদন শুরু করে, প্রধানত সেখানে থাকা হাজার হাজার চীনা শ্রমিকদের জন্য।
প্রতিষ্ঠানটির কোনো প্রতিনিধি মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে বান্ধারা এই অনুমোদনে বিস্মিত।
"আমার পরিবার বহু বছর আগে পাঞ্জাবে ব্রিউয়ারি করতে চেয়েছিল। তখন বলা হয়েছিল—'মাথা নিচু রাখো, এটা মুসলিম দেশ,'" বলেন তিনি।
"তাহলে ইসলামি আদর্শের বয়ান যদি আমার জন্য হয়, চীনা কোম্পানিকে লাইসেন্স দেওয়া হলো কীভাবে?", আক্ষেপ করেন তিনি,"আমরা মদের ব্যবসা করি বলে সহজেই আমাদের দিকে আঙুল তোলা হয়।"
অনুবাদ : নাফিসা ইসলাম মেঘা