টাকা দিয়ে অফিসে গিয়ে চাকরির ভান! চীনে বেকার তরুণদের মাঝে নতুন ট্রেন্ড

বেতন ছাড়া কাজ করা তো দূরের কথা, উল্টো টাকা দিয়ে কেউ কি অফিসে যেতে চাইবে? অবিশ্বাস্য মনে হলেও, চীনে ঠিক এমনটাই ঘটছে। সেখানে বেকার তরুণ-তরুণীদের মধ্যে টাকা দিয়ে অফিসে গিয়ে চাকরি করার ভান করার এক নতুন চল শুরু হয়েছে। এর ফলে, এই ধরনের সেবা দেওয়া প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও বাড়ছে। খবর বিবিসির।
চীনের মন্থর অর্থনীতি এবং দুর্বল চাকরির বাজারের মধ্যেই এই অদ্ভুত প্রবণতা দেখা দিয়েছে। দেশটিতে তরুণদের বেকারত্বের হার ১৪ শতাংশের বেশি, যা কিছুতেই কমছে না। সত্যিকারের চাকরি পাওয়া যখন কঠিন হয়ে পড়েছে, তখন কিছু তরুণ-তরুণী বাড়িতে বসে না থেকে বরং টাকা দিয়ে অফিসে যেতেই পছন্দ করছেন।
৩০ বছর বয়সী শুই ঝৌ তাদেরই একজন। ২০২৪ সালে তার খাবারের ব্যবসা ব্যর্থ হয়। এরপর এই বছরের এপ্রিলে তিনি 'প্রিটেন্ড টু ওয়ার্ক কোম্পানি' (চাকরির ভান করার প্রতিষ্ঠান) নামের একটি প্রতিষ্ঠানে ভুয়া অফিসে যাওয়ার জন্য প্রতিদিন ৩০ ইউয়ান (প্রায় ৪.২০ ডলার) দিতে শুরু করেন। এই অফিসটি হংকং থেকে ১১৪ কিলোমিটার উত্তরে ডংগুয়ান শহরে অবস্থিত।
সেখানে তিনি আরও পাঁচজন "সহকর্মীর" সঙ্গে যোগ দেন, যারা একই কাজ করছেন।
ঝৌ বলেন, "আমি এখানে খুব খুশি। মনে হয়, আমরা সবাই মিলে একটি দল হিসেবে কাজ করছি।"
এখন শেনজেন, সাংহাই, নানজিং, উহান, চেংদু এবং কুনমিংসহ চীনের বড় বড় শহরগুলোতে এমন 'ভুয়া অফিস' গড়ে উঠছে। এগুলোর বেশিরভাগই দেখতে সত্যিকারের অফিসের মতো, যেখানে কম্পিউটার, ইন্টারনেট, মিটিং রুম এবং চা-কফির সব সুযোগ-সুবিধাই রয়েছে।
এখানে আসা তরুণ-তরুণীরা শুধু বসে থাকেন না, তারা কম্পিউটার ব্যবহার করে নতুন চাকরির সন্ধান করেন অথবা নিজেদের কোনো স্টার্ট-আপ ব্যবসা শুরু করার চেষ্টা করেন। দৈনিক ভাড়া সাধারণত ৩০ থেকে ৫০ ইউয়ানের মধ্যে, যার মধ্যে অনেক সময় দুপুরের খাবার, হালকা নাস্তা এবং পানীয়ও অন্তর্ভুক্ত থাকে।
নিউজিল্যান্ডের ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি অফ ওয়েলিংটনের স্কুল অফ ম্যানেজমেন্টের সিনিয়র লেকচারার ডক্টর ক্রিশ্চিয়ান ইয়াও চীনের অর্থনীতি বিষয়ক একজন বিশেষজ্ঞ।
তিনি বলেন, "এই 'চাকরির ভান' করার বিষয়টি এখন খুব সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থনৈতিক রূপান্তর এবং শিক্ষা ও চাকরির বাজারের মধ্যে অসামঞ্জস্যের কারণে তরুণদের পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে ভাবার জন্য বা অন্তর্বর্তীকালীন ছোটখাটো কাজ করার জন্য এমন জায়গার প্রয়োজন হচ্ছে।" তার মতে, এই ভুয়া অফিসগুলো সেই অন্তর্বর্তীকালীন সমাধানগুলোর মধ্যে একটি।
শুই ঝৌ সামাজিক মাধ্যম 'শাওহংশু' ঘাঁটতে গিয়ে এই 'প্রিটেন্ড টু ওয়ার্ক কোম্পানি'র খোঁজ পান। তিনি মনে করেছিলেন, অফিসের পরিবেশ তার আত্মশৃঙ্খলা বাড়াতে সাহায্য করবে। এখন তিনি তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে সেখানে যাচ্ছেন। ঝৌ তার বাবা-মাকে অফিসের ছবি পাঠিয়েছেন, যা দেখে তার চাকরি না থাকা নিয়ে তাদের দুশ্চিন্তা অনেকটাই কমেছে।
যদিও এখানে যখন খুশি আসা-যাওয়া করা যায়, ঝৌ সাধারণত সকাল ৮টা থেকে ৯টার মধ্যে অফিসে পৌঁছান এবং অনেক সময় রাত ১১টা পর্যন্ত থাকেন। তিনি বলেন, এখানকার অন্য সদস্যরা এখন তার বন্ধুর মতো হয়ে গেছে। যখন কেউ চাকরির খোঁজের মতো কোনো কাজে ব্যস্ত থাকে, তখন তারা কঠোর পরিশ্রম করে। আবার অবসর সময়ে তারা গল্প করে, মজা করে এবং গেম খেলে। প্রায়শই তারা "কাজের পর" একসঙ্গে রাতের খাবারও খায়।
সাংহাইতে, ২৩ বছর বয়সী শাওয়েন তাং এই বছরের শুরুতে এক মাসের জন্য এমন একটি ভুয়া অফিসে একটি ডেস্ক ভাড়া নিয়েছিলেন। গত বছর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হওয়ার পর তিনি এখনো কোনো পূর্ণকালীন চাকরি খুঁজে পাননি। তার বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি অলিখিত নিয়ম আছে যে, স্নাতকের এক বছরের মধ্যে চাকরিতে যোগদানের চুক্তিপত্র বা ইন্টার্নশিপের প্রমাণ দেখাতে হয়; নইলে ডিপ্লোমা আটকে দেওয়া হয়।

তিনি স্কুলের কাছে তার ইন্টার্নশিপের প্রমাণ হিসেবে সেই অফিসের ছবি পাঠান। বাস্তবে, তিনি প্রতিদিন ভাড়া দিয়ে সেই অফিসে বসে অনলাইন উপন্যাস লিখে কিছু পকেট মানি আয় করতেন।
তাং বলেন, "যদি ভান করতেই হয়, তবে শেষ পর্যন্ত করাই ভালো।"
জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর সোশ্যাল অ্যানথ্রোপোলজির পরিচালক ড. বিয়াও শিয়াং বলেন, চাকরির সুযোগের অভাব থেকে জন্ম নেওয়া "হতাশা এবং অসহায়ত্ববোধ" থেকেই চীনে এই চাকরির ভান করার প্রবণতা তৈরি হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, "চাকরির ভান করাটা আসলে একটি খোলস, যা তরুণরা নিজেদের জন্য খুঁজে নিয়েছে। এর মাধ্যমে তারা মূলধারার সমাজ থেকে কিছুটা দূরত্ব তৈরি করে নিজেদের জন্য একটু শ্বাস ফেলার জায়গা করে নিচ্ছে।"
ডংগুয়ান শহরের 'প্রিটেন্ড টু ওয়ার্ক কোম্পানি'র মালিক ৩০ বছর বয়সী ফেইউ (ছদ্মনাম)। তিনি বলেন, "আমি কোনো ডেস্ক বা ওয়ার্কস্টেশন বিক্রি করছি না, আমি বিক্রি করছি একজন অপদার্থ মানুষ হিসেবে গণ্য না হওয়ার মর্যাদা।"
তিনি নিজেও অতীতে বেকারত্বের যন্ত্রণা ভোগ করেছেন। কোভিড মহামারির সময় তার খুচরা ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেলে তিনি বেকার হয়ে পড়েন। সেই সময়ের কথা মনে করে তিনি বলেন, "আমি খুব হতাশ এবং আত্মবিধ্বংসী হয়ে পড়েছিলাম। আপনি পরিস্থিতি বদলাতে চাইতেন, কিন্তু নিরুপায় ছিলেন।"
এই বছরের এপ্রিলে তিনি 'প্রিটেন্ড টু ওয়ার্ক'-এর বিজ্ঞাপন দিতে শুরু করেন এবং এক মাসের মধ্যেই সব ডেস্ক ভাড়া হয়ে যায়। এখন নতুন কেউ যোগ দিতে চাইলে তাকে আবেদন করতে হয়।
ফেইউ জানান, তার গ্রাহকদের ৪০ শতাংশই সদ্য স্নাতক, যারা তাদের সাবেক শিক্ষকদের কাছে ইন্টার্নশিপের অভিজ্ঞতা প্রমাণের জন্য ছবি তুলতে আসেন। অল্প কিছু আসেন বাবা-মায়ের চাপ থেকে বাঁচতে।
বাকি ৬০ শতাংশ হলেন ফ্রিল্যান্সার, যাদের অনেকেই ডিজিটাল নোম্যাড। এদের মধ্যে বড় বড় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের কর্মী এবং অনলাইন লেখকরাও রয়েছেন। গ্রাহকদের গড় বয়স প্রায় ৩০, এবং সবচেয়ে কম বয়সী সদস্যের বয়স ২৫। সরকারিভাবে এই কর্মীদের "নমনীয় কর্মসংস্থানের পেশাজীবী" বলা হয়, যার মধ্যে রাইড-শেয়ারিং চালক এবং ট্রাক ড্রাইভাররাও অন্তর্ভুক্ত।
ফেইউ মনে করেন, দীর্ঘ মেয়াদে এই ব্যবসা লাভজনক থাকবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। তিনি এটিকে ব্যবসার চেয়ে একটি সামাজিক পরীক্ষা হিসেবে দেখতেই বেশি পছন্দ করেন।
তিনি বলেন, "এটি সম্মান বজায় রাখার জন্য মিথ্যার আশ্রয় নেয়, কিন্তু এটি কিছু মানুষকে সত্য খুঁজে পেতে সাহায্য করে। তাদের এই নকল কর্মক্ষেত্রকে একটি বাস্তব সূচনায় রূপান্তরিত করতে সাহায্য করার মাধ্যমেই এই সামাজিক পরীক্ষা তার প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারে।"