হৃদরোগে মৃত্যু কমাতে চিকিৎসা ব্যয় কমানো ও সেবার ব্যপ্তি বাড়ানোর উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার

দেশে মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হৃদরোগ। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যুর হার কমাতে একগুচ্ছ পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার। এসব পদক্ষেপের আওতায় চিকিৎসার খরচ কমানোর পাশাপাশি ঢাকার বাইরে বেশ কিছু জেলায় হৃদরোগের চিকিৎসাসেবার ব্যাপ্তি সম্প্রসারিত করা হবে। উল্লেখ্য, ওইসব জেলায় হৃদরোগের চিকিৎসার জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও অবকাঠামোর তীব্র সংকট রয়েছে।
এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় স্টেন্টের দাম কমানো, নতুন করে কিছু ক্যথেটারাইজেশন ল্যাব (ক্যাথল্যাব) স্থাপন, ইতিমধ্যে স্থাপন করা হলেও চালু হয়নি এমন ক্যাথল্যাব চালু করা, কয়েকটি হাসপাতালে করোনারি কেয়ার ইউনিট (সিসিইউ) চালুর উদ্যোগ নিয়েছে।
এর পাশাপাশি বিভিন্ন হাসপাতালে কার্ডিওলজিস্টের পদ সৃষ্টি, ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরে হৃদরোগ চিকিৎসার ডিভাইসের নিবন্ধন প্রক্রিয়া সহজ ও দ্রুত করার জন্য কাজ করছে সরকার।
গত ১৯ মার্চ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে নিযুক্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ডা. মো. সায়েদুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
গত ২১ জুন ডা. সায়েদুর রহমান টিবিএসকে বলেন, 'কয়েক মাস ধরেই হৃদরোগীদের চিকিৎসার জন্য ভারতে যাওয়ার প্রবণতা কমেছে। দেশের হাসপাতালগুলোই রোগীদের এই বাড়তি চাপ সামাল দিতে সক্ষম হচ্ছে। কোনো হৃদরোগীই চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন না। এখন স্টেন্টের মূল্যও একটি যৌক্তিক পর্যায়ে আনা হবে।'
তিনি আরও বলেন, 'হৃদরোগের চিকিৎসায় কোথায় কী সমস্যা আছে, তা চিহ্নিত করেছি আমরা। ঢাকার বাইরে চিকিৎসাসেবা বাড়ানোর বিষয়ে আমরা অগ্রাধিকার দেয়ার চেষ্টা করব, যাতে রোগীদের ঢাকায় আসতে না হয়।'

সভার কার্যবিবরণীতে বলা হয়েছে, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে আরও একটি ক্যাথলাব স্থাপন করা হবে। এই হাসপাতালে এখন ৭টি ক্যাথল্যাব রয়েছে, কিন্তু সবগুলো সবসময় কার্যকর থাকে না।
ফরিদপুর, টাঙ্গাইল ও মানিকগঞ্জ হাসপাতালে ক্যাথল্যাব স্থাপন করা হলেও ব্যবহার শুরু হয়নি। দ্রুত এসব ক্যাথল্যাব চালু করার লক্ষ্য রয়েছে সরকারের।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দ্রুত একটি করোনারি কেয়ার ইউনিট (সিসিইউ) স্থাপন করা হবে। পাশাপাশি বগুড়া, রাজশাহী ও দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে হৃদরোগের চিকিৎসা সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
এছাড়া ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা ও নেপালে স্টেন্টের গড় মূল্য ও বাংলাদেশের কর কাঠামো পর্যালোচনা করে দেশে স্টেন্টের নতুন দাম নির্ধারণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় সভায়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, বাংলাদেশে মোট মৃত্যুর ৬৭ শতাংশের জন্যই অসংক্রামক রোগ দায়ী, যার মধ্যে প্রায় ৩০ শতাংশ মৃত্যুর কারণ কার্ডিওভাসকুলার রোগ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে দেশে মোট মৃত্যুর ১৭.৪৫ শতাংশই ঘটেছে শুধু হার্ট অ্যাটাকে।
২০২৪ সালে সারা দেশে মোট ৯৮ হাজার ৯০৯টি করোনারি এনজিওগ্রাম, ৩৫ হাজার ৭৩০টি করোনারি এনজিওপ্লাস্টি, ৩ হাজার ৮৯৬টি স্থায়ী পেসমেকার স্থাপন ও ১৪ হাজার ৫৫৪টি কার্ডিয়াক সার্জারি সম্পন্ন হয়েছে।
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের এপিডেমিওলজি অ্যান্ড রিসার্চ বিভাগের প্রধান, অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, 'তামাকের ব্যবহার, স্থূলতা, ট্রান্স ফ্যাট, খাবারে অতিরিক্ত লবণ এবং বায়ু দূষণই হৃদরোগ ও এ-সংক্রান্ত মৃত্যুহার বাড়ার প্রধান কারণ।'
হৃদরোগ চিকিৎসায় বড় বাধা বিশেষজ্ঞ ও অবকাঠামো সংকট
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পর্যাপ্ত অবকাঠামো ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাবে দেশের বিপুলসংখ্যক হৃদরোগী প্রয়োজনীয় চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
কার্ডিয়াক সার্জন সোসাইটি অভ বাংলাদেশের তথ্যমতে, দেশে সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে ৪২টি কার্ডিয়াক কেয়ার ইউনিট রয়েছে, যার মধ্যে ৩২টিতে কার্ডিওভাসকুলার সার্জারি করার ব্যবস্থা আছে। বর্তমানে মাত্র তিনটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে—জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল—কার্ডিয়াক সার্জারি হয়।
সিলেট, রংপুর, খুলনায় ক্যাথল্যাব আছে—সেখানে এনজিওগ্রাম হয়, কিন্তু সার্জারি হয় না। প্রতি বছর দেশে ১০-১২ হাজার কার্ডিয়াক সার্জারি হয়। কিন্তু সার্জারির প্রয়োজন প্রায় ২৫ হাজার।
হৃদরোগের চিকিৎসার জন্য ক্যাথল্যাব অত্যন্ত জরুরি। এ ল্যাবে এনজিওগ্রাম, এনজিওপ্লাস্টি, পেসমেকার বা আইসিডি ইমপ্লান্টেশনসহ বিভিন্ন পরীক্ষা করা হয়। সারা দেশে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ৮৭টি ক্যাথল্যাব রয়েছে। এর মধ্যে রাজধানীতে স্থাপন করা হয়েছে ৫৮টি। দক্ষ জনবলের অভাবে সারা দেশে পড়ে আছে আটটি ক্যাথল্যাব।
ঢাকায়ও অনেক হাসপাতালে ক্যাথল্যাবে যন্ত্র অচল। জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে অকেজো হয়ে পড়ে আছে তিনটি মেশিন। এছাড়া ঢাকা শিশু হাসপাতাল এবং ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম, রংপুর, খুলনা ও রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মেডিগ্রাফিকের সরবরাহ করা আটটি ক্যাথল্যাব মেশিন অকেজো পড়ে আছে।
বাংলাদেশ মেডিকেল ইউনিভার্সিটির (সাবেক বিএসএমএমইউ) কার্ডিওলোজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. ডি এম এম ফারুক ওসমানী বলেন, বাংলাদেশ কার্ডিয়াক সোসাইটির সদস্য প্রায় ৩ হাজার। তাদের অনেকেই আবার পেশায় নেই, দেশের বাইরে আছেন। 'দেশের জনসংখ্যার তুলনায় এই সংখ্যা অত্যন্ত কম। এছাড়া হৃদরোগের ধরন অনুযায়ী চিকিৎসক, বিশেষ করে কার্ডিয়াক সার্জন, শিশু হৃদরোগের চিকিৎসক আরও কম,' বলেন তিনি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শিশুদের হৃদরোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে দেশ এখনও অনেক পিছিয়ে রয়েছে। শিশু হৃদরোগীদের এক-তৃতীয়াংশই চিকিৎসার জন্য বিদেশে যায়।
পেডিয়াট্রিক কার্ডিয়াক সোসাইটি অভ বাংলাদেশের (পিসিএসবি) তথ্যমতে, দেশে প্রায় ৪ লাখ শিশু বিভিন্ন ধরনের হৃদরোগে ভুগছে। প্রতি বছর প্রায় ৫০ হাজার শিশু জন্মগতভাবে হৃদরোগ নিয়ে জন্ম নেয়।
পিসিএসবির তথ্যানুসারে, প্রতি বছর হৃদরোগে আক্রান্ত প্রায় ৪০ শতাংশ শিশু চিকিৎসার অভাবে মারা যায়।
পিসিএসবির সহ-সভাপতি এবং জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের শিশু হৃদরোগ বিভাগের সাবেক প্রধান অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুস সালাম বলেন, দেশে শিশু হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের সংখ্যা ৩০ জনের বেশি নয়। তাদের প্রায় সবাই-ই কেবল ঢাকায় চিকিৎসাসেবা দেন।
জরুরি সেবার অভাবে বাড়ছে মৃত্যুঝুঁকি
হৃদরোগে, বিশেষ করে হার্ট অ্যাটাকের ক্ষেত্রে তাৎক্ষনিক চিকিৎসা খুবই জরুরি। কিন্তু এই জরুরি চিকিৎসা দেশে পর্যাপ্ত নয়। বিশেষ করে ঢাকার বাইরে এই চিকিৎসা খুবই অপ্রতুল। ফলে অনেক রোগীর হার্ট অ্যাটাকের পর দ্রুত চিকিৎসা না পেয়ে ঝুঁকিতে পড়ে যান।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ৪৩টি প্রতিষ্ঠানে হৃদরোগের চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে। এর মধ্যে সার্জারির ব্যবস্থা আছে ৩৪টিতে। এই ৩৪টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র আটটি ঢাকার বাইরে অবস্থিত।
বাংলাদেশের ৯৫ শতাংশ হার্ট সার্জারি ঢাকার প্রতিষ্ঠানগুলো করে থাকে। যেখানে দেশের মাত্র ১০ শতাংশ মানুষের বাস, তাদের জন্য হয় ৯৫ শতাংশ সার্জারি। আর ৯০ শতাংশ মানুষের জন্য মাত্র ৫ ভাগ সার্জারি করা হয়।
ডা. ফারুক ওসমামী বলেন, ইসিজি ও সিরাম ট্রপোনিন পরীক্ষার মাধ্যমে খুব দ্রুত ও স্বল্প খরচে হার্ট অ্যাটাক শনাক্ত করা সম্ভব। তিনি ইউনিয়ন ও উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোকে বড় হাসপাতালগুলোর সঙ্গে অনলাইনে যুক্ত করার পরামর্শ দেন। এতে ইসিজি ও সিরাম ট্রপোনিন পরীক্ষার রিপোর্ট কেন্দ্রীয় সার্ভারের মাধ্যমে অনলাইনে পাঠিয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া যাবে।
স্টেন্টের চড়া দাম কমানোর পরিকল্পনা
পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে হৃদরোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত স্টেন্টের দাম অনেক বেশি। কম দামি স্টেন্টের ক্ষেত্রে এই পার্থক্য খুব বেশি না। কিন্তু এক লাখ টাকার বেশি দামের স্টেন্টের ক্ষেত্রে পার্থক্য অনেক।
বর্তমানে দেশে হৃদরোগের চিকিৎসায় ২৬ ধরনের স্টেন্ট ব্যবহার করা হয়। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর ২০২৪ সালের এপ্রিলে ন্যূনতম ২০ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১ লাখ ৪০ হাজার ৫০০ টাকা দাম নির্ধারণ করে স্টেন্টের। তবে এক লাখ টাকার চেয়ে কম দামের স্টেন্টের ব্যবহার বেশ কম। এক লাখ টাকার বেশি দামের স্টেন্টের ব্যবহার বেশি।
ধমনীতে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে হৃদযন্ত্রের স্বাভাবিক ক্রিয়া সচল রাখতে এনজিওপ্লাস্টির মাধ্যমে স্টেন্ট বা করোনারি স্টেন্ট পরানো হয়। প্রচলিত ভাষায় এটি রিং নামে পরিচিত।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সভার কার্যবিবরণীতে বলা হয়েছে, বর্তমানের তুলনায় অন্তত ৫ হাজার টাকা হলেও দাম কমানোর কথা ভাবছে সরকার। আর সরবরাহ ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে সৃষ্ট দামের পার্থক্যও কমানোর জন্য উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।