হার্ভার্ডের বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষমতা বাতিল করল ট্রাম্প প্রশাসন

যুক্তরাষ্ট্রের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় হার্ভার্ডের বিরুদ্ধে অবস্থান আরও কঠোর করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। সর্বশেষ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, হার্ভার্ড এখন আর বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে না। খবর বিবিসি'র।
হোমল্যান্ড সিকিউরিটি সচিব ক্রিস্টি নোয়েম বৃহস্পতিবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ লিখেছেন, হার্ভার্ড 'আইনের প্রতি অনুগত না থাকায়' বিশ্ববিদ্যালয়টির 'স্টুডেন্ট অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ ভিজিটর প্রোগ্রাম'-এর (এসইভিপি) স্বীকৃতি বাতিল করা হয়েছে।
তিনি ওই পোস্টে বলেন, 'এটা দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য এক সতর্কবার্তা হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত।'
হার্ভার্ড এক বিবৃতিতে এই পদক্ষেপকে 'আইনবহির্ভূত' বলে উল্লেখ করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়টির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, 'আমরা আমাদের আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী ও গবেষকদের স্বাগত জানাতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, যারা ১৪০টিরও বেশি দেশ থেকে এসেছেন এবং যাদের উপস্থিতি হার্ভার্ড ও পুরো জাতিকে সমৃদ্ধ করে।'
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, 'আমরা দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয় সম্প্রদায়ের সদস্যদের জন্য নির্দেশনা ও সহায়তা দিতে কাজ করছি। এই প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ হার্ভার্ডের ও আমাদের দেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক ও গবেষণা মিশনকে দুর্বল করে।'
এই সিদ্ধান্তে হার্ভার্ডে অধ্যয়নরত হাজার হাজার বিদেশি শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মুখে পড়তে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত শিক্ষাবর্ষে হার্ভার্ডে ৬ হাজার ৭০০-এর বেশি আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী ছিল, যা পুরো শিক্ষার্থী সংখ্যার ২৭ শতাংশ।
বৃহস্পতিবার ক্যাম্পাসজুড়ে এই সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার পর আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের মধ্যে উদ্বেগ ও হতাশা দেখা দেয়।
অস্ট্রেলিয়ান ছাত্রী এবং হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলের 'অস্ট্রেলিয়া অ্যান্ড নিউজিল্যান্ড ককাস'-এর প্রেসিডেন্ট সারাহ ডেভিস বিবিসিকে বলেন, 'আমরা বিষয়টি নিয়ে প্রচণ্ড বিভ্রান্তির মধ্যে আছি।'
তিনি আরও বলেন, 'এই খবর এসেছে এমন এক সময়ে, যখন আমাদের অনেকের স্নাতক শেষ হতে মাত্র পাঁচ দিন বাকি। এটা আমাদের অনেকের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে থাকার এবং কাজ করার ভবিষ্যৎ নিয়ে বড় অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে।'
সারাহ আরও বলেন, 'আমরা এখনো বসে আছি, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে কোনও বার্তা আসে কি না, সেটার অপেক্ষায়।'
সুইডেনের ২২ বছর বয়সী স্নাতক ছাত্র লিও গারডেন মনে করেন, হার্ভার্ডে ভর্তি হওয়ার চিঠি পাওয়ার দিনটিই ছিল তার জীবনের সেরা দিন। এখন, স্নাতক শেষ হওয়ার ঠিক এক সপ্তাহ আগে এসে এমন পরিস্থিতি তিনি কল্পনাও করেননি।
তিনি বলেন, 'হোয়াইট হাউজ ও হার্ভার্ডের মধ্যকার এক রাজনৈতিক খেলায় এক একটা তাস হিসেবে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করা হচ্ছে। এটা খুবই অপমানজনক ও অমানবিক।'
ট্রাম্প প্রশাসন ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে এবং নিউ ইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে নানা শর্তে ছাড় আদায় করেছে।
তবে চলতি বছরের এপ্রিল মাসে এই প্রশাসনের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ জানানো প্রথম বড় প্রতিষ্ঠান হলো হার্ভার্ড। প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাঠানো দীর্ঘ দাবি-দাওয়ার জবাবে হার্ভার্ড তখন জানায়, তারা ট্রাম্প প্রশাসনের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেবে। যদিও হোয়াইট হাউজ পরে জানায়, সেসব দাবি-দাওয়া 'ভুলবশত' পাঠানো হয়েছিল।
মার্কিন সরকার হার্ভার্ডকে নিয়োগ, ভর্তি ও পাঠদান পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনার দাবি জানায়, যাতে ক্যাম্পাসে ইহুদি বিদ্বেষের (অ্যান্টিসেমিটিজম) বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া যায়। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের করমুক্ত সুবিধা প্রত্যাহার এবং সরকার থেকে প্রাপ্ত কয়েক বিলিয়ন ডলারের অনুদান বন্ধ করে দেওয়ার হুমকিও দেওয়া হয়।
হার্ভার্ড জানায়, তারা ইতোমধ্যে ইহুদি বিদ্বেষের বিরুদ্ধে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে এবং সরকারের এসব দাবি বিশ্ববিদ্যালয়ের 'চিন্তাগত পরিবেশে হস্তক্ষেপের অপচেষ্টা'।
তবে তীব্র এই দ্বন্দ্ব আরও প্রকট হয়ে ওঠে।
এরপর দেশটির হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগ হার্ভার্ডকে সতর্ক করে জানায়, প্রশাসনের চাহিদা পূরণ করতে না পারলে তারা বিদেশি শিক্ষার্থী রাখতে পারবে না।
বৃহস্পতিবারের চিঠিতে নোয়েম জানান, প্রশাসনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এসইভিপি প্রোগ্রামে হার্ভার্ডের অংশগ্রহণ বাতিল করা হয়েছে। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়টি ২০২৫-২০২৬ শিক্ষাবর্ষে আর 'এফ' ও 'জে' ভিসাধারী বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করতে পারবে না।
চিঠিতে বলা হয়েছে, হার্ভার্ডকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সরকারের দাবি পূরণ করতে হবে এবং তখন তারা নতুন করে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পেতে পারে।
এসব দাবির মধ্যে রয়েছে—গত পাঁচ বছরে হার্ভার্ডে অধ্যয়নরত সব বিদেশি শিক্ষার্থীর শাস্তিমূলক রেকর্ড জমা দেওয়া। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিদেশি শিক্ষার্থীদের দ্বারা সংঘটিত 'অবৈধ' ও 'বিপজ্জনক বা সহিংস' কর্মকাণ্ডের যেকোনো অডিও, ভিডিও ও ডিজিটাল রেকর্ডও চাওয়া হয়েছে।
ট্রাম্প প্রশাসন এর আগেও আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত ভিসা বাতিলের চেষ্টা চালিয়েছে। যার ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয় এবং একাধিক মামলা-মোকদ্দমা হয়।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিক্ষোভে অংশ নেওয়া কিংবা অতীতে অপরাধমূলক রেকর্ড (যেমন, ট্র্যাফিক আইন ভঙ্গ) থাকা শিক্ষার্থীদের সাথে এই ভিসা বাতিলের ঘটনা দেখা গেছে ।
তবে একই দিনে, ক্যালিফোর্নিয়ার এক ফেডারেল বিচারক যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের ভিসা বাতিলের সিদ্ধান্তে অন্তর্বর্তীকালীন নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন, যতক্ষণ না আদালতে মামলার নিষ্পত্তি হয়।
আন্তর্জাতিক সহপাঠীদের পক্ষে কথা বলতে গিয়ে লিও গারডেন বলেন, 'আমরা এখানে এসেছি কারণ আমেরিকা প্রতিনিধিত্ব করে—মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, অ্যাকাডেমিক স্বাধীনতা এবং এক প্রাণবন্ত বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ। আর এখন ট্রাম্প সেইসব মূল্যবোধের ওপরেই আঘাত হানছেন।'
তিনি বলেন, 'আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের ছাড়া হার্ভার্ড আর হার্ভার্ড থাকে না।'