আমরা হাই তুলি কেন? কারণ কিন্তু আপনি যা ভাবছেন, তা নয়!
পৃথিবীর সমস্ত মেরুদণ্ডী প্রাণীই হাই তোলে, বা অন্ততপক্ষে এমন কিছু করে যা দেখতে হাই তোলার মতোই। অতি সামাজিক প্রাণী বেবুন যেমন হাই তোলে, তেমনই তোলে লাজুক ও একা থাকতে ভালোবাসা ওরাংওটাংও। টিয়া, পেঙ্গুইন, কুমির—সবাই হাই তোলে। এমনকি এমনটাও হতে পারে যে, পৃথিবীর প্রথম চোয়ালওয়ালা মাছটিও হাই তুলত। কিছুদিন আগ পর্যন্ত, হাই তোলার আসল উদ্দেশ্য কী, তা স্পষ্ট ছিল না এবং এই বিষয়টি নিয়ে গবেষক ও বিজ্ঞানীদের মধ্যে এখনও বিতর্ক রয়েছে। কিন্তু সমস্ত প্রাণীর মধ্যে এই একটি বিষয়ে মিলই হয়তো এর আসল রহস্যের সমাধান দিতে পারে—আর সেই কারণটা সম্ভবত আপনি যা ভাবছেন, তা নয়।
জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটির আচরণগত জীববিজ্ঞানের অধ্যাপক অ্যান্ড্রু গ্যালাপ বলেন, 'আমি যখন দর্শকদের জিজ্ঞেস করি, 'আচ্ছা, আপনাদের কেন মনে হয় আমরা হাই তুলি?', বেশিরভাগ মানুষই বলেন যে এর সম্পর্ক শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে এবং এটি হয়তো রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়।' তিনি আরও বলেন, 'এই ধারণাটা খুব স্বাভাবিক, কারণ বেশিরভাগ হাই তোলার সাথেই শ্বাস নেওয়ার একটা স্পষ্ট সম্পর্ক আছে—একটা গভীর শ্বাস আমরা ভেতরে নিই। কিন্তু যেটা অনেকেই জানেন না, তা হলো এই ধারণাটিকে সুস্পষ্টভাবে পরীক্ষা করে ভুল প্রমাণ করা হয়েছে।'
আগের ভুল ধারণা
আমরা বেশি অক্সিজেন গ্রহণ করতে বা অতিরিক্ত কার্বন ডাই অক্সাইড বের করে দেওয়ার জন্য হাই তুলি কি না, এই ধারণাটি পরীক্ষা করার জন্য ১৯৮০-এর দশকে কিছু গবেষণা করা হয়েছিল। সেখানে স্বেচ্ছাসেবকদের শ্বাসের বাতাসে এই দুটি গ্যাসের মাত্রা ইচ্ছেমতো বাড়িয়ে-কমিয়ে দেখা হয়েছিল। ফলাফল অবাক করার মতো ছিল—বাতাসে গ্যাসের পরিবর্তন তাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের অন্যান্য প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করলেও, হাই তোলার সংখ্যায় কোনো পরিবর্তন আনেনি। এমনকি শ্বাসকষ্ট বা ফুসফুসের রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের হাই তোলার অভ্যাসেও পদ্ধতিগতভাবে পরিমাপযোগ্য কোনো পার্থক্য দেখা যায় না—যদি হাই তোলার সম্পর্ক শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে থাকত, তাহলে এমনটা হওয়ার কথা ছিল না।
অধ্যাপক গ্যালাপ ঠিক এই জায়গা থেকেই বিষয়টি নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। তিনি বলেন, 'আমি যখন আমার অনার্সের থিসিস করছিলাম, আমার তখনকার উপদেষ্টা বললেন, 'তুমি হাই তোলা নিয়ে গবেষণা করছ না কেন? কারণ কেউই জানে না আমরা কেন এটা করি।'' গ্যালাপের কাছে এটা খুব আকর্ষণীয় মনে হয়েছিল। তিনি বলেন, 'আমরা জানতাম যে এর পেছনে নিশ্চয়ই কোনো শারীরবৃত্তীয় কারণ আছে। তাই আমি এর পেছনের শারীরিক প্রক্রিয়াটি খতিয়ে দেখতে শুরু করলাম—চোয়ালকে প্রসারিত করে একটা গভীর শ্বাস নেওয়া, তারপর দ্রুত চোয়াল বন্ধ করে তুলনামূলকভাবে কম সময়ে শ্বাস ছাড়া। আর তখনই আমার মনে হলো, এর ফলে মাথার খুলির ভেতরে রক্ত সঞ্চালনে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব পড়ে।'
রক্ত সরবরাহ ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ
আসলে, ঠিক এটাই ঘটে বলে মনে হচ্ছে। চিকিৎসা সংক্রান্ত বিভিন্ন গবেষণাপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে যে, হাই তোলা মাথার খুলিতে ধমনীর রক্ত সরবরাহ বাড়িয়ে দেয় এবং পরে শিরার মাধ্যমে সেই রক্ত আবার হৃৎপিণ্ডে দ্রুত ফিরে আসতে সাহায্য করে।
গ্যালাপ বলেন, 'আমরা চোয়ালের এই প্রসারণকে শরীরের অন্য অংশের মাংসপেশি টানটান করার মতোই একটি কাজ হিসেবে ভাবতে পারি। যাতে শরীরের সেই অংশে রক্ত সঞ্চালন বাড়ে, হাই তোলাও ঠিক একইভাবে মাথার খুলির জন্য কাজ করে।'
এই ধারণা থেকে গ্যালাপ এবং তার সহকর্মীরা একটি নতুন তত্ত্বে পৌঁছান—হাই তোলা মূলত আমাদের মস্তিষ্ক এবং মাথার খুলির চারপাশের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। আপনার মস্তিষ্কের তাপমাত্রা মূলত তিনটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে: মস্তিষ্কে ধমনীর রক্তের প্রবাহের হার, সেই রক্তের তাপমাত্রা এবং মস্তিষ্কের ভেতর স্নায়বিক কার্যকলাপের ফলে তৈরি হওয়া তাপ। তত্ত্ব অনুযায়ী, হাই তোলা প্রথম দুটি বিষয়কেই প্রভাবিত করতে পারে। যখন আপনি হাই তোলেন, তখন আপনি একদলা ঠান্ডা বাতাস মুখের ভেতরে নেন। এই বাতাস আপনার মুখ, জিভ এবং নাকের ভেতরের আর্দ্র অংশের ওপর দিয়ে বয়ে যায়। ঠিক যেমন গাড়ির রেডিয়েটর দিয়ে বাতাস প্রবাহিত হয়ে ইঞ্জিনকে ঠান্ডা রাখে, তেমনই এই বাতাস বাষ্পীভবন ও পরিচলনের মাধ্যমে তাপ শুষে নেয়।
গবেষণায় এর প্রমাণও মিলেছে। দেখা গেছে, পরিবেশের তাপমাত্রার সাথে হাই তোলার সংখ্যার একটি সম্পর্ক আছে। যখন পরিবেশের তাপমাত্রা হালকা গরম থাকে, তখন হাই তোলার পরিমাণ বেড়ে যায়। তবে যখন খুব বেশি গরম পড়ে, তখন বাইরের বাতাসের তাপমাত্রা এতটাই বেশি থাকে যে এই রেডিয়েটরের মতো ঠান্ডা করার প্রক্রিয়াটি আর কাজ করে না। তখন শরীর ঘামের মতো অন্য শীতলীকরণ প্রক্রিয়ার সাহায্য নেয় এবং হাই তোলা আবার স্বাভাবিক হয়ে আসে। একইভাবে, পরিবেশ ঠান্ডা থাকলেও হাই তোলার পরিমাণ কমে যায়।
এই তত্ত্বটি আরও একটি বিষয় ব্যাখ্যা করে—কেন কিছু নির্দিষ্ট রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা অতিরিক্ত হাই তোলেন। এর কারণ হতে পারে, হয় সেই রোগগুলো মস্তিষ্কের বা শরীরের তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয়, অথবা সেই রোগের জন্য ব্যবহৃত ওষুধগুলোর পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া হিসেবে তাপমাত্রা বেড়ে যায়। 'স্নায়বিক কার্যকলাপের' ব্যাখ্যাটিও পশুদের ওপর করা গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে। দেখা গেছে, যে সমস্ত স্তন্যপায়ী প্রাণী ও পাখির মস্তিষ্কে নিউরনের সংখ্যা বেশি, তারা মস্তিষ্কের আকার নির্বিশেষে বেশি সময় ধরে হাই তোলে।
সচেতন অবস্থার পরিবর্তন
তবে এর মানে এই নয় যে, অন্য তত্ত্বগুলোকে পুরোপুরি বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। প্রমাণের ভিত্তিতে সবচেয়ে জোরালো আরেকটি তত্ত্ব হলো 'সচেতন অবস্থার পরিবর্তন' তত্ত্ব। সহজ ভাষায়, এই তত্ত্ব অনুযায়ী হাই তোলা মস্তিষ্ককে এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় যেতে সাহায্য করে—যেমন ঘুম থেকে জাগা, একঘেয়েমি থেকে সতর্ক হওয়া ইত্যাদি। ঔষধের ইতিহাসবিদ ডঃ অলিভিয়ের ওয়ালুসিনস্কি বলেন, 'একটি সম্ভাবনা হলো, হাই তোলা মস্তিষ্ককে তার 'ডিফল্ট মোড নেটওয়ার্ক' (যে অংশটি দিবাস্বপ্ন দেখা, স্মৃতিচারণ করা বা আত্ম-চিন্তার সাথে যুক্ত) থেকে মনোযোগ নিয়ন্ত্রণকারী নেটওয়ার্কে (যা শরীরকে কাজের জন্য প্রস্তুত করে) যেতে সাহায্য করে। এর একটি সম্ভাব্য প্রক্রিয়া হতে পারে যে, হাই তোলা 'সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুইড' সঞ্চালনে সাহায্য করে। এই তরলটি আপনার মস্তিষ্ক এবং মেরুদণ্ডকে ঘিরে রাখে এবং বাইরের আঘাত থেকে রক্ষা করে।'
এমনও হতে পারে যে, এই 'অবস্থা পরিবর্তনের' কাজটিই প্রথমে বিবর্তিত হয়েছিল, এবং মস্তিষ্ক ঠান্ডা রাখার বিষয়টি এর একটি উপকারী পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া হিসেবে পরে যুক্ত হয়েছে। যত বেশি সংখ্যক প্রাণীর ওপর গবেষণা করা হবে, ততই এই বিষয়ে আরও ভালো প্রমাণ পাওয়া যাবে। এটাও হতে পারে যে, এই দুটি ব্যাখ্যা সরাসরি সম্পর্কিত। কারণ, মানসিক অবস্থার পরিবর্তন মানেই মস্তিষ্কের কার্যকলাপ ও তাপমাত্রার পরিবর্তন। আর তার জন্যই প্রয়োজন উন্নত রক্ত সঞ্চালন এবং মস্তিষ্ককে ঠান্ডা রাখা। আপনি যখন বিরক্ত হন বা একঘেয়ে লাগে, তখন কেন হাই তোলেন, এই তত্ত্বটি তারও ব্যাখ্যা দেয়। আপনার মস্তিষ্ক হয়তো আপনাকে আরও কোনো উদ্দীপক পরিস্থিতিতে নিয়ে যাওয়ার জন্য তার কার্যকলাপের স্তর বাড়িয়ে দেয়, এবং তার সাথে পাল্লা দিয়ে রক্ত সঞ্চালনের চাহিদাও বেড়ে যায়।
সংক্রামক হাই তোলা
এক মিনিট দাঁড়ান, কিন্তু সংক্রামক হাই তোলার ব্যাপারটা কী? আমরা সবাই এই ঘটনার সাথে পরিচিত—একটি ঘরে বা এমনকি টেলিভিশনের পর্দায় কাউকে হাই তুলতে দেখলেই বাকিরাও একে একে হাই তুলতে শুরু করে। কিছু গবেষক বলেছেন, এই ধরনের সংক্রামক আচরণ একটি গোষ্ঠীকে একত্রিত করে। হয়তো এটি ঘুম, একঘেয়েমি বা সতর্কতার একটি সংকেত, যা নকল করা কঠিন। তবে এটি হাই তোলার মূল উদ্দেশ্য হওয়ার সম্ভাবনা কম, কারণ অনেক একাকী প্রাণীও নিয়মিত হাই তোলে।
অধ্যাপক গ্যালাপের মতে, 'হতে পারে, সংক্রামক হাই তোলার নির্দিষ্ট কোনো কাজ নেই; এটি আসলে অত্যন্ত সামাজিক প্রাণীদের মধ্যে উন্নত সামাজিক বুদ্ধিমত্তার একটি পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া মাত্র।'
বিষয়টিকে আরেকটু সহজভাবে বললে, মানুষসহ অনেক প্রাণীর মধ্যেই সহানুভূতি বাড়ানোর বিভিন্ন উপায় রয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো 'মিরর নিউরন' বা 'আয়না কোষ'। এই কোষগুলো তখনই সক্রিয় হয় যখন কোনো ব্যক্তি নিজে একটি কাজ করে, অথবা অন্য কাউকে ঠিক একই কাজ করতে দেখে। তাই হতে পারে, অন্য কাউকে হাই তুলতে দেখলে আপনার মিরর নিউরনগুলো সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং আপনাকেও হাই তুলতে প্ররোচিত করে। তবে সংক্রামক হাই তোলা 'সচেতন অবস্থার পরিবর্তন' তত্ত্বের মাধ্যমে একটি গোষ্ঠীকে সমন্বিত করতেও সাহায্য করতে পারে। যেমন, এটি একটি দলের সমস্ত প্রাণীকে একযোগে বিশ্রামরত অবস্থা থেকে সক্রিয় অবস্থায় নিয়ে আসতে পারে।
২০২১ সালে সিংহের ওপর করা একটি গবেষণায় দেখা গেছে, হাই তোলার পর অন্যান্য আচরণও সংক্রামক হতে পারে। যেমন, যদি একটি শুয়ে থাকা সিংহ হাই তুলে হাঁটতে শুরু করে, তবে দলের অন্য সিংহরাও যারা হাই তুলেছিল, তারাও তার পিছু নেয়।
সংক্রামক হাই তোলা একটি গোষ্ঠীর সতর্কতা বাড়াতেও সাহায্য করে। যেমন, একটি বেবুনের পালকে যদি একটি বেবুন হাই তুলে সতর্ক করে, তবে বাকিরাও হাই তোলার মাধ্যমে আরও সজাগ হয়ে উঠতে পারে। এর উল্টোটাও হতে পারে—ঘুমের আগে উত্তেজনা কমিয়ে আনতেও এটি সাহায্য করতে পারে।
সুতরাং, এক কথায়: হাই তোলা সম্ভবত আপনার জন্য ভালো, এবং এটি আপনার মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বাড়াতে সাহায্য করে। আর হ্যাঁ, যদি আপনি পাঁচ বছরের কোনো শিশুকে ঘুম পাড়ানোর জন্য হাই তুলে থাকেন, তাহলে থামবেন না—হতে পারে আপনার কৌশলটা সত্যিই কাজ করছে।
অনুবাদ : নাফিসা ইসলাম মেঘা
