আর্থিক চাপ বাংলাদেশের বেসরকারি খাতে উৎপাদনশীলতা কমাচ্ছে: গবেষণা
বাংলাদেশের বেসরকারি খাতের অর্ধেকেরও বেশি কর্মী জানিয়েছেন, আর্থিক উদ্বেগ তাদের কর্মদক্ষতা কমিয়ে দিচ্ছে। একই সঙ্গে প্রতি দশজনের মধ্যে চারজন স্বীকার করেছেন, অর্থনৈতিক চাপ তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বহুজাতিক বিমা প্রতিষ্ঠান মেটলাইফের এক সাম্প্রতিক জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
'এমপ্লয়ি বেনিফিট ট্রেন্ডস স্টাডি (ইবিটিএস)' শীর্ষক এই জরিপে তৈরি পোশাক, ব্যাংকিং, এফএমসিজি, টেলিযোগাযোগ, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) ও উৎপাদনসহ বিভিন্ন খাতের সাত শতাধিক কর্মী অংশ নেন। জরিপে দেখা যায়, কর্মীদের অনেককেই আপাতদৃষ্টিতে সন্তুষ্ট মনে হলেও তাদের ভেতরে কাজ করছে অনিশ্চয়তা ও উদ্বেগের গভীর চাপ।
বহুজাতিক বিমা কোম্পানি মেটলাইফের জরিপ অনুযায়ী, ৭৮ শতাংশ কর্মী জানিয়েছেন তারা তাদের কাজ নিয়ে সন্তুষ্ট; এবং ৭৩ শতাংশ বলেছেন, সামগ্রিকভাবে তারা নিজেদের জীবনযাপন নিয়ে সন্তুষ্ট। তবে এই ইতিবাচক সংখ্যার আড়ালেই আছে কঠিন বাস্তবতা— ৫৬ শতাংশ কর্মী স্বীকার করেছেন, আর্থিক চাপ তাদের কাজের মান কমিয়ে দিচ্ছে। আর মাত্র ৪২ শতাংশ কর্মী তাদের প্রতিষ্ঠানকে অন্যদের কাছে কাজের জন্য সুপারিশ করবেন বলে জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক এসএম জুলফিকার আলি বলেন, 'এই বৈপরীত্য একটি সম্পৃক্ততা-সংকটের ইঙ্গিত দিচ্ছে। কাজের সন্তুষ্টি থাকলেও প্রতিষ্ঠানের প্রতি আনুগত্য বা উৎসাহের অভাব দেখা যাচ্ছে। কর্মীরা কাজ করছেন, কিন্তু বিকশিত হচ্ছেন না—তারা এক ভঙ্গুর ব্যবস্থার মধ্যে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন।'
জরিপে আরও দেখা যায়, ৭২ শতাংশ কর্মী মনে করেন তাদের প্রতিষ্ঠান তাদের প্রতি যত্নশীল। তবে মানসিক ও আর্থিক স্বাস্থ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এখনো বড় ঘাটতি রয়ে গেছে। জীবনযাত্রার ব্যয়বৃদ্ধি, কর্মজীবনে স্থবিরতা ও চাকরির অনিশ্চয়তা উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে তুলছে, বিশেষ করে প্রতিযোগিতামূলক চাকরির বাজারে টিকে থাকার লড়াই করা শহরের তরুণ মধ্যবিত্তদের মধ্যে।
আর্থিক চিন্তার প্রভাব
জরিপের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো—আর্থিক চাপ ও কর্মদক্ষতার মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। প্রতি তিনজনের মধ্যে দুজন কর্মী জানিয়েছেন, তারা আর্থিকভাবে অনিরাপদ অনুভব করেন। তাদের অর্ধেকেরও বেশি স্বীকার করেছেন, এই উদ্বেগ সরাসরি তাদের কাজের মানে প্রভাব ফেলে। এছাড়া ৬৯ শতাংশ কর্মী মনে করেন, কর্মীদের আর্থিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে প্রতিষ্ঠানগুলোকেই আরও সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে—বিশেষত অবসর-সঞ্চয় বা রিটায়ারমেন্ট সেভিংস সুবিধা সহজ করার মাধ্যমে।
তবুও জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৫৩ শতাংশেরও বেশি জানিয়েছেন, তাদের অবসর নিয়ে কোনো পরিকল্পনা নেই, যা কর্মীদের আর্থিক সচেতনতা ও দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তার ঘাটতিকে স্পষ্ট করে তুলেছে।
ঢাকার এক টেলিযোগাযোগ কোম্পানির মধ্যপদস্থ ব্যবস্থাপক ফারজানা রহমান বলেন, 'আর্থিক চাপ শুধু টাকার বিষয় নয়, এটি অনিশ্চয়তার বিষয়।'
তিনি বলেন, 'যখন আপনি জানেন না পরের মাসে সন্তানের স্কুলের ফি বা চিকিৎসার খরচ দিতে পারবেন কি না, তখন কাজে মনোযোগ রাখা যায় না। সেই উদ্বেগ ধীরে ধীরে আপনার আত্মবিশ্বাসও খেয়ে ফেলে।'
আনুগত্য ও কর্মদক্ষতার ব্যবধান ঘোচানো
জরিপে দেখা গেছে, যারা নিজেদের প্রাপ্ত সুবিধায় সন্তুষ্ট, তারা দ্বিগুণ বেশি আনুগত্যশীল, সম্পৃক্ত এবং উৎপাদনশীল। তবু বাস্তবে ৭৮ শতাংশ কর্মী মনে করেন, বিমা ও স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা পেলে প্রতিষ্ঠানের প্রতি তাদের আনুগত্য বাড়বে। কিন্তু বর্তমানে এসব সুবিধা দিচ্ছে মাত্র এক-তৃতীয়াংশ প্রতিষ্ঠান।
প্রদত্ত সুবিধার ক্ষেত্রে বড় ঘাটতি রয়ে গেছে বেতনসহ পরিচর্যা-ছুটি, স্বাস্থ্যবিমা, জীবনবিমা, আয়-সুরক্ষা এবং অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতার মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে, যা একজন কর্মীর আর্থিক ও মানসিক স্থিতি দৃঢ় করতে পারত।
এক শীর্ষস্থানীয় তৈরি পোশাক প্রতিষ্ঠানের মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান মাহবুবুর রহমান হীরা বলেন, 'বাংলাদেশের বেসরকারি খাত ঐতিহাসিকভাবে কর্মী-সুবিধায় কম বিনিয়োগ করেছে, কারণ আগে চাকরি পাওয়া সহজ ছিল, আর মানুষ সহজেই বদলি করা যেত।'
তিনি আরও বলেন, 'এখন সেই মানসিকতা পুরোনো। নতুন প্রজন্ম শুধু বেতন নয়, নিরাপত্তা, সহমর্মিতা ও সম্মানও চায়।'
তবে অনেক ক্ষেত্রে সুবিধা থাকলেও তা সঠিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে না। জরিপে অংশ নেওয়া ৭০ শতাংশ কর্মী বলেছেন, অন্যরা কীভাবে সুবিধাগুলো কাজে লাগাচ্ছে তা জানলে তারাও সেগুলো বেশি ব্যবহার করতেন। প্রতি চারজনের একজন মনে করেন, প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত সুবিধা সম্পর্কে তারা যথেষ্ট তথ্য পান না।
প্রতিবেদনে প্রতিষ্ঠানগুলোকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, নিয়মিত ডিজিটাল যোগাযোগ, ম্যানেজারদের সরাসরি অনুসন্ধান এবং কর্মীদের অভিজ্ঞতা-ভিত্তিক গল্পের মাধ্যমে সক্রিয় সম্পৃক্ততা বজায় রাখতে—যাতে নীতিমালা শুধু কাগজে নয়, বাস্তবে সহায়ক ব্যবস্থায় রূপ নেয়।
যত্নের সংস্কৃতি অথবা তার অনুপস্থিতি
জরিপে কর্মীদের প্রতি যত্নের গুরুত্ব বাড়ার বিষয়টিও স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে। যেসব প্রতিষ্ঠান নমনীয় নীতিমালা, মানসিক ও শারীরিক সুস্থতা কর্মসূচি এবং স্বচ্ছ যোগাযোগের মাধ্যমে সহমর্মিতা প্রদর্শন করে, তারা কর্মীদের আনুগত্য ও সম্পৃক্ততায় দৃশ্যমান অগ্রগতি পায়।
বিশেষত সহজেই ছুটির ব্যবস্থাকে কর্মীরা অত্যন্ত মূল্যায়ন করেছেন। 'জেন-জি।' অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৮৩ শতাংশ জানিয়েছেন, কাজের নমনীয়তা তাদের প্রধান প্রত্যাশা। পাশাপাশি কর্মীরা আশা করেন, জীবনের নানা পর্যায়ে—আর্থিক বিপর্যয় থেকে শুরু করে পরিবার-পরিচর্যার দায়িত্ব—প্রতিষ্ঠান যেন বাস্তব সহায়তা দেয়।
তবে বাস্তবে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ এখনো কর্মীদের প্রত্যাশার পেছনে পড়ে আছে। গত বছর ৫১ শতাংশ প্রতিষ্ঠান কর্মী-সুবিধায় ব্যয় বাড়ালেও, এর বড় অংশ গেছে প্রচলিত খাতে—যেমন স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিমায়। মানসিক স্বাস্থ্য বা আর্থিক পরিকল্পনার মতো নতুন দিকগুলো এখনো উপেক্ষিত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের (আইবিএ) মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ সাদিয়া হক বলেন, 'বাংলাদেশের করপোরেট সংস্কৃতিতে "যত্ন" অনেক সময়ই কেবল প্রতীকী। কয়েকটি বেতনসহ ছুটি বা আনুষ্ঠানিক ওয়েলনেস সেশন আসল সমস্যার সমাধান নয়—মূল সংকট কর্মক্ষেত্রে মানসিক নিরাপত্তা ও বিশ্বাসের অভাব।'
কৌশলগত অগ্রাধিকার হিসেবে উৎপাদনশীলতা ও কর্মী ধরে রাখা
প্রতিষ্ঠানের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা গেছে, ৫৬ শতাংশ নিয়োগকর্তা উৎপাদনশীলতা এবং ৪৯ শতাংশ কর্মী-সম্পৃক্ততাকে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন। যদিও অধিকাংশই স্বীকার করেন, কর্মী-সুবিধা কর্মস্থলের সংস্কৃতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, তবু অনেকেই মানছেন—বর্তমান সুবিধাগুলো কর্মীদের মানসিক চাপ কমাতে বা আর্থিক সুরক্ষা জোরদার করতে কার্যকর নয়।
মেটলাইফ বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আলা আহমদ বলেন, 'কর্মস্থলে সুস্থতা এখন আর দাতব্য কাজ নয়, এটি একটি কৌশল। আর্থিক উদ্বেগ ও পর্যাপ্ত সুবিধার অভাব নিঃশব্দে উৎপাদনশীলতা ও মনোবল ক্ষয় করছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর এখন সুযোগ আছে যত্নশীল কর্মসংস্কৃতি ও উন্নত যোগাযোগের মাধ্যমে নেতৃত্ব দেখানোর।'
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায় আধুনিকীকরণ না হলে বাংলাদেশ এক ধরনের 'উৎপাদনশীলতা-বৈপরীত্য' গড়ে উঠতে পারে—যেখানে কর্মীদের বাহ্যিকভাবে সন্তুষ্ট দেখালেও আসলে সম্পৃক্ত থাকবেন না।
বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক এসএম জুলফিকার আলি বলেন, 'মানসিক ও আর্থিক স্বাস্থ্য ব্যক্তিগত নয়, এটি উৎপাদনশীলতার বিষয়।'
তিনি আরও সতর্ক করে বলেন, 'এই বিষয়গুলো উপেক্ষা করা হলে বাংলাদেশের জনসংখ্যাগত সুফল এক সময় জনসংখ্যাগত বোঝায় পরিণত হতে পারে।'
