ভারতীয় ঐতিহ্য নিয়ে বারবার বিতর্কে প্রাডা ও অন্যান্য বিলাসবহুল ব্র্যান্ড, কেন?

চলতি বছরে জনপ্রিয় ফ্যাশন শো 'মিলান ফ্যাশন উইক' অনুষ্ঠানে ইতালির বিলাসবহুল ব্র্যান্ড প্রাডার ডিজাইন করা স্যান্ডেল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে। কারণ, সেটি দেখতে অবিকল ভারতের ঐতিহ্যবাহী 'কোলাপুরি চপ্পল'-এর মতো, কিন্তু পণ্যের কোথাও এর উৎস বা ভারতের নাম উল্লেখ করা হয়নি।
কোলাপুরি চপ্পল মহারাষ্ট্রের কলাপুর শহরের শতবর্ষ পুরনো পাদুকাশিল্প। সম্পূর্ণ হাতে তৈরি এই চপ্পল ভারতের নানা প্রান্তে জনপ্রিয় ও স্থানীয় কারিগরদের জন্য জীবিকার উৎস। প্রাডার ডিজাইনে সেই ঐতিহ্যের স্পষ্ট ছাপ থাকলেও, তার স্বীকৃতি না পাওয়ায় এটি 'সাংস্কৃতিক অনুকরণ' হিসেবে সমালোচিত হয়েছে।
প্রাডাকে ঘিরে সাম্প্রতিক এক বিতর্ক নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে—ভারতের ঐতিহ্যবাহী শিল্প ও নকশাকে কীভাবে ব্যবহার করছে বৈশ্বিক ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো, আর সেই স্বীকৃতি কতটা ফিরছে মূল শিল্পীদের কাছে?
সমালোচনার পর প্রাডা এক বিবৃতিতে জানায়, তারা কোলাপুরি চপ্পলের উৎস ও ভারতীয় কারিগরদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং তাদের সঙ্গে 'অর্থবহ সংলাপে' আগ্রহী। মহারাষ্ট্র কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও তাদের যোগাযোগ চলছে।
সম্প্রতি প্রাডার প্রতিনিধি দল মহারাষ্ট্রের কোলাপুরে গিয়ে স্থানীয় চপ্পল কারিগর ও বিক্রেতাদের সঙ্গে দেখা করেছে। তারা চামড়া প্রস্তুতি, সেলাই ও নকশাসহ প্রতিটি ধাপ সরেজমিনে দেখেছে এবং কারিগরদের সমস্যা ও অভিজ্ঞতা জানার চেষ্টা করেছে।
তারা মহারাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ শিল্প-বাণিজ্য মহারাষ্ট্র চেম্বার অব কমার্স, ইন্ডাস্ট্রি অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালচার (এমএসিসিআইএ)-র সঙ্গে 'সফল বৈঠক' করেছে বলেও জানিয়েছে।

প্রাডার এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ভবিষ্যতে তারা কোলাপুরি চপ্পল নির্মাতাদের সাথে একসঙ্গে কাজ করতে পারে। যদিও এই সম্ভাব্য কাজের প্রকৃতি এখনও স্পষ্ট নয়।
তবে এটি বেশ বিরল এক উদাহরণ, যেখানে কোনও আন্তর্জাতিক ফ্যাশন হাউস খোলাখুলিভাবে স্বীকার করেছে, স্থানীয় কারিগরদের প্রাপ্য কৃতিত্ব তারা দেয়নি।
বিগত কয়েক বছর ধরেই বিশ্বখ্যাত ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোর বিরুদ্ধে দক্ষিণ এশীয়—বিশেষ করে ভারতীয়—ঐতিহ্যবাহী নকশা ও পোশাক থেকে 'অনুপ্রেরণা' নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। তবে এসব ক্ষেত্রে স্থানীয় সংস্কৃতি, নকশা কিংবা তার নেপথ্যের কারিগরদের স্বীকৃতি দেওয়ার প্রবণতা একেবারেই দেখা যায়নি বললেই চলে।
চলতি বছরেই মার্কিন ব্র্যান্ড রিফরমেশন এবং সুইডিশ ফ্যাশন হাউস এইচঅ্যান্ডএম-এর বসন্তকালীন পোশাক নিয়ে তীব্র বিতর্ক শুরু হয়। অনেকেই অভিযোগ করেন, তাদের পোশাকগুলোর নকশা দক্ষিণ এশীয় ঐতিহ্যবাহী পোশাকের হুবহু অনুকরণ। যদিও উভয় ব্র্যান্ডই এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
অন্যদিকে, মাত্র দুই সপ্তাহ আগে প্যারিস ফ্যাশন শোতে ডিওরের বহুল প্রতীক্ষিত সংগ্রহেও বিতর্ক দেখা দেয়। সোনালি-হাতির দাঁতের রঙের একটি কোটে ব্যবহার করা হয় উত্তর ভারতের শতাব্দীপ্রাচীন 'মুকাইশ' সূচিকর্ম, কিন্তু কোনো জায়গায় ভারতের নাম বা ঐতিহ্যের উল্লেখ ছিল না।

তবে অনেকেই মনে করেন, কোনও সংস্কৃতি থেকে অনুপ্রেরণা নেওয়া মানেই যে তা অশোভন বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, এমনটা নয়। কিন্তু সমালোচকদের দাবি—সংস্কৃতি থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে যখন আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলো এসব ঐতিহ্যকে নিজেদের নামে বিপুল দামে বিক্রি করে, তখন সেই দায় আরও বেড়ে যায়।
দিল্লিভিত্তিক ফ্যাশন সাংবাদিক শেফালি ভাসুদেব বলেন, 'নকশা-চর্চায় যথাযথ কৃতিত্ব দেওয়া একটি মৌলিক দায়িত্ব। এটি ডিজাইন স্কুলেই শেখানো হয়।' বরং তার মতে, স্বীকৃতি না দেওয়া মানেই যাদের সংস্কৃতিকে এসব ব্র্যান্ড ভালোবাসার দাবি করে, তাদের প্রতি এক ধরনের 'সাংস্কৃতিক অবহেলা'।
কনসাল্টিং প্রতিষ্ঠান টেকনোপাকের চেয়ারম্যান অরবিন্দ সিংহলের মতে, বেশিরভাগ বিলাসবহুল ব্র্যান্ড এখনও ভারতকে তাদের মূল বাজার হিসেবে বিবেচনা করে না।
'কলকাতা, মুম্বাই বা দিল্লিতে অনেক বিলাসবহুল মল ও ফ্ল্যাগশিপ স্টোর খুললেও সেগুলোতে তেমন ভিড় নেই,' বলেন তিনি। 'প্রাডা বা অনুরূপ ব্র্যান্ড এখনো অধিকাংশ ভারতীয়র কাছে অপরিচিত। উচ্চশ্রেণির মধ্যে কিছুটা চাহিদা থাকলেও, ক্রেতার সংখ্যা খুবই সীমিত।'
বিশ্লেষকদের মতে, শুধু আর্থিক বিনিয়োগ নয়—ভারতের বাজার ধরতে হলে সংস্কৃতি, ব্র্যান্ড পরিচিতি ও স্থানীয় বাস্তবতা বোঝা জরুরি। অনেক আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড এখনও সেটি অর্জন করতে পারেনি।
দিল্লিভিত্তিক ডিজাইনার আনন্দ ভূষণ বলেন, আন্তর্জাতিক বিলাসবহুল ব্র্যান্ডগুলোর সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক মূলত 'উৎপাদন কেন্দ্রীক'। বহু নামী ব্র্যান্ড তাদের পোশাক তৈরির জন্য ভারতীয় কারিগরদের ওপর নির্ভর করে, তবে ভারতকে ভোক্তা বাজার হিসেবে দেখে না।
কিন্তু তার কথায়, 'এই বাস্তবতা কোনোভাবেই সংস্কৃতি থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে সেটিকে প্রেক্ষাপটহীনভাবে কোটি কোটি ডলারের ব্র্যান্ডে রূপান্তর করার অনুমতি দেয় না।'
এই ক্ষোভ একক কোনো ব্র্যান্ডের বিরুদ্ধে নয়—এটি বহু বছরের জমে থাকা হতাশার প্রতিফলন। তিনি মনে করিয়ে দেন, ২০১১ সালে কার্ল ল্যাগারফেল্ডের 'প্যারিস–বোম্বে মেতিয়ের দার' সংগ্রহে শাড়ি-আচ্ছাদিত গাউন, নেহরু কলারের জ্যাকেট ও অলঙ্কৃত হেডপিস ব্যবহার করে ভারতীয় অনুপ্রেরণা তুলে ধরা হলেও, অনেকের চোখে সেটি ছিল সংস্কৃতির প্রকৃত প্রতিনিধিত্ব থেকে অনেক দূরে তৈরি এক ধরনের দায়হীন ছাঁচবদ্ধ উপস্থাপনা।
অন্যদিকে অনলাইন লাক্সারি প্ল্যাটফর্ম 'টাটা ক্লিক লাক্সারি'র প্রধান সম্পাদক ননিতা কালরা প্রাডার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'এটিকে ইচ্ছাকৃত মনে হয়নি। তারা যে আন্তরিকভাবে ভুল সংশোধন করতে চাইছে, তা থেকেই বোঝা যায় তারা বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়েছে।'
তার মতে, সমস্যা শুধু প্রাডাকে ঘিরে নয়, সমস্যাটি আরও গভীরে—যেখানে পশ্চিমা বিশ্বে পরিচালিত ব্র্যান্ডগুলো একরকমের অভিজাত ও একমুখী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে অন্য দেশের সংস্কৃতি ও ভোক্তাদের মূল্যায়ন করে।
'ফ্যাশন শিল্পের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হল বৈচিত্র্যের অভাব। ব্র্যান্ডগুলোর উচিত বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষকে তাদের টিমে অন্তর্ভুক্ত করা, যাতে তারা বিশ্বকে আরও বাস্তব ও অন্তর্ভুক্তিমূলকভাবে দেখতে শেখে।'
তবে তিনি এটাও বলেন, ভারতীয় ঐতিহ্যের প্রতি অনেক ব্র্যান্ডের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা আন্তরিক।

সংস্কৃতি চুরির মতো বিষয়টিকে কখনও কখনও অতিরঞ্জিত মনে হলেও আবার অন্যদিকে চোখ খুলে দেয়ার মতো কিছু বাস্তবতাও তুলে ধরে।
দিল্লিভিত্তিক ফ্যাশন লেখক শেফালি ভাসুদেব বলেন, 'আমরা যেখানে নিজেরাই নিজেদের কারিগরদের যথেষ্ট স্বীকৃতি দিই না, অন্যেরা তো সহজেই তাদের অবমূল্যায়ন করবেই।'
দস্তকারের চেয়ারপার্সন লায়লা ত্যাবজি বলেন, 'আমরা হাতে তৈরি দেশীয় চপ্পলের দামে আপত্তি করি, কিন্তু অ্যাসেম্বলি লাইনে নাইকি ট্রেইনার ১০ গুণ দামে কিনতে দ্বিধা করি না।'
তার মতে, নিজেদের ঐতিহ্য ও কারিগরদের যথাযথ সম্মান না দিলে বিদেশি ব্র্যান্ডগুলোর শোষণ চলতেই থাকবে। 'বাস্তব পরিবর্তন তখনই আসবে, যখন আমরা নিজেরাই তাদের সম্মান ও সুরক্ষা দিতে শিখব।'
অনুবাদ: আয়েশা ওয়ারেসা