নোবেলজয়ীদের তৈরি করে কারা, 'আমদানি' করে কোন দেশ? অভিবাসনেই টিকে আছে যে দেশের নোবেল-আধিপত্য
ইতোমধ্যেই চলতি বছরের রসায়ন, চিকিৎসা এবং পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কারগুলো ঘোষণা করা হয়েছে। ডিসেম্বরে স্টকহোমে অনুষ্ঠিতব্য পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন যে নয়জন গবেষক, তাদের মধ্যে ছয়জনই তাদের যুগান্তকারী আবিষ্কারগুলো করেছেন আমেরিকান প্রতিষ্ঠানে।
এই ছয়জনের মধ্যে রয়েছেন একজন ব্রিটিশ, একজন ফরাসি এবং একজন জর্ডানিয়ান বিজ্ঞানী। এই বছরের প্রায় অর্ধেক নোবেল বিজয়ী তাদের পুরস্কার-বিজয়ী গবেষণা কাজগুলো নিজ জন্মভূমির বাইরে সম্পন্ন করেছেন। বিজ্ঞান বরাবরই একটি আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টার ক্ষেত্র, তবে শীর্ষস্থানীয় গবেষকদের মধ্যে অভিবাসীদের সংখ্যা এখন অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি।
সেন্ট গ্যালেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাক্স ভন জেডউইটজ এবং জার্মানির ইবিএস ইউনিভার্সিটি ফর বিজনেস অ্যান্ড ল'র সহকর্মীদের সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, ১৯০১ সালে প্রথম পুরস্কার ঘোষণার পর থেকে প্রায় ৩০ শতাংশ নোবেল বিজয়ী তাদের গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের আগে অভিবাসী হয়েছিলেন।
প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই অভিবাসনের হার কিছুটা কমেছিল, কিন্তু সাম্প্রতিক দশকে এটি আবারও বেড়েছে। ১৯৯০-এর দশক এবং ২০০০-এর দশকের শুরুর দিকে আমেরিকান-বংশোদ্ভূত নোবেল বিজয়ীদের সংখ্যা বেড়েছিল, যারা নিজ দেশেই তাদের কাজ করেছিলেন। তবে এরপর থেকে বিদেশি-বংশোদ্ভূত বিজ্ঞানীদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
এই বৈজ্ঞানিক অভিবাসনের সবচেয়ে বড় 'ক্ষতিগ্রস্ত' দেশ হলো পোল্যান্ড: মেরি কুরি সহ ১৯ জন নোবেল বিজয়ী বর্তমান পোল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেছেন, অথচ তাদের কেউই সেখানে গবেষণার জন্য পুরস্কার পাননি। তবে এই অভিবাসনের প্রধান সুবিধাভোগী নিঃসন্দেহে আমেরিকা। তাদের মাটিতে করা আবিষ্কারের জন্য ৩০৪টি বৈজ্ঞানিক নোবেল পুরস্কার অর্জিত হয়েছে – যা অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় অনেক বেশি।
তবে এই পুরস্কারগুলোর প্রায় ৭০ শতাংশ আমেরিকান-বংশোদ্ভূত বিজ্ঞানীদের কাছে গেছে এবং মাত্র আটজন আমেরিকান বিদেশে কাজ করার জন্য পুরস্কার জিতেছেন। কঠোর অভিবাসন নীতি এবং গবেষণা তহবিলে কাটছাঁট বিশ্বজুড়ে মেধাবীদের এই প্রবাহকে ধীর করে দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
আমেরিকার এই আধিপত্যের একটি কারণ হলো এর বিশাল ভৌগোলিক ও আর্থিক সক্ষমতা। তবে জনসংখ্যার অনুপাতে বিবেচনা করলে, ব্রিটেন, ডেনমার্ক, সুইডেন এবং সুইজারল্যান্ডের মতো ইউরোপীয় দেশগুলিতে পদক বিজয়ীর সংখ্যা বেশি। একইভাবে জনসংখ্যা সমন্বয় করেও জার্মানি, হাঙ্গেরি, নেদারল্যান্ডস এবং নরওয়েতে জন্মগ্রহণকারী গবেষকদের জেতা পুরস্কারের সংখ্যা আমেরিকার চেয়ে বেশি।
নোবেল পুরস্কারগুলো প্রায়শই কয়েক দশক আগে করা আবিষ্কারের জন্য দেওয়া হয়, সমসাময়িক যুগান্তকারী কাজের জন্য নয়। এই বছরের পদার্থবিজ্ঞানের পুরস্কার বিজয়ী ম্যাক্রোস্কোপিক কোয়ান্টাম-মেকানিক্যাল টানেলিং নিয়ে পরীক্ষাগুলি ১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে হয়েছিল। এই সময়গত ব্যবধানটি ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করে যে কেন বিশ্বের পাঁচ বৈজ্ঞানিক শক্তি – আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি এবং সুইজারল্যান্ড থেকে ৮০ শতাংশের বেশি পুরস্কার-বিজয়ী আবিষ্কার আসে।
বিজ্ঞান জগতে চীনের বিশাল কর্মী বাহিনী থাকা সত্ত্বেও, তারা মূল ভূখণ্ডে পরিচালিত গবেষণার জন্য মাত্র একটি নোবেল পুরস্কার জিতেছে (যদিও ছয়জন চীনা-বংশোদ্ভূত বিজয়ী আমেরিকায় গবেষণার জন্য এবং একজন ব্রিটেনে গবেষণার জন্য নোবেল জিতেছেন)। বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা যেহেতু বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত হচ্ছে এবং অন্যান্য দেশগুলি আরও বেশি মেধাবী বিজ্ঞানীদের আকৃষ্ট করছে, তাই আমেরিকার বর্তমান আধিপত্য ভবিষ্যতে হ্রাস পেতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
