সস্তায় ‘নকল’ ম্যাগনা কার্টা কিনেছিল হার্ভার্ড, ৭০ বছর পর জানা গেল এটাই আসল কপি

একটি বহু পুরনো পাণ্ডুলিপি, যেটিকে এতদিন ধরে কেবল ম্যাগনা কার্টার একটি সাধারণ অনুলিপি মনে করে সংরক্ষণ করে রেখেছিল হার্ভার্ড। ইতিহাসবিদদের পরীক্ষায় দেখা গেল সেটি ১৩০০ সালের ম্যাগনা কার্টার আসল ও দুর্লভ সংস্করণ। তাদের মতে, এটি 'বিশ্বের অন্যতম মূল্যবান দলিল'গুলোর একটি। খবর বিবিসির।
হাভার্ড ল' স্কুল ১৯৪৬ সালে মাত্র ২৭ ডলার ৫০ সেন্টে (তৎকালীন হিসাবে প্রায় ৭ পাউন্ড) দলিলটি কিনে নিয়েছিল। এরপর কয়েক দশক ধরে সেটি লাইব্রেরির সংগ্রহে পড়ে ছিল, তার প্রকৃত পরিচয় কেউ জানত না।
কিন্তু এখন দুজন ইতিহাসবিদ নিশ্চিত করেছেন, এটি ১৩০০ সালের ম্যাগনা কার্টার একটি আসল কপি—যেটি প্রথম রাজা এডওয়ার্ডের সময়ে তৈরি হয়েছিল। এই ধরনের প্রামাণ্য দলিলের বর্তমান বাজারমূল্য কয়েক মিলিয়ন ডলারে দাঁড়াতে পারে বলে ধারণা।
লন্ডনের কিংস কলেজের অধ্যাপক ডেভিড কার্পেন্টার ডিজিটাল চিত্র দেখে গবেষণাটি শুরু করেন। পরে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট থেকে চিত্র দেখে নিশ্চিত হন যে এটি একেবারে আসল দলিল।

তিনি বলেন, 'এটি একটি চমকপ্রদ আবিষ্কার। এটি শুধু কোনো বিবর্ণ ও দাগ পড়া কপি নয়, বরং ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংবিধানিক দলিলগুলোর একটি আসল সংস্করণ—যা অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের স্বাধীনতার অন্যতম ভিত্তি।'
অধ্যাপক কার্পেন্টার জানান, তিনি খুবই অবাক হয়েছেন যে এতদিন কেউ এই দলিলটির প্রকৃত মূল্যায়ন করেননি এবং মাত্র কয়েক ডলারে এটি বিক্রি হয়ে গেছে।
হাভার্ড লাইব্রেরির নথি অনুযায়ী, দলিলটি 'এইচএলএস এমএস ১৭২' নামে ১৯৪৬ সালে কিনে নেওয়া হয়। একটি নিলাম ক্যাটালগে একে উল্লেখ করা হয়েছিল, 'কিছুটা ক্ষয়প্রাপ্ত ও স্যাঁতসেঁতে দাগযুক্ত ১৩২৭ সালের তৈরি একটি কপি।'
সেই সময় ২৭ দশমিক ৫০ ডলার মূল্যের এই দলিলটির বর্তমান মূল্য (মুদ্রাস্ফীতি অনুযায়ী) ২০২৫ সালে প্রায় ৪৫০ ডলার বা ৩৩৯ পাউন্ড।
ম্যাগনা কার্টা প্রথম ১২১৫ সালে রাজা জন কর্তৃক প্রকাশিত হয়, যেখানে জনগণের অধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেওয়া হয় এবং রাজাকে আইনের অধীনে আনা হয়।
মানবাধিকারের ইতিহাসে এটি একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয় এবং বিশ্বের অনেক সংবিধান রচনার অনুপ্রেরণা হিসেবেও কাজ করেছে।
১২১৫ সালের পর ম্যাগনা কার্টার বিভিন্ন সংস্করণ রাজারা পুনরায় প্রকাশ করেন ১৩০০ সাল পর্যন্ত। ইতিহাসবিদ অধ্যাপক নিকোলাস ভিনসেন্টের মতে, সে সময় প্রায় ২০০টি আসল দলিল তৈরি হয়েছিল, যার মধ্যে এখন মাত্র ২৫টি টিকে আছে—বেশিরভাগই যুক্তরাজ্যে সংরক্ষিত।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসির ন্যাশনাল আর্কাইভসে দুটি এবং অস্ট্রেলিয়ার পার্লামেন্ট হাউসে একটি রয়েছে।
অধ্যাপক ভিনসেন্ট বলেন, 'এটি পশ্চিমা রাজনৈতিক ঐতিহ্য এবং সাংবিধানিক আইনের একটি প্রতীক।'
তার ভাষায়, 'আপনি যদি কাউকে জিজ্ঞেস করেন, ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত একটি দলিল কোনটি, তাহলে বেশিরভাগ মানুষই সম্ভবত ম্যাগনা কার্টার নাম বলবেন।'
এই দলিল নিয়ে এক বছর ধরে গবেষণা করেছেন অধ্যাপক ডেভিড কার্পেন্টার ও নিকোলাস ভিনসেন্ট। তাদের ধারণা, এটি ইংল্যান্ডের কাম্ব্রিয়ার অ্যাপলবি শহরের। পরে এটি স্থানীয় লোথার নামের এক জমিদার পরিবার ১৭৮০-এর দশকের প্রখ্যাত দাসপ্রথা-বিরোধী কর্মী থমাস ক্লার্কসনকে এটি উপহার দেন।

পরে ক্লার্কসনের সম্পত্তি উত্তরসূরিদের মাধ্যমে যায় মেইনার্ড পরিবারের হাতে। এরপর ১৯৪৫ সালের শেষদিকে, এভিএম ফস্টার মেইনার্ড দলিলটি লন্ডনের সাদারবিজ নিলামে তোলেন।
একজন লন্ডনভিত্তিক বই ব্যবসায়ী সেটি ৪২ পাউন্ডে কিনে নেন। কয়েক মাস পর হাভার্ড সেটি কিনে নেয় আরও কম দামে।
এর বর্তমান সম্ভাব্য মূল্য নিয়ে অধ্যাপক ভিনসেন্ট বলেন, 'আমি কোনো নির্দিষ্ট সংখ্যা বলতে চাই না। তবে ২০০৭ সালে নিউ ইয়র্কে ১২৯৭ সালের একটি ম্যাগনা কার্টা বিক্রি হয়েছিল ২ কোটি ১০ লাখ ডলারে। কাজেই এটা বলাই যায়, এর মূল্য বিপুল।'
দলিলটির কিছু অংশ অত্যন্ত বিবর্ণ হয়ে পড়েছে, গবেষকরা মূল দলিলটি ব্যবহার না করে অতিবেগুনি রশ্মি ও স্পেকট্রাল ইমেজিংয়ের সাহায্যে তোলা ছবির ভিত্তিতে এর ওপর কাজ করেছেন।
তারা দেখতে পান, এতে ব্যবহৃত হাতের লেখা ও দলিলটির আকার আগে পরিচিত ১৩০০ সালের ছয়টি মূল সংস্করণের সঙ্গে মিলছে।
তারা পাঠ্যাংশও গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেন। কারণ ম্যাগনা কার্টার শব্দচয়ন ও ভাষা সময়ের সঙ্গে বদলেছে—ফলে এর শব্দ ও গঠনের ধরণ ১৩০০ সালের অন্যান্য মূল সংস্করণের সঙ্গে হুবহু মিলতে হবে।
এ পরীক্ষায়ও দলিলটি 'দারুণভাবে উত্তীর্ণ' হয়েছে। অধ্যাপক কার্পেন্টার বলেন, এই লেখার ভাষা এবং গঠনই ছিল প্রমাণের সবচেয়ে বড় ভিত্তি।
গবেষকদের এই অসাধারণ আবিষ্কারের জন্য শুভেচ্ছা জানিয়েছেন হার্ভার্ড ল স্কুলের লাইব্রেরি সার্ভিস বিভাগের সহকারী ডিন, অ্যামান্ডা ওয়াটসন। তিনি বলেন, 'সংগ্রহশালার দরজা মেধাবী গবেষকদের জন্য উন্মুক্ত করে দিলে এমনই গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার সম্ভব হয়।'
তার ভাষ্যে, 'প্রত্যেকটি একাডেমিক আবিষ্কারের পেছনে থাকে গ্রন্থাগারিকদের মৌলিক অবদান। তারা শুধু উপকরণ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করেন না, এমন অনেক পথ তৈরি করেন, যা না হলে গোপনই থেকে যেত।'
অধ্যাপকরা আশা প্রকাশ করেছেন, হার্ভার্ডের এই ম্যাগনা কার্টাটি শিগগিরই জনসাধারণের জন্য প্রদর্শন করা হবে, যাতে দলিলটির গুরুত্ব ও বার্তা আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছায়।