৭২ বছর ধরে দ.কোরিয়ায়, তবু উত্তর কোরিয়ায় ফিরে শেষনিশ্বাস ত্যাগের আর্তি ৯৫ বছর বয়সী যুদ্ধবন্দীর

এই সপ্তাহের শুরুতে এক তপ্ত সকালে ইমজিনগাং স্টেশনে ছিল অস্বাভাবিক ভিড়। স্টেশনটি সিউলের মেট্রো লাইনের শেষ প্রান্তে, উত্তর কোরিয়া সীমান্তের সবচেয়ে কাছাকাছি গিয়ে থেমেছে।
তবে সেখানে উপস্থিত কয়েক ডজন কর্মী ও পুলিশ কর্মকর্তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল একজনের দিকেই: আন হাক-সপ, ৯৫ বছর বয়সী এক সাবেক উত্তর কোরীয় যুদ্ধবন্দী। সীমান্ত পেরিয়ে তিনি নিজের ঘরে ফেরার চেষ্টা করছিলেন।
মি. আন এটিকে অভিহিত করেন তার 'শেষযাত্রা' হিসেবে। তিনি চেয়েছিলেন উত্তরে ফিরে যেতে, যেন সেখানেই তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করতে পারেন। জীবনের বেশিরভাগ সময় তিনি দক্ষিণ কোরিয়ায় কাটিয়েছেন, যার অনেকটাই ছিল তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে।
কিন্তু তার আর সীমান্ত পার হওয়া হলো না। যেমনটি আশঙ্কা করা হচ্ছিল, তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। কারণ, দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার আগেই জানিয়েছিল যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তাদের হাতে যথেষ্ট সময় নেই।
তবে মি. আন যতদূর যাওয়া সম্ভব, ততটাই কাছে গিয়েছিলেন।
ফুসফুসে পানি জমার (পালমোনারি ইডিমা) কারণে দুর্বল হয়ে পড়ায়, স্টেশন থেকে ইউনিফিকেশন ব্রিজ (বা তোংগিল দে-গিও) পর্যন্ত ৩০ মিনিটের হাঁটা পথ পাড়ি দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। এই ব্রিজটিই দক্ষিণ কোরিয়াকে উত্তরের সঙ্গে সংযোগকারী গুটিকয়েক পথের একটি।
তাই ব্রিজ থেকে প্রায় ২০০ মিটার দূরে গাড়ি থেকে নেমে পড়েন তিনি। এরপর দুই সমর্থকের কাঁধে ভর দিয়ে শেষ পথটুকু পায়ে হেঁটে পাড়ি দেন।

ফিরে আসার সময় তার হাতে ছিল উত্তর কোরিয়ার পতাকা; দক্ষিণে যা অত্যন্ত অস্বস্তিকর এক দৃশ্য। এরপর তিনি সেখানে উপস্থিত সাংবাদিক এবং তাকে সমর্থন জানাতে আসা প্রায় ২০ জন স্বেচ্ছাসেবকের উদ্দ্যেশে বক্তব্য দেন।
তিনি বলেন,'আমি শুধু চাই আমার দেহ যেন এক সত্যিকারের স্বাধীন ভূমিতে চিরনিদ্রায় শায়িত হয়।এমন এক ভূমি, যা সাম্রাজ্যবাদ থেকে মুক্ত।'
সীমান্তের ওপারের জীবন
আন হাক-সপ যখন দক্ষিণ কোরীয়দের হাতে ধরা পড়েন, তখন তার বয়স ছিল মাত্র ২৩ বছর।এর তিন বছর আগে, তৎকালীন উত্তর কোরীয় শাসক কিম ইল-সাং দক্ষিণ কোরিয়া আক্রমণ করেন। দুই কোরিয়াকে একত্রিত করতে চাওয়া কিম দেশবাসীকে এই বলে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন যে, ১৯৫০ সালের সেই আক্রমণ দক্ষিণই প্রথম শুরু করেছিল।
আনও সেই কথা বিশ্বাস করেছিলেন। তিনি ১৯৫২ সালে উত্তর কোরিয়ার পিপলস আর্মিতে যোগ দেন এবং এরপর তাকে দক্ষিণাঞ্চলে পাঠানো একটি ইউনিটের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
যুদ্ধবিরতির তিন মাস আগে, ১৯৫৩ সালের এপ্রিলে তিনি ধরা পড়েন এবং ওই বছরই তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। কোরিয়ার স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে বিশেষ ক্ষমার অধীনে ৪২ বছরেরও বেশি সময় পর তিনি মুক্তি পান।
জুলাই মাসে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, তার জীবনটা সহজ ছিল না। সরকারের কাছ থেকে শুরুতে তেমন সাহায্য পাননি, বরং বছরের পর বছর গোয়েন্দারা তার ওপর নজরদারি করেছে।এখানে তিনি বিয়ে করেন, এমনকি একটি সন্তানও দত্তক নেন, কিন্তু কখনোই নিজেকে এখানকার বলে মনে করতে পারেননি।
এই পুরো সময়টা তিনি উত্তরের সীমান্তের সবচেয়ে কাছের গ্রাম জিম্পোতেই বসবাস করেছেন।

অথচ ২০০০ সালে তিনি উত্তরে ফিরে যাওয়ার একটি সুযোগ পেয়েও তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। সে সময় তার মতো আরও কয়েক ডজন বন্দীকে দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তিনি তখন আশাবাদী ছিলেন যে দুই কোরিয়ার সম্পর্ক ভালো হবে এবং মানুষজন অবাধে সীমান্ত পারাপার করতে পারবে।
কিন্তু তিনি দক্ষিণে থাকার সিদ্ধান্ত নেন, কারণ তার আশঙ্কা ছিল, চলে যাওয়াটা আমেরিকানদের কাছে একরকম হার মেনে নেওয়ার শামিল হবে।তিনি বলেন, 'সেই সময় তারা (আমেরিকানরা) দক্ষিণে মার্কিন সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছিল।'
'আমি যদি উত্তরে ফিরে যেতাম, তাহলে মনে হতো আমি যেন নিজের শোবার ঘরটি আমেরিকানদের হাতে তুলে দিচ্ছি, তাদের জন্য জায়গাটা খালি করে দিচ্ছি। একজন মানুষ হিসেবে আমার বিবেক তা কিছুতেই মেনে নিতে পারত না।'
সিউল ও ওয়াশিংটনের মধ্যকার ক্রমবর্ধমান সম্পর্ক ছাড়া তিনি ঠিক কীসের দিকে ইঙ্গিত করছিলেন, তা স্পষ্ট নয়। এই সম্পর্কের মধ্যেই রয়েছে একটি শক্তিশালী সামরিক জোট, যা উত্তর কোরিয়ার যেকোনো আক্রমণ থেকে দক্ষিণ কোরিয়াকে সুরক্ষা দেওয়ার নিশ্চয়তা দেয়।
এই সম্পর্কটি আনকে গভীরভাবে পীড়া দেয়, কারণ তিনি কিম পরিবারের প্রচারণায় বিশ্বাস করা কখনোই ছাড়েননি। সেই প্রচারণা অনুযায়ী, কোরীয় উপদ্বীপের পুনরেকত্রীকরণের পথে একমাত্র বাধা হলো 'সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা' এবং তাদের প্রতি অনুগত দক্ষিণ কোরীয় সরকার।
'মুক্তি নয়, ঔপনিবেশিক শাসনের হাতবদল মাত্র'
কোরীয় উপদ্বীপে জাপানি ঔপনিবেশিক শাসনামলে, ১৯৩০ সালে গিয়ংগি প্রদেশের গাংহোয়া কাউন্টিতে জন্মগ্রহণ করেন আন হাক-সপ। তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট, তার ছোট দুই বোনও ছিল।
শৈশবেই তার মধ্যে দেশপ্রেমের বীজ বপন হয়। স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, তার দাদা তাকে স্কুলে ভর্তি করতে রাজি ছিলেন না, কারণ তিনি নিজের 'নাতিকে জাপানি বানাতে চাননি'। এ কারণে দাদার মৃত্যুর পর স্বাভাবিকের চেয়ে বেশ দেরিতেই তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয়।
১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে জাপান আত্মসমর্পণ করলে এবং কোরিয়ায় তাদের ঔপনিবেশিক শাসনের ইতি ঘটলে, মি. আন এবং জাপানি সেনাবাহিনী থেকে পালিয়ে আসা তার ছোট ভাই গাংহোয়া দ্বীপের মানি পর্বতের পাদদেশে এক আত্মীয়ের বাড়িতে আত্মগোপন করেছিলেন।
তিনি বলেন, 'সেটা কোনও মুক্তি ছিল না, ছিল ঔপনিবেশিক শাসনের হাতবদল মাত্র।'
'একটি প্রচারপত্রে আমরা দেখেছিলাম, সেখানে লেখা ছিল কোরিয়া মুক্ত হচ্ছে না, বরং মার্কিন সামরিক শাসন আরোপ করা হবে। এমনকি এও বলা হয়েছিল, কেউ মার্কিন সামরিক আইন লঙ্ঘন করলে তাকে কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে।'
কোরীয় উপদ্বীপের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছিল, তখন তারা এটিকে বিভক্ত করতে সম্মত হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন উত্তরের এবং যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণের নিয়ন্ত্রণ নেয়, যেখানে তারা ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত একটি সামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করে।
১৯৫০ সালে কিম যখন আক্রমণ করেন, তখন দক্ষিণে একটি সরকার প্রতিষ্ঠিত ছিল। কিন্তু মি. আন, আরও অনেক উত্তর কোরীয়র মতোই, বিশ্বাস করেন যে দক্ষিণই সেই সংঘাতের উসকানি দিয়েছিল এবং ওয়াশিংটনের সঙ্গে তাদের জোটই পুনরেকত্রীকরণ আটকে দিয়েছে।
তবুও বিশ্বাসে অবিচল
ধরা পড়ার পর মি. আনের সামনে কারাবাস এড়ানোর বেশ কয়েকটি সুযোগ এসেছিল। তাকে উত্তর কোরিয়া ও এর সাম্যবাদী ভাবাদর্শ ত্যাগের দলিলে স্বাক্ষর করতে বলা হয়। কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন।
বুধবার সীমান্তের কাছে জড়ো হওয়া জনতার উদ্দেশে তিনি বলেন, 'যেহেতু আমি মতাদর্শ পরিবর্তনের হলফনামায় স্বাক্ষর করতে রাজি হইনি, তাই আমাকে অশেষ অপমান, নির্যাতন ও সহিংসতা সহ্য করতে হয়েছে।সেসব দিনগুলো ছিল লজ্জা আর যন্ত্রণায় ভরা। সেই কষ্ট ভাষায় পুরোপুরি বর্ণনা করা সম্ভব না।'
দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার সরাসরি এই অভিযোগের বিষয়ে কখনও কোনো মন্তব্য করেনি, যদিও ২০০৪ সালে একটি বিশেষ কমিশন কারাগারে সহিংসতার কথা স্বীকার করেছিল। মি. আনের অভিযোগগুলো দক্ষিণ কোরিয়ার 'ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন' (অতীতের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা তদন্তকারী একটি স্বাধীন সংস্থা) ২০০৯ সালে তদন্ত করে।
তদন্তে দেখা যায়, তাকে জোরপূর্বক মত পরিবর্তনে বাধ্য করার জন্য পরিকল্পিত প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল, যার মধ্যে নির্যাতনও অন্তর্ভুক্ত ছিল।দক্ষিণ কোরিয়ায় এ ধরনের বন্দীদের প্রায়শই কারাগারে সহিংসতার শিকার হতে হতো।
স্মৃতিচারণ করে মি. আন বলেন, 'যখনই জ্ঞান ফিরত, আমি প্রথমেই আমার হাত পরীক্ষা করতাম—দেখতাম সেখানে লাল কালির কোনো ছাপ লেগেছে কি না।'
সাধারণত এর মানে ছিল, কেউ জোর করে মতাদর্শ পরিবর্তনের হলফনামায় তার টিপসই নিয়ে নিয়েছে।
'যদি দেখতাম নেই, আমি ভাবতাম, 'ওরা যা-ই করুক না কেন, আমিই জিতেছি।' আর এতেই আমি আত্মতৃপ্তি পেতাম।'
মি. আন যে উত্তর কোরিয়া ছেড়ে এসেছিলেন, সেই দেশটি এরপর আমূল বদলে গেছে। ১৯৫০ সালের তুলনায় দেশটি এখন ধনী হলেও, এটি এখনো বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ। নব্বইয়ের দশকের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সময় মি. আন উত্তরে ছিলেন না, যে দুর্ভিক্ষে লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছিল। আরও হাজার হাজার মানুষ সেখান থেকে জীবন বাঁচাতে ভয়ংকর পথ পাড়ি দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল।
তবে মি. আন উত্তরে কোনো মানবিক সংকটের সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি গণমাধ্যমকে পক্ষপাতদুষ্ট বলে অভিযুক্ত করে বলেন, তারা কেবল দেশটির অন্ধকার দিকটিই তুলে ধরে। তার যুক্তি, উত্তর কোরিয়া উন্নতি করছে এবং ইউক্রেন আক্রমণে রাশিয়াকে সহায়তার জন্য কিমের সেনা পাঠানোর সিদ্ধান্তকেও তিনি সমর্থন করেন।
মি. আন এখানে থাকাকালীন দক্ষিণ কোরিয়াও আমূল বদলে গেছে। একসময়ের দরিদ্র সামরিক একনায়কতন্ত্র থেকে এটি এখন এক ধনী ও শক্তিশালী গণতন্ত্রে পরিণত হয়েছে। উত্তরের সঙ্গে এর সম্পর্কেরও নানা উত্থান-পতন ঘটেছে কিন্তু মি. আনের বিশ্বাসে কোনো পরিবর্তন আসেনি।
জীবনের শেষ ৩০ বছর তিনি এমন একটি দেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে কাটিয়েছেন, যেটিকে তিনি এখনো দক্ষিণ কোরিয়ার ঔপনিবেশিক শাসক বলে মনে করেন—আর সেই দেশটি হলো যুক্তরাষ্ট্র।
জুলাই মাসে বিবিসিকে মি. আন বলেছিলেন, 'লোকে বলে, পশুর সঙ্গে মানুষের পার্থক্য হলো, মানুষের দুই ধরনের জীবন আছে। একটি হলো সাধারণ জৈবিক জীবন—যেখানে আমরা কথা বলি, খাই, ঘুমাই ইত্যাদি। আর দ্বিতীয়টি হলো রাজনৈতিক জীবন, যাকে সামাজিক জীবনও বলা হয়। আপনি যদি একজন মানুষের কাছ থেকে তার রাজনৈতিক জীবন কেড়ে নেন, তাহলে সে একটি রোবটের চেয়ে ভিন্ন কিছু নয়।'
তিনি আরও বলেন, 'আমি এতদিন জাপানি ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে বেঁচেছি। কিন্তু আমি মৃত্যুর পরেও [আমেরিকান] ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে সমাধিস্থ হতে চাই না।'