দিনে মাত্র সাত হাজার ধাপ হেঁটেই স্বাস্থ্যঝুঁকি কমানো সম্ভব: গবেষণা
প্রতিদিন সাত হাজার ধাপ হাঁটা মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়াতে এবং বিভিন্ন রোগ থেকে সুরক্ষা দিতে যথেষ্ট হতে পারে বলে একটি গবেষণায় বলা হয়েছে।
বিবিসির প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এটি ১০ হাজার ধাপের তুলনায় একটি বাস্তবসম্মত লক্ষ্য হতে পারে। কারণ সাধারণত দৈনিক হাঁটার মানদণ্ড হিসেবে ১০ হাজার ধাপ হাঁটাকে বিবেচনা করা হয়।
দ্য ল্যানসেট পাবলিক হেলথ-এ প্রকাশিত গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিদিন সাত হাজার ধাপ হাঁটার সঙ্গে ক্যান্সার, ডিমেনেশিয়া এবং হৃদরোগের মতো গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি হ্রাসের সম্পর্ক রয়েছে।
গবেষকরা বলছেন, এই গবেষণার ফলাফল মানুষকে নিজের দৈনিক হাঁটার ধাপ গণনা করতে উৎসাহিত করতে পারে, যা স্বাস্থ্য উন্নয়নের একটি সহজ এবং কার্যকর উপায় হতে পারে।
গবেষণাটির প্রধান ড. মেলোডি ডিং বলেন, "আমাদের মধ্যে এই ধারণা আছে যে প্রতিদিন ১০ হাজার ধাপ হাঁটা উচিত। কিন্তু এর পেছনে বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।"
১০ হাজার ধাপ সাধারণত প্রায় পাঁচ মাইল বা আট কিলোমিটার হয়। তবে এ দূরত্ব সবার জন্য এক নয়—এটি নির্ভর করে হাঁটার গতি, উচ্চতা এবং লিঙ্গের ওপর, কারণ এগুলো প্রতিটি ধাপের দৈর্ঘ্যকে প্রভাবিত করে। সাধারণত যারা দ্রুত হাঁটেন, তাদের ধাপের দৈর্ঘ্য বেশি হয়।
১০ হাজার ধাপের এই সংখ্যাটি মূলত ১৯৬০-এর দশকের জাপানের একটি বিপণন প্রচারণা থেকে এসেছে। ১৯৬৪ সালের টোকিও অলিম্পিকের আগে 'ম্যানপো-কেই' নামের একটি পেডোমিটার বাজারে আনা হয়, যার অর্থ হলো '১০ হাজার ধাপের মিটার'। সেখান থেকেই এই সংখ্যাটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
ড. ডিং বলেন, ১০ হাজার ধাপের এই সংখ্যাটি 'প্রসঙ্গের বাইরে নিয়ে' একটি অপ্রাতিষ্ঠানিক নির্দেশিকায় পরিণত হয়েছে, যা এখনও বহু ফিটনেস ট্র্যাকার এবং অ্যাপ ব্যবহারকারীদের মধ্যে জনপ্রিয়।
দ্য ল্যানসেট-এ প্রকাশিত গবেষণাটি বিশ্বজুড়ে এক লাখ ৬০ হাজারেরও বেশি প্রাপ্তবয়স্কের স্বাস্থ্য ও শারীরিক কার্যকলাপসংক্রান্ত পূর্ববর্তী গবেষণা ও তথ্য বিশ্লেষণ করেছে।
যারা প্রতিদিন মাত্র দুই হাজার ধাপ হাঁটেন, তাদের তুলনায় যারা সাত হাজার ধাপ হাঁটেন, তাদের মধ্যে বিভিন্ন গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। সেগুলো হলো:
হৃদ্রোগ: ২৫% হ্রাস
ক্যান্সার: ৬% হ্রাস
ডিমেনেশিয়া: ৩৮% হ্রাস
ডিপ্রেশন বা হতাশা: ২২% হ্রাস
তবে গবেষকরা সতর্ক করে বলেছেন, কিছু পরিসংখ্যান হয়ত অন্যগুলোর তুলনায় কম নির্ভরযোগ্য হতে পারে, কারণ সেগুলো অল্পসংখ্যক গবেষণার ওপর ভিত্তি করে পাওয়া গেছে।
তবুও, তাদের পর্যালোচনায় দেখা গেছে যে প্রতিদিন প্রায় চার হাজার ধাপ হাঁটার মতো মাঝারি মাত্রার শারীরিক কার্যকলাপও, দিনে মাত্র দুই হাজার ধাপ হাঁটার তুলনায় স্বাস্থ্যগত দিক থেকে বেশি উপকার বয়ে আনে।
গবেষণায় আরও দেখা গেছে, বেশিরভাগ স্বাস্থ্য উপকারিতা সাত হাজার ধাপ পার হওয়ার পর তুলনামূলকভাবে স্থির হয়ে যায়। তবে হৃদ্স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে আরও বেশি হাঁটার অতিরিক্ত সুবিধা পাওয়া যেতে পারে।
'সংখ্যা নয়, গুরুত্বপূর্ণ হলো বাইরে বের হওয়া' — এমনটাই মনে করেন জন স্ট্রাইড, যিনি প্রায়ই প্রতিদিন ১৬ হাজার ধাপ পর্যন্ত হাঁটেন। তিনি বিবিসিকে বলেন, মানুষকে শুধু ধাপের সংখ্যায় মনোযোগ না দিয়ে হাঁটার আসল উপকারিতার দিকেও নজর দেওয়া উচিত।
তিনি বলেন, 'আসলে বিষয়টা হলো বাইরে বের হওয়া, হাঁটাহাঁটি করা—যা আমাদের মানসিক সুস্থতার জন্য উপকারী। এই উপকারিতা অনুভব করা যায়, কিন্তু ধাপ গণনার মতো সহজে পরিমাপ করা যায় না।'
৬৪ বছর বয়সী জন ২০২২ সালে হার্ট অ্যাটাকের পর নিয়মিত হাঁটতে শুরু করেন। এই অভ্যাসের অনুপ্রেরণা তিনি পেয়েছিলেন তার শ্বশুরের কাছ থেকে, যিনি একই বয়সে হার্ট অ্যাটাকের শিকার হয়েছিলেন।
জন স্ট্রাইড ইংল্যান্ডের ডরসেটের একটি গ্রামীণ শহরে বাস করেন এবং প্রতিদিন সকালে প্রায় এক ঘণ্টা হাঁটেন। তিনি মজা করে বলেন, 'আমি একমাত্র ব্যক্তি যে কুকুর ছাড়া হাঁটতে বের হই।'
তিনি বলেন, ফোনে ধাপ গণনা করা শুধু স্বাস্থ্য উপকারিতাই নয়, একটি ভালো চ্যালেঞ্জও তৈরি করে।
তিনি বলেন, 'আপনি যখন একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক ধাপে পৌঁছে যান, তখন মনে হয়—আরও একটু হাঁটতে পারি।'
অধিকাংশ শরীরচর্চার নির্দেশিকা ধাপের সংখ্যা নয়, বরং শারীরিক কার্যকলাপে ব্যয় করা সময়ের ওপর জোর দেয়।
উদাহরণস্বরূপ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিউএইচও) প্রাপ্তবয়স্কদের প্রতি সপ্তাহে অন্তত ১৫০ মিনিটের মাঝারি মাত্রার অ্যারোবিক ব্যায়াম অথবা ৭৫ মিনিটের তীব্র অ্যারোবিক ব্যায়াম করার পরামর্শ দেয়।
ড. মেলোডি ডিং বলেন, এই সময়-ভিত্তিক নির্দেশনাগুলো অনেক সময় মানুষের জন্য বোঝা বা অনুসরণ করা কঠিন হতে পারে। তবে তিনি আরও বলেন, বর্তমান নির্দেশিকাগুলো এখনো জনস্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং মানুষকে নিয়মিত শরীরচর্চায় উৎসাহিত করে।
ড. মেলোডি ডিং ব্যাখ্যা করে বলেন, 'অনেক মানুষ আছেন যারা সাঁতার কাটেন, সাইকেল চালান অথবা শারীরিকভাবে অক্ষম, যাদের পক্ষে ধাপ নেওয়া সম্ভব নয়।'
তবে তিনি বলেন, ধাপসংক্রান্ত একটি পরামর্শ 'অতিরিক্ত নির্দেশনা' হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
ব্রুনেল ইউনিভার্সিটি লন্ডনের স্থির জীবনধারা ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. ড্যানিয়েল বেইলি বলেন, এই গবেষণা সেই 'মিথ' বা ভ্রান্ত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ জানায় যে, ভালো স্বাস্থ্য পেতে হলে প্রতিদিন ১০ হাজার ধাপ হাঁটতেই হবে।
ড. ড্যানিয়েল বেইলি বলেন, যারা তুলনামূলকভাবে বেশি সক্রিয়, তাদের জন্য ১০ হাজার ধাপ হাঁটা উপযুক্ত লক্ষ্য হতে পারে। তবে বেশিরভাগ মানুষের জন্য পাঁচ হাজার থেকে সাত হাজার ধাপ একটি বাস্তবসম্মত ও অর্জনযোগ্য লক্ষ্য।
পোর্টসমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল এক্সারসাইজ ফিজিওলজির সিনিয়র লেকচারার ড. অ্যান্ড্রু স্কটও মনে করেন, সঠিক সংখ্যাটি অতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়।
তিনি বলেন, 'যত বেশি হাঁটা যায়, ততই ভালো।' বিশেষ করে যাদের দিনে শারীরিকভাবে কম সক্রিয় থাকা হয়, তখন নির্দিষ্ট সংখ্যার লক্ষ্য না পূরণ নিয়েও বেশি উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই।
ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের জেনারেল প্র্যাকটিশনার ও অধ্যাপক ড. আজিম মজিদ বলেন, বয়সভিত্তিক বা দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য কম ধাপ হাঁটলেও উপকার পাওয়া সম্ভব।
তিনি বলেন, যদিও হাঁটা সাধারণত একটি সহজ ও স্বল্প প্রচেষ্টার শারীরিক কার্যকলাপ, তবে যাদের হৃদ্রোগ, বাত বা দীর্ঘমেয়াদি ফুসফুসের সমস্যা রয়েছে, তাদের জন্য হাঁটা কঠিন হতে পারে।
তবে তিনি জোর দিয়ে বলেন, বাসার কাজ—যেমন ভ্যাকুয়াম করা বা বাগান করা—এসবও দৈনন্দিন শারীরিক কার্যকলাপের অংশ হতে পারে, যা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।
