বাইরে অবাধ ছোটাছুটি শিশুদের মস্তিষ্কের জন্য আশ্চর্যজনকভাবে উপকারী

কয়েকজন শিশু মিলে একটা মস্ত গাছের গুঁড়ি ঠেলে সরাচ্ছে, তা নিয়ে চলছে তুমুল তর্ক। এদিকে একজন তরতর করে গাছে চড়ে বসলো, ডালে আটকে গেল তার জামা। আরেকজন ডোবার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে কাদার ওপর আঁকছে গুপ্তধনের মানচিত্র। এই ছবিতে কী নেই বলুন তো? নেই বাবা-মায়ের কড়া নজর, 'সাবধান!' বলে চিৎকার, বা শিশুদের ঝগড়া মেটাতে ছুটে আসা।
সোশ্যাল মিডিয়ায় এই বাঁধনছাড়া শৈশবকেই এখন বলা হচ্ছে 'ফিরাল চাইল্ড সামার'। ব্যস্ত রুটিন আর স্ক্রিনের আসক্তি থেকে বেরিয়ে আসতে চাওয়া পরিবারগুলোর কাছে এই ধারণাটা জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এর পেছনে শুধু পুরনো দিনের জন্য মন কেমন করা নেই, আছে বিজ্ঞানও। ২০১৮ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, আমেরিকার শিশুরা তাদের বাবা-মায়েদের তুলনায় ৩৫ শতাংশ কম সময় বাইরে খোলা মনে খেলাধুলা করে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই পরিবর্তনটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই ধরনের বাঁধাধরা নিয়মহীন খেলাধুলা শিশুদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা, আবেগ নিয়ন্ত্রণ এবং সমস্যা সমাধানের মতো দক্ষতা বাড়াতে সাহায্য করে। চলুন জেনে নিই, শিশুদের যখন ইচ্ছেমতো দৌড়ঝাঁপ করার স্বাধীনতা দেওয়া হয়, তখন তাদের মস্তিষ্কের ভেতরে কী ঘটে।
বাইরে ছোটাছুটি করলে মস্তিষ্কের ভেতরে কী ঘটে?
শিশুদের যখন প্রকৃতির মাঝে ছেড়ে দেওয়া হয়—পিচ্ছিল গাছের গুঁড়িতে ভারসাম্য পরীক্ষা করা, খেলার নিয়ম নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে তর্ক করা, বা ছোট ছোট সমস্যার সমাধান করা—তখন বাইরে থেকে বিষয়টা খুব সাধারণ মনে হতে পারে। কিন্তু মস্তিষ্কের জন্য এই মুহূর্তগুলো একটি ট্রেনিং গ্রাউন্ডের মতো।
বিশেষজ্ঞ এলেন বিট স্যান্ডসেটার বলেন, "আমাদের গবেষণা দেখিয়েছে, যে শিশুদের বাইরে খেলার সুযোগ দেওয়া হয়, তারা অনেক বেশি স্বাধীন এবং স্বাবলম্বী হয়ে ওঠে।" তিনি আরও বলেন, এই ধরনের একটু ঝুঁকি নিয়ে খেলাধুলা শিশুদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায় এবং যারা শারীরিক ঝুঁকি নিতে শেখে, তারা অন্য ধরনের ঝুঁকি বিচার করতেও পারদর্শী হয়।
এই ধরনের খেলাধুলা মস্তিষ্কের জন্য একটি ব্যায়ামের মতো। বিশেষজ্ঞ ব্রিজেট ওয়ালশ বলেন, দোল খাওয়া, দৌড়ানো বা লাফানোর মতো কাজগুলো মস্তিষ্কের নিচের অংশকে সক্রিয় করে, যা আবেগ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। একই সাথে, এটি মস্তিষ্কের প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স (সিদ্ধান্ত নেওয়ার কেন্দ্র) এবং হিপ্পোক্যাম্পাসকে (স্থান ও স্মৃতি মনে রাখার অংশ) শক্তিশালী করে।
স্যান্ডসেটার উল্লেখ করেন, এই ধরনের খেলায় শিশুরা প্রায়ই একটি 'ফ্লো স্টেট' বা তন্ময় অবস্থায় চলে যায়। এই অবস্থায় তারা কাজে এতটাই মগ্ন থাকে যে চ্যালেঞ্জগুলো কঠিন মনে হলেও অসম্ভব মনে হয় না। আর এই সময়েই শেখার ক্ষমতা সবচেয়ে বেশি থাকে। গবেষকরা বলছেন, প্রকৃতির মাঝে খেলাধুলা করলে এই উপকারিতাগুলো বহুগুণ বেড়ে যায়।
এই বাঁধভাঙা খেলাধুলা শিশুদের বেড়ে ওঠার জন্য কতটা উপকারী?
বিশেষজ্ঞ লুইস চাওলা বলেন, "প্রকৃতিতে এমন অসংখ্য চ্যালেঞ্জ ও নতুন জিনিস আবিষ্কারের সুযোগ রয়েছে, যা মানুষে তৈরি কোনো কিছু দিতে পারে না।" তিনি আরও বলেন, "প্রকৃতি যেন সারাক্ষণই শিশুদের চ্যালেঞ্জ জানায়— 'পারবে কি এটা করতে?' যেমন, এই পাথরটা কি তুলতে পারব? এই গাছে চড়তে পারব?" শিশুরা বড় হওয়ার সাথে সাথে পুরনো চ্যালেঞ্জগুলো আবার চেষ্টা করে এবং সফল হলে আরও বড় চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে।
চাওলা যোগ করেন, প্রকৃতির মাঝে খেলাধুলা প্রায়ই বেশি সহযোগিতামূলক হয়। কারণ এখানে দল বেঁধে কেল্লা বানানো বা মাটি আর ফুল দিয়ে রান্নার মতো কাজে তারা একজোট হয়। এতে শিশুদের মধ্যে ঝগড়া হলেও, তা মিটিয়ে ফেলার আগ্রহও বেশি থাকে। এর ফলে তাদের মধ্যে যোগাযোগ এবং সহযোগিতার মতো দক্ষতা তৈরি হয়, যা সারাজীবন কাজে লাগে।
খেলাধুলা বা অন্যান্য নিয়মমাফিক কাজের নিজস্ব সুবিধা থাকলেও, শুধুমাত্র সেগুলোর ওপর নির্ভর করলে শিশুরা স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দক্ষতা অর্জন করতে পারে না। এর ফলে, কৈশোরে বা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর যখন বাস্তব জীবন কোনো নিয়ম মেনে চলে না, তখন তারা সমস্যায় পড়তে পারে।
যদিও প্রকৃতির সাথে মেশার কোনো নির্দিষ্ট বয়স নেই, তবে ছোটবেলায় এই দক্ষতাগুলো তৈরি করা সহজ, কারণ তখন মস্তিষ্ক সবচেয়ে বেশি গ্রহণক্ষম থাকে। চাওলা বলেন, "শৈশবের প্রথম বছরগুলোই প্রকৃতির সাথে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।"
স্বাধীন খেলার পথে বাড়ছে বাধা
যেসব দেশকে শিশুবান্ধব বলে মনে করা হয়, সেখানেও অনেক শিশুর বাড়ির কাছাকাছি খেলার মতো নিরাপদ সবুজ জায়গা নেই বলে ইউনিসেফের রিপোর্টে বলা হয়েছে। এছাড়া বাবা-মায়েদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ, ব্যস্ততা বা সুযোগের অভাব তো রয়েছেই। যেসব দেশে চিকিৎসার খরচ আকাশছোঁয়া, সেখানে সামান্য আঘাতের ভয়েও বাবা-মায়েরা শিশুদের ঝুঁকি নিতে দিতে চান না।
যদি কাছাকাছি নিরাপদ জায়গা না থাকে, তাহলে ছোট ছোট উপায়ে এর সমাধান করা যেতে পারে। যেমন, বাড়িতে গাছপালা রাখা, জল বা বালি দিয়ে খেলার ব্যবস্থা করা অথবা শিশুদের পাতা, পালক বা পাইন ফলের মতো প্রাকৃতিক জিনিস সংগ্রহ করতে দেওয়া। এক বাক্স প্রাকৃতিক জিনিসপত্র দিয়ে খুব ছোট জায়গাতেও প্রকৃতির ছোঁয়া দেওয়া সম্ভব। সামান্য প্রকৃতির সান্নিধ্যও কিছু না থাকার চেয়ে অনেক ভালো।
প্রকৃতিতে খেলার সুফল আজীবন
ছোটবেলায় প্রকৃতির সাথে কাটানো সময় আমাদের সারাজীবনের ওপর প্রভাব ফেলে। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, যারা ছোটবেলায় সবুজ পরিবেশে বেশি সময় কাটিয়েছে, প্রাপ্তবয়স্ক বয়সে তাদের মানসিক রোগের ঝুঁকি ৫৫ শতাংশ কম। জাপানের 'ফরেস্ট বাথিং' (অরণ্য স্নান) থেকে শুরু করে নরডিক দেশগুলোর 'ফ্রিলুফৎস্টিভ' (উন্মুক্ত বাতাসে জীবনযাপন)—সব সমাজই স্বীকার করে যে প্রকৃতির মাঝে সময় কাটানো সব বয়সেই মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।
চাওলা বলেন, "প্রকৃতির সাথে খেলাধুলা শুধু শিশুদের জন্যই ভালো নয়, এটি প্রকৃতির নিজের জন্যও ভালো। কারণ শৈশবে যারা প্রকৃতির কাছে আসে, বড় হয়ে তারাই এর যত্ন নিতে শেখে।"