মানুষ কেন ঘুমায়? নতুন গবেষণা এর জন্য মস্তিষ্ককে দায়ী করছে

ঘুমের গুরুত্ব কতটা বিশাল, তা অতিরঞ্জিত করে বলা কঠিন। নিয়মিত বিশ্রামের সময় প্রতিটি জীব—ছোট-বড়—স্মৃতি সংরক্ষণ, কোষ মেরামত এবং রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির সুযোগ পায়। তবে ঘুমের যে তীব্র আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়—যেটিকে বিজ্ঞানীরা বলেন স্লিপ প্রেসার আর সাধারণ মানুষ বলেন ক্লান্তি—তার উৎস এতদিন অস্পষ্টই ছিল।
বিভিন্ন তত্ত্ব এই ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। একটি তত্ত্ব অনুযায়ী, মস্তিষ্কে অ্যাডেনোসিন নামক এক ধরনের রাসায়নিক জমা হওয়াই এর কারণ। আরেকটি তত্ত্ব বলছে, মস্তিষ্কে স্নায়বিক সংযোগ তৈরির চাহিদাই এর জন্য দায়ী। তবে ১৬ জুলাই ন্যাচার সাময়িকীতে প্রকাশিত একটি গবেষণায় বলা হয়েছে—ঘুমের আকাঙ্ক্ষার সবচেয়ে দৃঢ় প্রমাণ এখন পাওয়া গেছে: এটি সম্ভবত নির্দিষ্ট কিছু মস্তিষ্ককোষের মাইটোকন্ড্রিয়ায় ইলেকট্রনের জমার ফল।
যদি এই তত্ত্ব সত্য হয়, তবে ঘুমের উদ্ভব হয়েছিল মাইটোকন্ড্রিয়ার মেরামত প্রক্রিয়া হিসেবে—পরে অন্য সুবিধাগুলো (যেমন স্মৃতি সংরক্ষণ বা রোগপ্রতিরোধ) ধাপে ধাপে যুক্ত হয়েছে।
মানব ও প্রাণীর প্রায় সব কোষেই উপস্থিত মাইটোকন্ড্রিয়া খাবার থেকে প্রাপ্ত জ্বালানির অণু থেকে ইলেকট্রন নিয়ে শক্তি উৎপাদন করে। তবে এই প্রক্রিয়ায় কিছু ইলেকট্রন মাইটোকন্ড্রিয়া থেকে বেরিয়ে যায় এবং অক্সিজেনের সঙ্গে বিক্রিয়া করে বিষাক্ত উপজাত তৈরি করে—যেগুলো অতিরিক্ত জমে গেলে মাইটোকন্ড্রিয়াসহ কোষের অন্যান্য অংশকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
নতুন গবেষণায় দেখা গেছে, মস্তিষ্কের 'স্লিপ-কন্ট্রোল নিউরন' নামে পরিচিত কিছু কোষে যদি মাইটোকন্ড্রিয়ার অতিরিক্ত ক্ষতির সংকেত ধরা পড়ে, তখনই ঘুমের সূচনা হয়। এই নিউরনগুলো সার্কিট ব্রেকারের মতো কাজ করে বলে জানান গবেষণাপত্রটির অন্যতম লেখক অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির জেরো মিসেনবক। ইলেকট্রন অতিরিক্ত জমে গেলে, এই নিউরনগুলো মস্তিষ্ককে ঘুমের দিকে ঠেলে দেয়। ঘুম তখন একদিকে ইলেকট্রনের ভারসাম্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে, অপরদিকে মাইটোকন্ড্রিয়ার ক্ষতিও মেরামত করে।
এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে গবেষকরা ফলের মাছি নিয়ে একাধিক পরীক্ষা চালান। প্রথমে তারা মাছির মস্তিষ্কের ঘুম নিয়ন্ত্রণকারী নিউরনগুলো (যেগুলো ডরসাল ফ্যান শেপড বডি নিউরনস বা ডিএফবিএনএস নামে পরিচিত) একটি জিন প্রকৌশলপ্রসূত প্রোটিন দিয়ে চিহ্নিত করেন, যা সবুজ আলোতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। এরপর তারা মাছিদের স্বাভাবিক ঘুমচক্র ব্যাহত করতে ১২ ঘণ্টা ধরে একটি নড়তে থাকা প্ল্যাটফর্মে রাখেন।
পরবর্তী ধাপে, গবেষকেরা যখন ফ্লুরোসেন্ট-চিহ্নিত ডিএফবিএন নিউরনগুলো মাইক্রোস্কোপে পর্যবেক্ষণ করেন, তখন দেখতে পান—নিউরনের ভেতরের মাইটোকন্ড্রিয়া ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, যা ইলেকট্রন-সম্পর্কিত ক্ষতির ইঙ্গিত দেয়। তবে ঘুমের পর দেখা যায়—সেই মাইটোকন্ড্রিয়াগুলো আবার একত্রিত হয়ে গেছে।
এটি ইঙ্গিত দেয় যে মাইটোকন্ড্রিয়ার ক্ষতি থেকেই ঘুমের প্রয়োজনীয়তা তৈরি হতে পারে। আর এই সম্পর্কটি আসলেই কার্যকর কিনা, তা বুঝতে গবেষকেরা বিভিন্ন উপায়ে মাইটোকন্ড্রিয়ার ইলেকট্রনের ভারসাম্যকে প্রভাবিত করেন।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল একটি পরীক্ষা, যেখানে তারা ডিএফবিএন নিউরনের মাইটোকন্ড্রিয়াকে একটি বিকল্প শক্তির উৎস দেন—এক ধরনের প্রোটিন যা আলো থেকে শক্তি গ্রহণ করে। এরপর তারা একটি ফ্ল্যাশলাইটের আলো ব্যবহার করে এই প্রোটিন সক্রিয় করেন, ফলে মাইটোকন্ড্রিয়া ইলেকট্রন ছাড়াই শক্তি উৎপাদন করতে পারে। কিন্তু এতে ইলেকট্রন ফাঁস হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
ফলে, যেসব মাছি ঘুম-বঞ্চিত ছিল না, সেসব মাছিও আলো লাগার মাত্র প্রথম ঘণ্টার মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ে—যা নিয়ন্ত্রণ গোষ্ঠীর চেয়ে অনেক বেশি।
এই পরীক্ষা প্রমাণ করে, মাইটোকন্ড্রিয়ার ইলেকট্রন ভারসাম্যে বিঘ্ন ঘটালেই ঘুম আসতে পারে, এমনকি যখন প্রাণীটি স্বাভাবিকভাবে ক্লান্ত না-ও থাকে।
ঘুম বিষয়ক স্নায়ুবিজ্ঞানের বিশেষজ্ঞ এবং কিংস কলেজ লন্ডনের অধ্যাপক ইভানা রোসেনৎসভেইগ (যিনি এই গবেষণায় জড়িত ছিলেন না) বলেন, এই আবিষ্কারটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণাগত পরিবর্তন নির্দেশ করে। আগে ধারণা ছিল, মাইটোকন্ড্রিয়ায় ইলেকট্রনের ভারসাম্যহীনতা হয়তো ঘুমের অভাবের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। কিন্তু রোসেনৎসভেইগ মনে করেন, এই গবেষণাটি প্রমাণ দিয়েছে—এটি আসলে ঘুমের চাপ বা প্রয়োজনের কারণ হতে পারে।
গবেষকরা আরও বলেন, যেহেতু প্রাণীদের মধ্যে কোষে শক্তি সরবরাহের প্রক্রিয়া ও ঘুমের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে, তাই সম্ভবত মানুষের ক্ষেত্রেও ইলেকট্রন জমে ঘুমের চাপ সৃষ্টি করে। এর পক্ষে একটি প্রমাণ হলো—যেসব মানুষ মাইটোকন্ড্রিয়াল সমস্যায় ভোগেন, তারা প্রায়ই ক্লান্তি বা পেশির অবসাদ ছাড়াও ঘুমঘুম ভাব অনুভব করেন।
গবেষণার প্রধান লেখক অধ্যাপক জেরো মিসেনবক আশা প্রকাশ করেন, ঘুমের চাপ কীভাবে কাজ করে তা আরও ভালোভাবে বোঝা গেলে, বিভিন্ন ঘুমজনিত সমস্যা এবং দীর্ঘস্থায়ী রোগ সম্পর্কে নতুন ধারণা পাওয়া যাবে—বিশেষ করে যেসব সমস্যায় অতিরিক্ত ক্লান্তি একটি লক্ষণ হিসেবে দেখা হয়।