দেশে চর্মরোগ বাড়ছে, কাজ করছে না অধিকাংশ ওষুধ; কারণ কী?
বাংলাদেশে চর্মরোগের প্রকোপ দ্রুত বাড়ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হেলথ অ্যান্ড মরবিডিটি স্ট্যাটাস সার্ভে (এইচএমএসএস) ২০২৫ অনুযায়ী, প্রতি ১ হাজার জনে মধ্যে গড়ে ৩৭.২৩ জন চর্মরোগে ভোগেন।
শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামাঞ্চালে এই হার আরও বেশি। শহরে যেখানে প্রতি হাজারে আক্রান্তের সংখ্যা ৩৪.৪৬, সেখানে গ্রামে এই হার ৩৯.৯২।
চিকিৎসকরা বলছেন, পরিবেশ দূষণ, অধিক জনবসতির কারণে অপরিচ্ছন্নতা, পুষ্টির ঘাটতি, অ্যান্টিফাঙ্গাল ওষুধের প্রতি শরীরে তৈরি হওয়া প্রতিরোধ ক্ষমতাসহ বিভিন্ন কারণে দেশে চর্মরোগের এই ব্যাপক বিস্তার দেখা যাচ্ছে।
বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য ও চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. শহিদুল্লাহ শিকদার টিবিএসকে বলেন, চর্মরোগ অনেক বাড়ছে। বিশেষ করে দুটি সংক্রামক রোগ—খোসপাঁচড়া ও ছত্রাকজনিত সংক্রমণে চর্মরোগের মোট সংখ্যা বাড়ছে।
তিনি আরও বলেন, এ দুটি রোগের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার অন্যতম সম্ভাব্য কারণ হলো, সচরাচর ব্যবহৃত ওষুধের কার্যকারিতা কমে যাওয়া বা রেজিস্ট্যান্স তৈরি হওয়া। সামগ্রিকভাবে দেশের স্বাস্থ্যবিধির পরিস্থিতি খুব একটা ভালো না। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাবের কারণে সোরিয়াসিস ও একজিমার মতো নানা সংক্রামক রোগ বাড়ছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডার্মাটোলজি বিভাগের আউটডোরে প্রতিদিন ১ হাজার ৫০০-র বেশি রোগী চিকিৎসা নেন।
ঢাকা মেডিকেলের ডার্মাটোলজি বিভাগের জুনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. শারমিন জোয়ার্দার টিবিএসকে বলেন, হাসপাতালে আসা বেশিরভাগ রোগীই খোসপাঁচড়া ও ফাঙ্গাসে আক্রান্ত। এর বাইরে চুল পড়া, মেছতা, শ্বেতীসহ বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে রোগীরা আসেন। ২০২৪ সালের আগে দিনে ১ হাজারের কম রোগী আসত।
বাংলাদেশে অ্যান্টিফাঙ্গাল রেজিস্ট্যান্সের উচ্চ হার
বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডার্মাটোলজি অ্যান্ড ভেনেরিওলজির সহযোগী অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ একাডেমি অভ ডার্মাটোলজির সাধারণ সম্পাদক ডা. সাইফুল ইসলাম ভূঁইয়া টিবিএসকে বলেন, ফাঙ্গাল সংক্রমণ উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে, কারণ জীবাণুর ধরন পাল্টে গেছে।
নিয়ন্ত্রণহীনভাবে অ্যান্টিফাঙ্গাল ও স্টেরয়েড ওষুধ কেনা ও ব্যবহার, ভুল ডোজ ও অসম্পূর্ণ চিকিৎসার কারণে ফাঙ্গাসটি রেজিসস্ট্যান্ট বা প্রতিরোধক্ষম হয়ে উঠছে এবং নতুন স্ট্রেইন তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশ, ভারত ও জার্মানির একট যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, নতুন ধরন ট্রাইকোফাইটন ইন্দোতিনি সাধারণ অ্যান্টিফাঙ্গাল ওষুধের ডোজে ভালো হয় না। স্টেরয়েডযুক্ত ক্রিম, স্টেরয়ে-অ্যান্টিফাঙ্গাল মিশ্রিত ওষুধের অপ্রয়োজনীয় ব্যবহারের ফলে ফাঙ্গাস আরও রেজিসস্ট্যান্ট হয়ে পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে।
সাইফুল ইসলাম আরও বলেন, তাদের যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে প্রায় ৯০ শতাংশ ফাঙ্গাল সংক্রমণই এই নতুন স্ট্রেন দ্বারা হচ্ছে। ফলে প্রচলিত ডোজে বেশিরভাগ অ্যান্টিফাঙ্গাল ওষুধ কাজ করছে না।
'আ নিউ কোলাবোরেটিভ ট্রাইকোফাইটন মেন্টাগ্রোফাইটস আইটিএস জেনোটাইপ ৮/ট্রাইকোফাইটন ইন্দোতিনি ইনফেকশন অ্যান্ড অ্যান্টিফাঙ্গাল রেজিস্ট্যান্স ইন বাংলাদেশ' শীর্ষক এ গবেষণায় নিশ্চিত করা হয়েছে, টি. মেন্টাগ্রোফাইটস আইটিএস জেনোটাইপ ৮—যা টি. ইন্দোতিনি পরিচিত—সংক্রমণটি বর্তমানে একটি জনস্বাস্থ্য সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা বিশ্বব্যাপী প্রভাব ফেলতে পারে।
বাংলাদেশে সংগৃহীত নমুনাগুলোর ৬২ শতাংশেই টারবিনাফাইন ওষুধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা দেখা গেছে। ফলে বর্তমানে একমাত্র নির্ভরযোগ্য কার্যকর ওষুধ হিসেবে টিকে আছে মুখে খাওয়ার ইট্রাকোনাজল। তবে ইট্রাকোনাজলের বিরুদ্ধেও প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ছে: ২১ শতাংশ ক্ষেত্রে ইট্রাকোনাজল এবং ১১ শতাংশ ক্ষেত্রে উভয় ওষুধই অকার্যকর হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
গবেষকরা বলছেন, দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম শনাক্ত হওয়া এই টি. ইন্দোতিনি এখন ৩০টিরও বেশি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। আর বাংলাদেশ এর একটি ভৌগোলিক হটস্পট হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ওষুধের প্রতি এই উচ্চ মাত্রার রেজিস্ট্যান্স বা প্রতিরোধ ক্ষমতা চিকিৎসার ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান চ্যালেঞ্জের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
ময়মনসিংহ বিভাগে প্রকোপ বেশি
গত বছরের নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে ৪৭ হাজার ৪০টি পরিবারের ১ লাখ ৮৯ হাজার ৯৮৬ জন ব্যক্তির ওপর পরিচালিত এইচএমএসএস ২০২৫ জরিপে রোগীদের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষের চিত্র উঠে এসেছে। একইসঙ্গে এতে স্বাস্থ্যখাতের কাঠামোগত দুর্বলতার বিষয়গুলোও চিহ্নিত করা হয়েছে, যা সার্বিক স্বাস্থ্যসেবাকে প্রভাবিত করছে।
বিবিএসের রেকর্ড করা শীর্ষ দশ রোগের মধ্যে পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে চর্মরোগ।
বিভাগওয়ারি হিসাবে সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি ময়মনসিংহে। বিভাগটিতে প্রতি ১ হাজার জনে ৪৩.১ থেকে ৫৮ জন মানুষ চর্মরোগে আক্রান্ত। চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও ঢাকায়ও আক্রান্তের হার তুলনামূলক বেশি। আর সর্বনিম্ন হার রংপুরে—ক হাজারে ২১ জন।
জরিপে চিকিৎসা গ্রহণের ক্ষেত্রেও উদ্বেগজনক চিত্র দেখাগেছে। মাত্র ১০.৩ শতাংশ রোগী সরকারি হাসপাতালে যান। ৪.২ শতাংশ রোগী যান বেসরকারি হাসপাতালে বা সরকারি ডাক্তারদের প্রাইভেট চেম্বারে। ৪২.১ শতাংশ রোগী বেসরকারি চিকিৎসকদের কাছ থেকে চিকিৎসা নেন এবং উল্লেখযোগ্য ৩৬.৪ শতাংশ রোগী সরাসরি ফার্মেসি থেকে ওষুধ কেনেন।
করণীয়
চিকিৎসকরা সতর্ক করে বলেছেন, চর্মরোগের দীর্ঘমেয়াদে চিকিৎসা না করালে কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা কিডনি জটিলতার কারণ হতে পারে।
ডা. শহিদুল্লাহ শিকদার বলেন, কারও চর্মরোগ দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। পাশাপাশি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে এবং পুষ্টিকর খাবার ক্ষেতে হবে। কারও রোগ হলে তার দ্রুত চিকিৎসা করে অন্যদের থেকে একটু সরিয়ে রাখতে হবে এবং কিছু কিছু রোগে বেলায়, বিশেষ করে পরিবারে একজনের খোসপাঁচড়া হলে অন্যদের চিকিৎসা করতে হবে।
ডা. সাইফুল বলেন, ডা সাইফুল বলেন, ওষুধের রেজিস্ট্যান্স রোধের জন্য জাতীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে ওষুধ কে লিখতে পারবেন, কে লিখতে পারবেন না। প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধ বিক্রি করা যাবে না এবং রোগীদেরও ওষুধের পূর্ণ কোর্স সম্পন্ন করতে হবে।
