হৃদরোগ প্রতিরোধের 'কার্যকরী ওষুধ' হতে পারে কলা, যা বলছেন গবেষকরা

হৃদরোগীদের জন্য কলা হতে পারে আশীর্বাদ। নতুন এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় কলা বা অন্যান্য পটাসিয়ামসমৃদ্ধ খাবার যোগ করলে হার্ট ফেইলিউর ও মৃত্যুর ঝুঁকি এক-চতুর্থাংশ পর্যন্ত হ্রাস পেতে পারে।
ডেনমার্কের কোপেনহেগেন ইউনিভার্সিটি হাসপাতালের নেতৃত্বে পরিচালিত এ গবেষণায় ইমপ্ল্যান্টেবল ডিফিব্রিলেটরযুক্ত ১,২০০ রোগীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ছয় মাসের এই পরীক্ষায় দেখা যায়, খাদ্যে পটাসিয়ামের পরিমাণ বাড়ালে অনিয়মিত হৃদস্পন্দন ও হার্ট ফেইলিউরের কারণে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার হার এবং মৃত্যুঝুঁকি ২৪ শতাংশ পর্যন্ত কমে আসে।
মাদ্রিদে অনুষ্ঠিত ইউরোপিয়ান সোসাইটি অব কার্ডিওলজি কংগ্রেসে প্রকাশিত এ গবেষণায় বলা হয়, আধুনিক পশ্চিমা খাদ্যাভ্যাসে লবণের পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে বেশি। প্রক্রিয়াজাত খাবারে লুকিয়ে থাকা সোডিয়াম উচ্চ রক্তচাপের পাশাপাশি হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়। এর বিপরীতে, পটাসিয়াম শরীরে লবণ অপসারণে সহায়তা করে এবং হৃদস্পন্দন স্বাভাবিক রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
গবেষক হেনিং বান্ডগার্ড বলেন, মানুষের প্রাচীন খাদ্যাভ্যাস ছিল পটাসিয়ামসমৃদ্ধ ও সোডিয়াম-স্বল্প। কিন্তু এখন প্রক্রিয়াজাত খাবারের কারণে অনুপাত পুরোপুরি বদলে গেছে, যা হৃদযন্ত্রের জন্য বড় হুমকি।
একটি মাঝারি কলায় থাকে প্রায় ৫০০ মিলিগ্রাম পটাসিয়াম। অর্ধেক বেকড আলুতে প্রায় ৬০০ মিলিগ্রাম এবং এক কাপ কাঁচা পালং শাকে প্রায় ৪৫০ মিলিগ্রাম। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ অনুযায়ী, প্রতিদিন একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের জন্য প্রয়োজন ৩,৪০০ মিলিগ্রাম এবং নারীদের জন্য ২,৬০০ মিলিগ্রাম পটাসিয়াম।
পরীক্ষায় দেখা গেছে, যেসব রোগীকে পটাসিয়ামসমৃদ্ধ খাদ্য, সাপ্লিমেন্ট এবং একটি বিশেষ ওষুধ দেওয়া হয়েছিল, ছয় মাস পর তাদের রক্তে পটাসিয়ামের মাত্রা স্পষ্টভাবে বেড়ে যায়—৪.০১ মিলিমোল প্রতি লিটার থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ৪.৩৬ মিলিমোল প্রতি লিটারে। অন্যদিকে, যাদের খাদ্যে পটাসিয়াম বাড়ানো হয়নি, ছয় মাস পর তাদের গড় মাত্রা ছিল ৪.০৫ মিলিমোল প্রতি লিটার।
বেশি পটাসিয়াম গ্রহণকারীদের অনিয়মিত হৃদস্পন্দনের চিকিৎসার প্রয়োজন তুলনামূলক কম ছিল এবং হার্ট ফেইলিউর কিংবা অনিয়মিত হৃদস্পন্দনের কারণে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার হারও উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়।
তথ্য অনুযায়ী, পটাসিয়ামসমৃদ্ধ খাদ্যাভ্যাসে থাকা রোগীদের মধ্যে মাত্র ৬.৭ শতাংশ অনিয়মিত হৃদস্পন্দনের কারণে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, যেখানে পটাসিয়াম না বাড়ানো গ্রুপে এ সংখ্যা ছিল ১০.৭ শতাংশ। একইভাবে, হার্ট ফেইলিউরের ঘটনা পটাসিয়াম গ্রহণকারীদের মধ্যে ছিল মাত্র ৩.৫ শতাংশ, কিন্তু অপর দলে তা ছিল ৫.৫ শতাংশ।
গবেষণার লেখকরা উপসংহারে বলেছেন, 'পটাসিয়ামের উচ্চ খাদ্য গ্রহণ শুধুমাত্র রোগীদেরই নয়, আমাদের সবারই উপকার করতে পারে। আমাদের সম্ভবত সবারই সোডিয়াম কমিয়ে খাবারে পটাসিয়ামের পরিমাণ বাড়ানো উচিত।'
মাদ্রিদের লা পাজ ইউনিভার্সিটি হাসপাতালের কার্ডিওলজিস্ট হোসে লুইস মেরিনো বলেন, সাপ্লিমেন্টের বদলে প্রাকৃতিক খাবার থেকে পটাসিয়াম পাওয়াই সবচেয়ে নিরাপদ। পালং শাক, মসুর ডাল, বেকড আলু কিংবা কলা—এসব খাবার দারুণ উৎস।
ব্রিটিশ হার্ট ফাউন্ডেশনের পরিচালক এবং কনসালটেন্ট কার্ডিওলজিস্ট ড. সোনিয়া বাবু-নারায়ণ বলেন, 'যদি আপনার ডাক্তার আপনাকে খাদ্যতালিকাগত পটাসিয়াম গ্রহণ বাড়ানোর পরামর্শ দেন, তাহলে আপনি পালং শাক, কলা বা অ্যাভোকাডোর মতো পটাসিয়াম সমৃদ্ধ শাকসবজি ও ফল, সেই সাথে ডাল, মাছ, বাদাম এবং বীজ আপনার খাদ্যে অন্তর্ভুক্ত করে তা করতে পারেন।' তিনি সতর্ক করে বলেন, 'ডাক্তারের তত্ত্বাবধান ছাড়া পরিপূরক দিয়ে পটাসিয়ামের পরিমাণ বাড়ানোর চেষ্টা করবেন না, কারণ পটাসিয়ামের মাত্রা খুব বেশি হলে তা বিপজ্জনক হতে পারে – উদাহরণস্বরূপ, এটি কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট ঘটাতে পারে।'
ড. রাক্সটন পরামর্শ দেন, 'আমরা আরও ফল, সবজি এবং মাছ খেয়ে আমাদের পটাসিয়ামের পরিমাণ বাড়াতে পারি। ফলের রস বিশেষত পটাসিয়াম সমৃদ্ধ। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খাবার হলো পালং শাক, লিমা বিন, বেকড আলু, দই, কলা এবং টুনা।' দুধ, কফি এবং চা-ও পটাসিয়ামের উৎস।
পুষ্টিবিদ ড. কেরি রাক্সটন বলেন, 'লবণ কমানোর বিষয়ে সবাই জানে, কিন্তু স্ট্রোক এবং হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধের জন্য পটাসিয়াম বাড়ানো প্রায় সমান গুরুত্বপূর্ণ তা খুব কম লোকই বোঝে।'
তিনি আরও বলেন, 'এই বছর প্রকাশিত সর্বশেষ ন্যাশনাল ডায়েট অ্যান্ড নিউট্রিশন সার্ভে দেখায় যে, এক-তৃতীয়াংশ কিশোর-কিশোরী এবং এক-চতুর্থাংশ প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি পটাসিয়ামের ঘাটতির ঝুঁকিতে রয়েছে, যার প্রভাব রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ এবং পেশী কার্যকারিতার উপর পড়ে।'