বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যু কমার গতি শ্লথ হয়ে পড়েছে, বিশেষজ্ঞদের সতর্কতা
সরকারি তথ্যের বরাত দিয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা গতকাল (২৭ নভেম্বর) সতর্ক করেছেন যে, গত তিন দশকে বাংলাদেশ মাতৃমৃত্যু হ্রাসে উল্লেখযোগ্য সাফল্য পেলেও গত কয়েক বছরে এই অগ্রগতি শ্লথ হয়ে পড়েছে।
দীর্ঘমেয়াদি তথ্য বলছে, আশির দশকের শেষ ভাগ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত মাতৃমৃত্যুর হার দ্রুতগতিতে কমেছিল। কিন্তু এরপর থেকে এই হ্রাসের হার বেশ স্তিমিত।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ধীরগতির পেছনে রয়েছে প্রজনন হার বেড়ে যাওয়া, বাড়িতে সন্তান প্রসবের প্রবণতা, প্রসবপূর্ব সেবা (এএনসি) গ্রহণে অনাগ্রহ, ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভধারণে দেরিতে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া ও শহর-গ্রামের বৈষম্য। মাত্র ৪১ শতাংশ গর্ভবতী নারী প্রশিক্ষিত সেবাকর্মীদের কাছ থেকে অন্তত চারবার চেক-আপ করিয়ে থাকেন।
গতকাল রাজধানীর বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) ভবনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ-এর (ওজিএসবি) সদ্য সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ফারহানা দেওয়ান বলেন, 'আমরা দেখছি, মাতৃমৃত্যুর ৫৪ শতাংশই ঘটে বাড়িতে। আর শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে এই হার অনেক বেশি।'
'ম্যাটার্নাল হেলথ সিচুয়েশন ইন বাংলাদেশে অ্যান্ড পোস্টপার্টাম হেমরেজ, প্রি-একলাম্পসিয়া অ্যান্ড লিডারশিপ ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ' শীর্ষক এই অনুষ্ঠানটি যৌথভাবে আয়োজন করে ওজিএসবি ও বাংলাদেশ হেলথ রিপোর্টার্স ফোরাম।
অনুষ্ঠানে বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘমেয়াদি পরিসংখ্যান তুলে ধরেন। এতে দেখা যায়, বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যু হ্রাসের অগ্রগতি কীভাবে ধীর হয়ে পড়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৯৮৬-১৯৯০ সময়কালে প্রতি ১ লাখ জীবিত জন্মে মাতৃমৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৫৭৪, যা ১৯৯৮-২০০০ সালে কমে ৩২২-এ নেমে আসে। ২০১০ সালে এই সংখ্যা আরও কমে দাঁড়ায় ১৯৪-এ এবং ২০২৩ সালে তা ১৩৬-এ নেমে আসে।
নব্বইয়ের দশকের তুলনায় এটি বড় সাফল্য হলেও, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উন্নতির গতি কমে এসেছে। ১৯৯০-এর দশকে প্রতি ১ লাখ জন্মে মাতৃমৃত্যু কমেছিল ২৫২ জন। পরের দশকে এই হ্রাসের সংখ্যা ছিল ১২৮ জন এবং ২০১০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে তা আরও সংকুচিত হয়ে মাত্র ৫৮ জনে দাঁড়িয়েছে।
উন্নতির এই শ্লথগতির কারণে ২০৩০ সালের মধ্যে প্রতি ১ লাখ জীবিত জন্মে মাতৃমৃত্যুর সংখ্যা ৭০-এ নামিয়ে আনার যে লক্ষ্যমাত্রা জাতিসংঘ নির্ধারণ করেছে, তা অর্জনে বাংলাদেশ ঝুঁকির মুখে পড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই লক্ষ্য অর্জনে দেশকে আরও শক্তিশালী ও ধারাবাহিক পদক্ষেপ নিতে হবে।
অধ্যাপক ফারহানা দেওয়ান তার প্রেজেন্টেশনে উল্লেখ করেন, দেশে প্রজনন হার বেড়েছে, তাই পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম আরও জোরদার করা প্রয়োজন। তিনি বলেন, 'দম্পতিদের পরিবার পরিকল্পনার স্থায়ী পদ্ধতি গ্রহণে উৎসাহিত করতে হবে এবং কিশোর বয়সে সন্তান জন্মদান রোধ করতে হবে।' তিনি আরও জানান, পরিবার পরিকল্পনা সেবা নিতে আগ্রহী, এমন দম্পতিদের মধ্যে প্রায় ১১ শতাংশ এখনো এই সেবার আওতার বাইরে রয়েছেন।
ফারহানা দেওয়ান বলেন, সন্তান প্রসবের ঠিক পরবর্তী সময়টা মায়েদের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। মাতৃমৃত্যুর ৫৫ শতাংশই ঘটে প্রসবের প্রথম ২৪ ঘণ্টার মধ্যে। অথচ অনেক মা সন্তান প্রসবের ৮ ঘণ্টা পার না হতেই হাসপাতাল ছেড়ে চলে যান। এই ধরনের মৃত্যু রোধে প্রসবপূর্ব ও প্রসব-পরবর্তী সেবা জোরদার করা অপরিহার্য বলে উল্লেখ করেন তিনি।
মাতৃমৃত্যু হ্রাসে লক্ষ্যভিত্তিক পদক্ষেপ
মাতৃমৃত্যু কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর, ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অভ গাইনোকোলজি অ্যান্ড অবস্টেট্রিক্স এবং ওজিএসবি যৌথভাবে একটি প্রকল্প পরিচালনা করছে। ফরিদপুরের চারটি জেলা হাসপাতাল ও ঢাকার দুটি অলাভজনক হাসপাতালে এই কার্যক্রম চলছে।
এ প্রকল্পের মূল লক্ষ্য হলো প্রসব-পরবর্তী রক্তক্ষরণ, গর্ভাবস্থায় উচ্চ রক্তচাপজনিত জটিলতা, সময়ের আগেই বা অপরিণত শিশু জন্ম এবং গর্ভকালীন রক্তস্বল্পতার চিকিৎসা নিশ্চিত করা। এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে ২০০টি পিপিএইচ ও একলাম্পসিয়া কিট সরবরাহ করা হয়েছে। পাশাপাশি মায়েদের স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজনীয় সামগ্রী সংরক্ষণের জন্য জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের কেন্দ্রগুলোতে ৪০০টি রেফ্রিজারেটর বিতরণ করা হয়েছে। প্রসব-পরবর্তী রক্তক্ষরণজনিত মৃত্যু রোধে মৌলভীবাজারে নন-নিউম্যাটিক অ্যান্টি-শক গার্মেন্ট (এনএএসজি) ব্যবহারের কর্মসূচিও চলমান রয়েছে।
ওজিএসবির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ড. ফেরদৌসী বেগম বলেন, মাতৃমৃত্যুর প্রধান কারণ এখনো প্রসব-পরবর্তী রক্তক্ষরণ। তিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) হালনাগাদ নির্দেশনা মেনে চলার আহ্বান জানান। এর মধ্যে রয়েছে—অন্তত আটবার প্রসবপূর্ব স্বাস্থ্য পরীক্ষা, রক্তস্বল্পতার চিকিৎসা, আগাম সতর্কবার্তা নির্দেশক চার্ট বা আর্লি ওয়ার্নিং চার্ট ব্যবহার এবং ক্যালিব্রেটেড ড্রেপ বা পরিমাপক পর্দার মাধ্যমে রক্তক্ষরণের পরিমাণ নির্ণয় করা।
তিনি মাত্র ৫ টাকা মূল্যের একটি স্বল্প বাজেটের দেশীয় উদ্ভাবনের কথাও তুলে ধরেন। স্বচ্ছ পলিথিন ব্যাগ দিয়ে তৈরি এই 'ক্যালিব্রেটেড ড্রেপ' ব্যবহার করে প্রসবের পর রক্তক্ষরণের পরিমাণ মাপা যায়, যা দ্রুত চিকিৎসা শুরু করতে সহায়তা করে।
বিশেষজ্ঞরা আরও বলেন, দ্রুত অগ্রগতি অর্জনের জন্য শক্তিশালী নেতৃত্ব, উন্নত টিমওয়ার্ক, জরুরি সেবার মানোন্নয়ন, সঠিক প্রশিক্ষণ ও সরঞ্জাম এবং স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিবিড় পর্যবেক্ষণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
