যেসব ক্ষেত্রে অক্সফোর্ড- হার্ভার্ডকে ছাড়িয়ে গেছে লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স

বিশ্বের প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে হার্ভার্ড, অক্সফোর্ড এবং লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স (এলএসই) – উচ্চশিক্ষার সূচকে আলাদা মর্যাদা ধরে রেখেছে যুগের পর যুগ। এই তিন শীর্ষ বিদ্যাপীঠের মধ্যে আবার হার্ভার্ড ও অক্সফোর্ডের বৈশ্বিক ব্রান্ডিং বা পরিচিতি সবচেয়ে বেশি। একইসঙ্গে মানবিক ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞান-সহ বিস্তৃত একাডেমিক প্রোফাইল রয়েছে তাদের। তবু নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে বিশেষত সামাজিক বিজ্ঞান, অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, নীতি ও গণতন্ত্র-বিশ্লেষণ সংক্রান্ত বিষয়গুলো এলএসই'র বাড়তি সামর্থ্যকে যেমন তুলে ধরে, তেমনি অনবদ্যও করে তোলে।
নিচে সেই কারণগুলোর বিশ্লেষণ দেওয়া হলো, যাতে বোঝা যায় কোন পরিস্থিতিতে এবং কেন এলএসই হার্ভার্ড ও অক্সফোর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে।
১) বিশেষায়িত ফোকাস: সামাজিক বিজ্ঞান ও নীতি অধ্যয়ন
লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স (এলএসই) প্রতিষ্ঠাতার শুরুর লক্ষ্য থেকেই রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি, সমাজতত্ত্ব, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং সরকারি নীতি —এইসব বিষয়ের ওপর গভীরভাবে গুরুত্ব দিয়েছে। সামগ্রিক বিশ্ববিদ্যালয়-মডেলগুলো যেখানে বিজ্ঞান, ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিসিন, আর্টস—সবকিছু সামঞ্জস্যে ধরে রাখে, সেখানে এলএসই-র ডিএনএ'তেই রয়েছে সামাজিক বিজ্ঞানকে কেন্দ্র করে গবেষণা, কোর্স ও নেটওয়ার্ক গঠন।
ফলে বিশেষভাবে এই ক্ষেত্রে এলএসই-র রিসার্চ ইমপ্যাক্ট, থিসিস-ডেপথ এবং পলিসি-অ্যাডভাইজরি কাজ অনেক দিন ধরেই স্বীকৃত। কিছু তুলনামূলক বিশ্লেষণে এটিই উঠে এসেছে যে, এলএসই অনুষদের নমুনা নির্বাচনের প্রক্রিয়া ও গবেষণার গভীরতা অনেক ক্ষেত্রে অক্সফোর্ড বা হার্ভার্ডের সমতুল্য বা তাদের চেয়ে সুবিধাজনক হতে পারে, বিশেষ করে নীতিনির্ধারণ এবং গভর্ন্যান্স বিশ্লেষণে।
২) লন্ডনের ভৌগোলিক সুবিধা — বিশ্বনীতির চৌকাঠে এলএসই
লন্ডন হচ্ছে বিশ্বব্যাপী অর্থনীতি, ব্যাংকিং, আন্তর্জাতিক সংস্থা, কূটনীতিক কেন্দ্র ও মিডিয়ার একটি হাব। এলএসই-র অবস্থান সরাসরি এই নেটওয়ার্কে প্রবেশাধিকার দেয়—ছাত্ররা ক্লাস শেষে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, থিঙ্ক ট্যাঙ্ক, বৈশ্বিক এনজিও, আন্তর্জাতিক মিডিয়া এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ইন্টার্নশিপ ও চাকরির সুযোগ পায়।
বাজার ও নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে একাডেমিয়ার নিয়মিত যোগাযোগকে জরুরি মনে করা হয়, সেদিক থেকে লন্ডনের অবস্থান একটি বড় সুবিধা। বিশ্ববিদ্যালয়-নেতৃত্ব, শিল্পখাতগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক ও কর্মজীবন-সহযোগিতায় এই ভূ-অবস্থান অবশ্য হার্ভার্ড বা অক্সফোর্ডের মতো আঞ্চলিক সুবিধা দিতে পারে না। যেমন হার্ভার্ডের জন্য বোস্টন অঞ্চলের আলাদা সুবিধা আছে; কিন্তু লন্ডন বিশ্বের আর্থ-রাজনৈতিক আলোচনায় সরাসরি অংশগ্রহণের দিক থেকে অসামান্য ভূমিকা রাখে, যা নিতে পারে এলএসই।
৩) ক্যারিয়ার ও কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা
অর্থনীতি, ব্যাংকিং, কনসাল্টিং ও পাবলিক পলিসি ক্ষেত্রে লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সের গ্র্যাজুয়েটদের চাহিদা অত্যন্ত উচ্চ। আন্তর্জাতিক ফাইন্যান্স হাব লন্ডনে থাকার কারণে এলএসই-র ছাত্ররা বড় বড় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান– ব্যাংকখাত ও আর্থিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠানে চাকরিলাভে বেশি সফলতা পায়।
উচ্চ শিক্ষাখাতের তুলনামূলক বিশ্লেষণগুলোও বলছে, কিছু পেশাগত ক্ষেত্রে এলএসই-র স্নাতকদের বেতন ও নিয়োগের হার অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক, ফলে পেশাগত উন্নতিও সহজ। এই বাস্তব লাভের আকর্ষণই হার্ভার্ড বা অক্সফোর্ডের সাথে সরাসরি তুলনায় এলএসই-কে এগিয়ে রাখে।
৪) তুলনামূলক ছোট আকার, ঘন-নেটওয়ার্ক ও ত্বরিত এক্সপোজার
এলএসই'র ছাত্রসংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম—এতে ক্লাস সাইজে বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় বেশি আদান-প্রদান হয় ছাত্র ও শিক্ষকের মধ্যে। এই সুবিধার কারণে শিক্ষার্থীরা দ্রুত গবেষক, প্রফেসর ও শিল্প নেতাদের সঙ্গে নিকট সম্পর্ক গড়তে পারে। এটি কেবল পঠন-পাঠনের সুবিধাই দেয় না, ওই শিক্ষার্থী যখন কর্মজীবনে প্রবেশ করেন, সেখানেও অন্য সহকর্মীদের সঙ্গে বড় পার্থক্য গড়ে দেয় তার যোগ্যতার সুবাদে।
ইউনিভার্সিটির সরাসরি নেটওয়ার্কিং বহু ক্ষেত্রে স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি প্রোগ্রামের ছাত্রদের জন্য বড় ঘাটতি পূরণ করে। এটি লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সকে একটি 'কারিকুলাম-প্লাস-নেটওয়ার্ক' অবস্থান দেয়, বিশেষত সামাজিক বিজ্ঞান-নির্ভর ক্যারিয়ারে।
৫) নীতিনির্মাণে সরাসরি প্রভাব — পাবলিক পলিসি ও থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক সংযোগ
হার্ভার্ড ও অক্সফোর্ড ভিভিন্ন দিক থেকে শক্ত—কিন্তু অনেক দেশের নীতিনির্ধারকরা, আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং ইউরোপীয় নীতিমঞ্চে এলএসই'র গবেষণা ও হাইপোথিসিস ব্যাপকভাবে উদ্ধৃত হয়। ফলে কেবল শিল্প বা আর্থিখাতে নয়, সরকারি নীতি প্রস্তাব ও কৌশলগত বিশ্লেষণ তৈরিতে এলএসই'র প্রভাব সরাসরি প্রত্যক্ষ করা যায়। এজন্য যারা নীতিনির্ধারণ বা আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোতে কাজ করতে চান—তাদের জন্য এলএসই'র ডিগ্রী সরাসরি 'প্রবেশপত্র' হিসেবে কাজ করে।
৬) তুলনামূলক খরচ ও পড়াশোনায় বিনিয়োগের সুফল
যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক শিক্ষাবৃত্তি, পাঠগ্রহণের-খরচ ও আবাসন ব্যয় বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভিন্ন। কিন্তু এলএসই'র ছাত্ররা লন্ডন-অবস্থানের সুবাদে উচ্চ আয়ের পেশায় দ্রুত প্রবেশ করে, ফলে তাদের অর্থনৈতিক রিটার্ন তুলনামূলকভাবে দ্রুত আসে। কিছু পেশাগত ক্ষেত্র—বিশেষত ফাইন্যান্স ও কনসাল্টিং এর ক্ষেত্রে এলএসই'র শিক্ষার্থীদের বিনিয়োগের রিটার্ন বেশ প্রতিযোগিতামূলক। অবশ্য এই দিকটি তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দক্ষ অভ্যন্তরীণ নেটওয়ার্ক ও ইন্টার্নশিপ-অফারগুলোর ওপর নির্ভরশীল।
৭) যেসব ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা
সব দিকেই এলএসই সেরা নয়—হার্ভার্ডের মতো বিস্তৃত গ্রেড-রেঞ্জ (রসায়ন, জীববিজ্ঞান, ইঞ্জিনিয়ারিং) এই বিদ্যাপীঠের নেই; অক্সফোর্ডের মতো ঐতিহ্যভিত্তিক কলেজ-জীবনও নেই। গবেষণার বড়-স্কেল ল্যাব বা মেডিক্যাল-স্কুলের সুযোগগুলো এলএসই'তে তেমনভাবে নেই। তাই এলএসই'র শক্তি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রেই — সেটা স্পষ্টতই দেখা যায়।
৮) কাদের জন্য এলএসই সেরা?
দুনিয়ার প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়ের 'কোনটি সেরা'—এ প্রশ্নের একমাত্র উত্তর নেই; বরং প্রশ্ন হওয়া উচিত—"আপনি কোন ক্ষেত্রের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন?"—যদি উত্তর হয়: আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, অর্থনীতি, পাবলিক পলিসি, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন, নাগরিক এবং সামাজিক নীতি—তাহলে এলএসই আপনার জন্য মৌলিক বিচারে সেরা পছন্দ হতে পারে। যদি লক্ষ্য হয় রোগ-চিকিৎসা, ইঞ্জিনিয়ারিং বা বহু-বিষয়ক গবেষণায় সুযোগ—তবে হার্ভার্ড বা অক্সফোর্ড বেশি উপযোগী
ব্র্যান্ড নয়—কোর্স, নেটওয়ার্ক আর ক্যারিয়ার প্রাসঙ্গিকতা গুরত্বপূর্ণ
বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচনে আজকাল শুধুই 'কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বড়' বা 'কোনটার নাম-ডাক'—এসবের চেয়ে বেশি কৌশলগত হওয়া বেশি জরুরি। এলএসই'র শক্তি হলো নির্দিষ্টভাবে সামাজিক ও অর্থনৈতিক শাস্ত্রে তার ঘনিষ্ঠতা, লন্ডনে-অবস্থানের সরাসরি সুবিধা, এবং নীতিনির্ধারণী ও শিল্প-নেটওয়ার্কে সহজে প্রবেশের সুবিধা।এগুলো বিশেষভাবে তাদের জন্য যারা চান নীতি-অধ্যয়ন, কনসাল্টিং বা আন্তর্জাতিক এনজিঅ'তে ক্যারিয়ার গড়তে।
অন্যদিকে, হার্ভার্ড বা অক্সফোর্ডের সামগ্রিক একাডেমিক সমৃদ্ধতা, বৈজ্ঞানিক ল্যাব ও গ্লোবাল ব্র্যান্ডিং-এর মূল্য যাদের দীর্ঘমেয়াদী গবেষণা বা বহুবিধ ক্ষেত্রের জন্য জরুরি—তাদের জন্যে সেই প্রতিষ্ঠানগুলোয় ভর্তি হওয়াটাই সবসময়ই অনুকূল। অর্থাৎ, বিদেশে উচ্চ শিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়ে "কিসের জন্য পড়বেন"—এ প্রশ্নটা সবচেয়ে বেশি ওজন রাখে।