চিনি ছাড়লেই উপকার—কয়েক দিনেই বদলে যাবে শরীর

আমাদের অনেকেই জানি, অতিরিক্ত চিনি খাওয়া শরীরের জন্য ক্ষতিকর। স্থূলতা, ফ্যাটি লিভার, টাইপ-২ ডায়াবেটিস, হৃদরোগ ও এমনকি ক্যানসারের মতো রোগের সঙ্গে চিনির অতিরিক্ত সেবনের সম্পর্ক আছে। তাই অনেকেই চিনিকে খারাপ অভ্যাসের তালিকায় রাখেন।
তবে গবেষকরা বলছেন, শুধু ক্ষতি এড়াতেই নয়, চিনি খাওয়া কমালে শরীরে নানা রকম ইতিবাচক পরিবর্তনও দেখা যায়। তাও আবার খুব অল্প সময়েই! ডালাসভিত্তিক পুষ্টিবিদ অ্যামি গুডসন জানিয়েছেন, চিনি কমালে আমাদের মন-মেজাজ ভালো থাকে, ত্বক উজ্জ্বল হয়, দাঁতের স্বাস্থ্য ও মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বাড়ে, এমনকি শরীরচর্চার পারফরম্যান্সও উন্নত হয়।
সব ধরনের চিনি কি ক্ষতিকর?
প্রথমেই বুঝে নেওয়া দরকার, সব চিনিই যে শরীরের জন্য ক্ষতিকর, তা নয়। প্রাকৃতিক ও প্রক্রিয়াজাত চিনি—এই দুই ধরনের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে।
প্রাকৃতিক চিনি হলো যেসব চিনি ফল, দুধ কিংবা শাকসবজিতে নিজ থেকেই থাকে—যেমন: রুটি বা চালের গ্লুকোজ, আমের ফ্রুক্টোজ, দুধের ল্যাক্টোজ। এই চিনিগুলো শুধু শক্তি সরবরাহ করে না, বরং এতে থাকা ভিটামিন, খনিজ ও ফাইবার শরীরের উপকারে আসে।
উদাহরণস্বরূপ, একটি মাঝারি আকারের আমে ২০ গ্রাম প্রাকৃতিক চিনি থাকে, যা বেশ অনেক। তবে একইসঙ্গে এতে থাকে প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, আয়রন, ম্যাগনেশিয়াম, পটাশিয়াম, ভিটামিন 'সি' ও প্রচুর ফাইবার—যা চিনির শোষণ ধীরে ঘটাতে সাহায্য করে, ফলে রক্তে শর্করার হঠাৎ উত্থান কম হয় এবং শরীরে দীর্ঘ সময় শক্তি বজায় থাকে।
প্রক্রিয়াজাত চিনি হলো যেসব চিনি খাবারে প্রক্রিয়াজাতকরণ বা রান্নার সময় যুক্ত করা হয়। এগুলো প্যাকেটজাত খাবারের লেবেলে 'এডেড সুগার' নামে উল্লেখ থাকে। আমেরিকান ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) প্রতিদিন ৫০ গ্রাম যুক্ত চিনি খাওয়ার সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে।
খাদ্যপণ্যের লেবেলে যুক্ত চিনির ২৬০টিরও বেশি নাম থাকে—যেকোনো উপাদান যার নাম "ওজ" (যেমন গ্লুকোজ, ফ্রুক্টোজ) বা "সিরাপ" (যেমন কর্ন সিরাপ) দিয়ে শেষ, তা আসলে চিনি। এগুলো সাধারণত খাবার সংরক্ষণ, গঠন বা স্বাদ বাড়াতে ব্যবহার করা হয়। সমস্যা হলো—এই চিনিগুলোর সঙ্গে প্রায় কোনো ভিটামিন, খনিজ বা ফাইবার থাকে না, যা তাৎপর্যপূর্ণ পুষ্টিগুণ সরবরাহ করতে পারে।
মায়ো ক্লিনিকের পুষ্টিবিদ ক্যাথরিন জেরাটস্কি বলেন, "এই কারণেই যুক্ত চিনিকে বলা হয় 'ফাঁপা ক্যালোরি'—যার মানে হলো, এতে ক্যালোরি আছে, কিন্তু পুষ্টিগুণ নেই।"
যেসব স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়ানো যায়
অতিরিক্ত প্রক্রিয়াজাত বা কৃত্রিম চিনি খাওয়া বা পান করার সঙ্গে বিভিন্ন গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকির সম্পর্ক রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে অটোইমিউন রোগ (যেমন ক্রোনস ডিজিজ ও মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস), রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া, এবং ডজনখানেকের বেশি ধরনের ক্যানসারের ঝুঁকি বৃদ্ধি।
২০২৩ সালে প্রকাশিত 'বিএমসি মেডিসিন'-এর এক গবেষণায় দেখা গেছে, মাত্র ৫ শতাংশ প্রক্রিয়াজাত বা কৃত্রিম চিনি খাবারে যুক্ত হলে হৃদরোগের ঝুঁকি ৬ শতাংশ এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি ১০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যায়।
এই ক্ষতিগুলো আংশিকভাবে ঘটে কারণ অতিরিক্ত খাওয়া চিনি যদি শরীর তাৎক্ষণিকভাবে শক্তি হিসেবে ব্যবহার না করে, তাহলে তা চর্বি হিসেবে জমা হতে থাকে। স্ট্যানফোর্ড হেলথ কেয়ারের ক্লিনিক্যাল ডায়েটিশিয়ান এলেইন হোন জানান, এই অতিরিক্ত চর্বি ওজন বাড়ায়, ইনসুলিন প্রতিরোধক্ষমতা তৈরি করে—যার ফলাফল হতে পারে ডায়াবেটিস, স্থূলতা ও নানা জটিল রোগ।
পুষ্টিবিদ অ্যামি গুডসন আরও বলেন, অতিরিক্ত চিনি লিভারে চর্বি জমা করে, যা পরে লিভারের ক্ষত ও কার্যক্ষমতা কমে যাওয়ার কারণ হতে পারে—এই অবস্থা 'ফ্যাটি লিভার ডিজিজ' নামে পরিচিত।
এছাড়া এ ধরনের চিনি অন্ত্রে থাকা ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াকে খাদ্য জোগায়, যা দীর্ঘমেয়াদি প্রদাহ ও অন্ত্রের জীববৈচিত্র্যে ভারসাম্যহীনতা তৈরি করতে পারে। এসবের সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যের বিভিন্ন সমস্যার যোগসূত্রও খুঁজে পেয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। ম্যাসাচুসেটসভিত্তিক নিউট্রিশনাল সাইকিয়াট্রিস্ট উমা নাইডু বলেন, 'এই অন্ত্রের ভারসাম্যহীনতা মানসিক অসুস্থতার অনেক কারণের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।'
প্রক্রিয়াজাত চিনি কমানো বা বাদ দেওয়া শুধু স্বাস্থ্যঝুঁকি কমায় না—এটি জীবনের মানও উন্নত করে। এর অন্যতম কারণ, কম চিনি খেলে শরীরে 'এডভান্সড গ্লাইক্যাশন এন্ড-প্রডাক্টস' নামক ক্ষতিকর অণুর উৎপাদন কমে। এই অণুগুলো প্রসূত বার্ধক্য ও আলঝেইমার রোগের মতো দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।
নিউ হ্যাম্পশায়ার একাডেমি অব নিউট্রিশন অ্যান্ড ডায়েটেটিকসের প্রেসিডেন্ট এবং পুষ্টিবিদ জেন মেসার বলেন, 'রক্তে অতিরিক্ত চিনি থাকলে তা কোলাজেন বা ইলাস্টিনের মতো লিপিড বা প্রোটিনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ত্বকে বলিরেখা, স্থিতিস্থাপকতা হ্রাস এবং অকাল বার্ধক্য সৃষ্টি করতে পারে।'
এই কারণেই চিনি কম খেলে ত্বকের স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়। পাশাপাশি, আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, চিনি মস্তিষ্ককে অতিরিক্ত উদ্দীপ্ত করে ঘুমের মান নষ্ট করে। আবার রক্তে চিনির মাত্রা দ্রুত পড়ে গেলে মাঝরাতে তৃষ্ণা, খিদে বা বারবার টয়লেটে যাওয়ার কারণে ঘুম ভেঙে যেতে পারে।
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, চিনি মস্তিষ্কে আবেগ নিয়ন্ত্রণকারী রাসায়নিককে ব্যাহত করে। তাই প্রক্রিয়াজাত চিনি কমানো বিষণ্ণতার ঝুঁকি কমায় এবং মানসিক চাপও হ্রাস করে বলে জানান পুষ্টিবিদ এলেইন হোন।
অ্যামি গুডসন বলেন, 'চিনি কম খেলে রক্তে চিনির ওঠানামা কম হয়, ফলে শরীরচর্চার সহনশীলতা বাড়ে।'
সাময়িকভাবে চিনি কমালেও মিলবে উপকার
দীর্ঘমেয়াদে চিনি কমানো সবচেয়ে বেশি উপকারী হলেও, সাময়িকভাবে চিনি কমালেও শরীরে সুফল দেখা যায়। যেমন, কিশোর ও বয়সন্ধিকালের ছেলেদের উপর করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, মাত্র ৮ সপ্তাহের কম-চিনিযুক্ত খাদ্যাভ্যাসে লিভারের কার্যকারিতা বেড়েছে।
হার্ভার্ড পাবলিক হেলথ স্কুলের পুষ্টিবিদ ও অধ্যাপক ওয়াল্টার উইলেট বলেন, 'মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমে যেতে পারে—মাস বা বছরের অপেক্ষা করার দরকার নেই।'
পরীক্ষার আগে চিনি কম খেলে মনের সতর্কতা ও মনোযোগ বাড়ে, কারণ চিনি স্মৃতি গ্রহণকারী রিসেপ্টরকে বাধা দেয়।
স্বল্প সময়ের জন্য চিনি কমানো 'সুগার ক্র্যাশ' বা হঠাৎ শক্তি পতন এড়াতে সাহায্য করে এবং ক্রমাগত চিনি খাওয়ার চাহিদাও কমায়। এর ফলে দীর্ঘমেয়াদে সুস্থ অভ্যাস গড়ে তোলা সহজ হয়, বলেন গুডসন।
কীভাবে চিনির পরিমাণ কমাবেন?
- চিনি মিশ্রিত পানীয় এড়িয়ে চলুন: ২০ আউন্স কোকাকোলায় থাকে ৬৫ গ্রাম চিনি, যা প্রতিদিনের সীমার চেয়েও বেশি।
- খাবারের লেবেল পড়ার অভ্যাস করুন: খাওয়ার সময় চিনির পরিমাণ কত হচ্ছে, তা নজরে রাখুন।
- চিনি বাদ দিয়ে মসলা ব্যবহার করুন: রেসিপিতে ধীরে ধীরে চিনি কমিয়ে দিন এবং তার বদলে দারুচিনি, এলাচ, ভ্যানিলা বা বাদামের নির্যাস ব্যবহার করুন।
পুষ্টিবিদ গুডসন বলেন, 'একটু একটু করে চিনির পরিমাণ কমিয়ে দিলে শরীর ভালো অনুভব করতে শুরু করবে, শক্তি বাড়বে এবং দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটবে।'