দুধ পান করলে কি সত্যিই হাড় মজবুত হয়?

বছরের পর বছর ধরে আমাদের মনে এক বিশ্বাস গেঁথে গেছে—দুধ খেলেই হাড় মজবুত হয়। আমেরিকায় স্কুলের পুষ্টি কর্মসূচি থেকে শুরু করে টিভি বিজ্ঞাপন পর্যন্ত সব জায়গায় এই বার্তা দেওয়া হয়েছে যে দুধ স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের অপরিহার্য অংশ। যুক্তি ছিল সহজ: হাড়ের মূল উপাদান ক্যালসিয়াম, আর এক কাপ ফুল-ক্রিম দুধে থাকে প্রায় ৩০০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম। আর তাই দিনে তিন কাপ দুধ খেলেই হাড় হবে লোহার মতো শক্ত।
কিন্তু হার্ভার্ড টি. এইচ. চান স্কুল অব পাবলিক হেলথ-এর এপিডেমিওলজি ও পুষ্টিবিদ্যার অধ্যাপক ড. ওয়াল্টার উইলেট বলছেন, এই ধারণা গড়ে উঠেছে স্বল্পমেয়াদি গবেষণার ওপর এবং দুগ্ধশিল্পের প্রভাবে। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টিবিজ্ঞানী ড. ক্রিস্টোফার গার্ডনার মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ যেহেতু ল্যাকটোজ হজম করতে পারে না, গরুর দুধ পান করা অপরিহার্য কিছু নয়। হ্যাঁ, ক্যালসিয়াম দরকার, বিশেষ করে কিছু ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠীর জন্য, কিন্তু তার উৎস দুধই হতে হবে এমন কোনো নিয়ম নেই।
ক্যালসিয়াম ও হাড়ের গল্প
ক্যালসিয়াম শুধু হাড়-দাঁতের জন্য নয়, স্নায়ু, পেশি ও হৃদযন্ত্রের কাজেও অপরিহার্য। মার্কিন খাদ্য নির্দেশিকায় প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য দৈনিক ১০০০ থেকে ১২০০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম প্রস্তাব করা হলেও যুক্তরাজ্যের মতো দেশে সুপারিশ মাত্র ৭০০ মিলিগ্রাম। আগের কিছু পরীক্ষায় দেখা গেছে, যাদের ক্যালসিয়াম গ্রহণ কম ছিল, তারা দুধ বা সাপ্লিমেন্টের মাধ্যমে গ্রহণ বাড়ালে হাড়ের ঘনত্ব ৩% পর্যন্ত বেড়েছে। কিন্তু এই উন্নতি ভাঙন বা ফ্র্যাকচার ঠেকানোর জন্য যথেষ্ট নয়, বলেন ড. উইলেট।
তিনি জানান, "আমাদের প্রচুর ক্যালসিয়ামের প্রয়োজন—এ ধারণা আসলে কয়েক সপ্তাহের ক্যালসিয়াম ব্যালান্স নিয়ে করা ছোট গবেষণা থেকে এসেছে।" এমনকি ১৯৯৯ থেকে ২০০৩ সালের মধ্যে প্রকাশিত ৭৯টি দুধ-সম্পর্কিত গবেষণার এক-তৃতীয়াংশই দুগ্ধশিল্পের অর্থায়নে হয়েছিল।
২০২০ সালের এক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, যেসব দেশে সবচেয়ে কম দুধ খাওয়া হয়, সেখানে হিপ ফ্র্যাকচারের হার সবচেয়ে কম। আবার একাধিক গবেষণা বিশ্লেষণে মিলেছে, দুধ বেশি খেলেও ভাঙনের ঝুঁকি কমে না।
জেনেভা বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের হাড়-সংক্রান্ত বিভাগের সাবেক প্রধান ড. রেনে রিজোলি বলেন, দুধ খেলে ফ্র্যাকচার রোধ হয় কি না—এ প্রমাণ পেতে হলে সরাসরি ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল দরকার, যা হয়নি। বরং ব্যায়াম ও সার্বিক খাদ্যাভ্যাসই হাড়ের জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
কাদের বেশি দুধের প্রয়োজন?
বিশেষজ্ঞদের মতে, ৯ থেকে ১৮ বছর বয়সী শিশু-কিশোরদের হাড় গঠনের জন্য সবচেয়ে বেশি ক্যালসিয়াম দরকার। ৫০-এর পর বয়সে হাড়ের ঘনত্ব কমতে থাকে, তাই প্রবীণদেরও চাহিদা বাড়ে। ড. গার্ডনার বলেন, বয়স বাড়লে শরীর খাবার থেকে ক্যালসিয়াম শোষণের ক্ষমতা কমে যায়, তখন শরীর হাড় থেকে ক্যালসিয়াম নিয়ে নেয়, ফলে হাড় দুর্বল হয়।
২০২১ সালে অস্ট্রেলিয়ায় ৭,০০০-এর বেশি প্রবীণদের নিয়ে এক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা দৈনিক ৩.৫ বারের মতো দুগ্ধজাত খাবার খেয়েছেন, তাদের মধ্যে পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি ১১% এবং ভাঙনের ঝুঁকি ৩৩% কমেছে। তবে গবেষকরা নিশ্চিত হতে পারেননি, এটা হাড়ের শক্তির কারণে নাকি অন্য কোনো কারণে হয়েছে।
দুধ নয়, বিকল্পও আছে
নিউইয়র্কের হসপিটাল ফর স্পেশাল সার্জারির পুষ্টি-এপিডেমিওলজিস্ট ড. জেরি নেভেস বলেন, দুধ সহজ ক্যালসিয়াম উৎস হলেও টোফু, কাঁটাওয়ালা মাছ, সবুজ শাকসবজি, ফোর্টিফায়েড জুস বা উদ্ভিজ্জ দুধও ভালো উৎস। তবে ক্যালসিয়ামের জন্য সেরা হতে পারে দই বা চিজের মতো ফারমেন্টেড দুগ্ধপণ্য—যা হজমে সহজ, অন্ত্রের জন্য ভালো, এবং দুধের চেয়ে হাড়ের সুরক্ষায় বেশি কার্যকর বলে গবেষণায় প্রমাণ মিলেছে।
ড. নেভেসের পরামর্শ, "দুধ ভালো লাগে—খান। না লাগলে বা সহ্য না হলে অন্য উৎস বেছে নিন।"