আন্ধারমানিক: বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামের বাসিন্দাদের দুর্দশার গল্প শোনায় হাতে লেখা যে পত্রিকা
বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী পটুয়াখালীর মহিপুর শহরের মাছের বাজারে স্থানীয় ছোট পত্রিকা 'আন্ধারমানিক'-এর দিন শুরু হয় এক মাছের বাজারে। রাস্তা থেকে মাছ নামানোর জায়গায় নামলে বাতাস লবণ আর মাছের গন্ধ ভরে ওঠে।
মাছ নামানোর জায়গায় পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে রঙিন মাছ ধরার নৌকা। লাল, নীল ও সবুজ রঙের কিছু নৌকা আজ একটু ফিকে দেখাচ্ছে, তবু বাজারের ভিড়ে সেগুলো যেন আরও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে।
জুলাই মাসের শেষের দিকে এই ব্যস্ত মাছের বাজারে বড় বড় মাছের ডিপো আর ছোট ছোট খুঁটির ঘরের মতো দোকান পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকে। টিনের ছাদযুক্ত একটি ছোট দোকানে ৪৪ বছর বয়সী হাসান পারভেজ কালো কটন প্যান্ট হাঁটু পর্যন্ত গুটিয়ে প্লাস্টিকের বাক্সে বরফ ঢালছেন। এই বাক্সগুলোতে তাজা রুপালি ইলিশ মাছ রাখা হয়। প্রতিদিন ঢাকা, বরিশালসহ বিভিন্ন শহরে এসব মাছ পাঠানো হয়।
চারপাশে প্লাস্টিকের ব্যারেল ও বাক্সে ভরা তাজা মাছের মধ্যেই কাজ করছেন হাসান। আর ঘাট থেকে নৌকা আসার এবং বের হওয়ার সাথে সাথে ডিজেলচালিত ট্রলারের একটানা শব্দ বাতাসে ভেসে বেড়ায়।
হাসান মৃদু হাসি দিয়ে বলেন, 'সকালটা খুব ব্যস্ত থাকে, আর মাছের বাজারে সব সময়ই বিশৃঙ্খলা থাকে।'
হাসান বর্ষার সময় মহিপুর বাজারে প্রতিদিন মাছ বাছাই, ওজন করা ও সাদা থার্মোকল বাক্সে প্যাক করার কাজ করেন। শুকনো মৌসুমে তিনি কাছের ইটভাটায় কাজ করেন, আর শীতকালে—বিশেষ করে ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে তিনি বাজারে শুঁটকি'বিক্রি করেন।
মহিপুর বাজারে হাসানের দিন শুরু হয় ভোর ৪টায় ফজরের নামাজ ও দুধ ছাড়া এক কাপ চায়ের সঙ্গে। তিনি দৈনিক প্রায় ৬০০ টাকা আয় করেন।
আজও যথারীতি তিনি কাজ নিয়ে অধৈর্য হয়ে পড়েছেন, কারণ এই কাজ তার পরিবারের জন্য আয়ের উৎস হলেও,পাশাপাশি তার আরও একটি পেশা রয়েছে। তিনি হাতে লেখা স্থানীয় ছোট পত্রিকা 'আন্ধারমানিক'-এর প্রধান সম্পাদক। পত্রিকাটির নামের অর্থ 'অন্ধকারের রত্ন', যা পাশের একটি নদীরও নাম। হাসান ও তার সহকর্মীরা এটি দুই মাস অন্তর তার বাড়ি থেকে প্রকাশ করেন। তার গ্রামের নাম পশ্চিম সোনাতলা, যা মাছের বাজার থেকে প্রায় এক ঘণ্টা দূরত্বে এবং ঢাকা থেকে আট ঘণ্টারও বেশি দূরত্বে অবস্থিত।
হাসান এবং তার প্রতিবেদকদের দল যেহেতু কম্পিউটারের মালিক নয় বা ব্যবহার করে না, তাই পত্রিকাটি হাতে লেখা হয় এবং তারপর ফটোকপি করা হয়। তারা মনে করেন, যেখানে আগে কোনো পত্রিকা পৌঁছাতো না, সেখানে হাতে লেখা 'আন্ধারমানিক' পত্রিকাটি আরও প্রাণবন্ত লাগে এবং তাদের সম্প্রদায়কে একে অপরের কাছে নিয়ে আসে।
প্রায় ১১টার দিকে মাছের শেষ বাক্সগুলো গাড়িতে তোলা হয়ে এবং দোকানের মেঝে পরিষ্কার হয়ে গেলে হাসান বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নেন।
তিনি একটি ব্যাটারি-চালিত ভ্যানে চড়ে বাড়ি ফেরেন। ভ্যান-গাড়িতে ওঠার সময় হাসান জানান, তিনি ২০১৩ সালে সালমা বেগমকে বিয়ে করেন এবং তাদের তিন কন্যাসন্তান রয়েছে। তাদেরকে নিয়ে তিনি যে বাড়িতে থাকেন, সেটি 'আন্ধারমানিক' পত্রিকার প্রধান কার্যালয় হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে। এখানেই তিনি প্রতিটি প্রকাশনা চক্রে একবার বা দুইবার দলের সঙ্গে দেখা করেন।
'আমার গ্রাম'
ভোলাগঞ্জের ভাঙা, কাঁচা রাস্তা এবং ধানক্ষেত আর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছোট ছোট বাড়ির মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হাসান বোঝালেন কীভাবে তিনি পত্রিকা চালু করার সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি বলেন, 'আমি ছোটবেলায় অনেক কবিতা লিখতাম।' ভ্যানের আওয়াজ উপেক্ষা করেই তিনি জোরে বলতে থাকেন, 'পড়া-লেখা সবসময়ই আমাকে টানত।'
তিনি ভারতের নোবেলজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা এবং 'সেল্ফ-হেল্প' বই (আত্ম-উন্নয়নমূলক বই) পড়তেন। কিন্তু পড়াশোনার প্রতি ভালোবাসা থাকা সত্ত্বেও, অর্থনৈতিক কারণে স্কুল শেষ করতে পারেননি। ১৪ বছর বয়সে দুই ভাই ও দুই বোনের বড় ভাই হিসেবে তাকে পরিবারের খরচ চালানোর জন্য দিনমজুরের কাজ করতে হয়। তিনি বলেন, 'আমার ১৯৯৬ সালে এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু অর্থের অভাবে দিতে পারিনি।'
হাসান ৩৫ বছর বয়সে ২০১৫ সালে শেষ পর্যন্ত এসএসসি পাশ করেন। দুই বছর পর হাইস্কুল শেষ করেন। ২০২১ সালে তিনি কলাপাড়া থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে একটি কলেজে আর্টসে ব্যাচেলর ডিগ্রিতে ভর্তি হন। পরিবারের খরচ চালানো, পত্রিকা এবং পড়াশোনা—এই তিনটি একসঙ্গে সামলানোয় তিনি এখন দ্বিতীয় সেমিস্টারে পড়ছেন। হাসান বলেন, এই যাত্রা খুব গুরুত্বপূর্ণ, কারণ পত্রিকার ভবিষ্যৎ এখানেই নির্ভর করছে।
হাসান তার পত্রিকাটি জেলায় সরকারিভাবে একটি মিডিয়া সংস্থা হিসেবে নিবন্ধন করতে চান। তিনি মনে করেন, এটি রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে পত্রিকাটি রক্ষা করতে সাহায্য করবে। তিনি বলেন, 'এর জন্য নিয়ম হলো প্রকাশককে স্নাতক ডিগ্রিধারী হতে হবে।'
তার মাথায় পত্রিকার ধারণা আসে ২০১৬ সালের জুনে। তখন হাসান ঢাকার পরিবেশ সাংবাদিক রফিকুল মণ্টুর সঙ্গে পরিচিত হন। মণ্টু বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে জলবায়ু সংকটের প্রভাব নিয়ে কাজ করেন এবং সারা বছর ভ্রমণ করেন। একদিন হাসান দেখেন তিনি আন্ধারমানিক নদীর ছবি তুলছেন। কৌতূহলবশত হাসান তার সঙ্গে কথা বলতে যান।
আলাপের সময় হাসান কিছু কবিতা ও লেখা শেয়ার করেন। সেগুলোতে তিনি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, তার গ্রামের কৃষকদের জন্য ক্রমেই প্রতিকূল হয়ে ওঠা আবহাওয়া, ইত্যাদি সমস্যা তুলে ধরেন। এই ধরনের কোনো খবর স্থানীয় কোনো পত্রিকায় প্রকাশিত হতো না, আর স্থানীয় সরকারের সহায়তাও অনেক দেরিতে আসে। ফলে স্থানীয় মানুষ নিজেদের উপেক্ষিত ভাবে।
মণ্টু হাসানের কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে তাকে উৎসাহ দেন এবং এই গল্পগুলোকে পত্রিকায় ফুটিয়ে তুলতে বলেন।
মন্টু বলেন, 'তিনি (হাসান) তার সম্প্রদায়ের জন্য কিছু করতে চেয়েছিলেন। আমি তাকে বলেছিলাম, তিনি একটি পত্রিকা প্রকাশ করতে পারেন এবং স্থানীয় খবর পরিবেশন করতে পারেন। আমি বলেছিলাম, তার সম্প্রদায়ের মধ্যে আস্থা ও আশা ছড়ানোর দিকে মনোনিবেশ করা উচিত।'
মন্টু প্রস্তাব দেন সেই নদীর নামে পত্রিকার নাম রাখার, যেখানে তার সাথে হাসানের প্রথম আলাপ হয়। এছাড়া তিনি হাসানকে শিখিয়েছিলেন, কীভাবে একটি প্রতিবেদন লিখতে হয়, শিরোনাম তৈরি করতে হয় এবং মোবাইল ফোন দিয়ে ছবি তুলতে হয়।
হাসান বলেন, 'মন্টু ভাই আমার উস্তাদ। তিনি আমাকে অনুপ্রাণিত করেছেন গ্রামের মানুষ এবং তাদের জীবনের গল্প লিখতে—সমস্যা ও সমাধান দুইটাই। আমি কখনও ভাবিনি যে আমি পত্রিকার প্রকাশক হতে পারব, কারণ আমার পক্ষে তা সম্ভব নয়। কিন্তু আন্ধারমানিক প্রকাশিত হচ্ছে আজ ছয় বছর।'
পশ্চিম সোনাতলার শ্রমজীবী সম্প্রদায়ের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে পত্রিকার প্রথম সংখ্যা ২০১৯ সালের ১ মে শ্রমিক দিবসে প্রকাশিত হয়।
পৃথিবী ভুলে গেছে
দুপুরের পর হালকা বৃষ্টি নামে আর হাসান তার গ্রামের কাছাকাছি এসে পৌঁছান। রাস্তার দুইপাশে ছড়িয়ে আছে সবুজ ধানক্ষেত, আর পথের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলো বৃষ্টির পানিতে ভিজে গেছে।
রাস্তার পাশে কয়েকটি পুকুরে হাঁস ডুব দিয়ে সাঁতার কাটছে। ভ্যান রাস্তার ওপর দিয়ে কেঁপে কেঁপে চলতে থাকে, শেষ পর্যন্ত পথ যেন থেমে যায়। এখান থেকে হাসানের বাড়ি পৌঁছাতে প্রায় ১০ মিনিটের কাদাযুক্ত পথ পায়ে হেঁটে যেতে হয়।
হাসান বলেন, 'আসলে এই রাস্তা আমার বাড়ি পর্যন্ত আসে। কিন্তু বাস্তবে এর অবস্থা এরকম।'
পায়ে হেঁটে যাওয়ার জন্য একমাত্র রাস্তা হলো কাদাযুক্ত, হালকা পিচ্ছিল একটি চওড়া রেখা। বৃষ্টির পানি পরিস্থিতি আরও খারাপ করেছে। গ্রামবাসীদের পায়ে জুতো বা স্যান্ডেল না পরে, হাতে নিয়ে হেঁটে যেতে হয়।
মৌসুমের ফলে কাদায় ভরা সরু পথ ছাড়া হাঁটার উপায় নেই গ্রামের মানুষদের। চামড়ার জুতো বা স্যান্ডেল পরে হাঁটলে কাদায় আটকে গিয়ে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই গ্রামের মানুষদের অনেকে হাতে জুতো নিয়ে খালি পায়ে হাঁটেন।
'জুতো পরে হাঁটা সম্ভব নয়, কারণ কাদায় আটকে গিয়ে কেউ পড়ে যেতে পারে,' বলেন হাসান। তিনি তাড়াহুড়া করে তার দলের সঙ্গে দেখা করার জন্য যাচ্ছেন। তার দল দুপুর ১টার সভায় বসবে আগস্ট সংখ্যার জন্য গল্প ও প্রতিবেদনের পরিকল্পনা করতে। এই পত্রিকা শুরু হয়েছিল মাত্র ১০ জন সহযোগীকে নিয়ে, এখন এটি ১৭ জন স্বেচ্ছাসেবী রিপোর্টার ও ফটোগ্রাফারের একটি দলে পরিণত হয়েছে।
হাসান বলেন, 'আমাদের সভায় গল্পের আইডিয়া শেয়ার করি, কিন্তু অনেক সময় নিজেদের জীবন ও পরিবারের গল্পও বলি। বেশির ভাগ সময় আমার স্ত্রী আমাদের চা ও মুড়ি দেয়।'
পশ্চিম সোনাতলা গ্রামে ৬১৮টি পরিবার বাস করে, যারা মূলত কৃষক, জেলে ও দৈনিক মজুর। এখানে বিদ্যুৎ পৌঁছেছে মাত্র কয়েক বছর আগে।
হাসান বলেন, 'গ্রামে শুধু একটি কমিউনিটি ক্লিনিক আছে, সেখানে কোনো ডাক্তার নেই। গ্রামে কেউ অসুস্থ হলে তাদের ছোট উপজেলা শহর কলাপাড়ার হাসপাতালে নিতে হয়, যা গাড়িতে এক ঘণ্টার পথ।'
তিনি আরও বলেন, 'দেশব্যাপী বা আঞ্চলিক কোনো পত্রিকা গ্রামে আসে না, আর অধিকাংশ বাড়িতে টিভিও নেই। যারা স্মার্টফোন ব্যবহার করেন, তারা সেখানে খবর দেখে, তবে ইন্টারনেটও এতটাই খারাপ যে সেটাও প্রায় সম্ভব হয় না।' তিনি নিজের মোবাইল ফোনটি দেখান, যেখানে কোনো নেটওয়ার্ক নেই।
হাসান বলেন, 'আমাদের এলাকা এতটাই দূরবর্তী এবং তথ্য থেকে বিচ্ছিন্ন যে আমাদের মনে হয় পৃথিবী আমাদের ভুলে গেছে। এই অনুভূতিই আমাকে আন্ধারমানিক শুরু করার অনুপ্রেরণা দিয়েছে। এটি আমাদের নিজস্ব কমিউনিটি পত্রিকা, যাতে আমরা নিজেদের গল্প বলতে পারি।'
দলটি ছোট, তবে বৈচিত্র্যময়
হাসানের বসার ঘরের একটি দেয়াল ফ্রেম করা পত্রিকার কাটিং দিয়ে ভরা। ঘরে কয়েকটি তাক রয়েছে, যেখানে বাংলা ভাষার বই রাখা। মাঝখানে এক দীর্ঘ কাঠের টেবিল, যেখানে হাসানের সাংবাদিকরা জড়ো হন। তারা কাদা-মাটির পথে হেঁটে একে একে আসেন। আজ তিনজনই ভারী বৃষ্টি সহ্য করে সেখানে পৌঁছেছেন।
প্রথমে আসেন আব্দুল লতিফ। তারপর রুশিয়া বেগম এবং সবার শেষে আসেন নজরুল ইসলাম বিলাল। তারা ঘরে প্রবেশ করেন মুখে হাসি নিয়ে, একে অপরকে জিজ্ঞেস করেন, 'কেমন আছেন?'
দলটি ছোট, তবে বৈচিত্র্যময়। সবাই একে অপরের কাছাকাছি গ্রামে বাস করেন। আব্দুল (৪২) স্থানীয় এক উচ্চ বিদ্যালয়ের ইংরেজি শিক্ষক। নাজরুল (৩১) একজন ইলেকট্রিশিয়ান। রুশিয়া (৪৩) দলের তিনজন নারী সদস্যের একজন এবং পশ্চিম সোনাতলায় নিজের বাড়ি থেকে একটি সেলাই ব্যবসা চালান।
আজ ভারী বৃষ্টির কারণে মিটিংয়ে আসতে পারেননি দলের আরও দুই মূল সদস্য। একজন সাহানা বেগম (৫৫), যিনি পোলিওর কারণে ডান পায়ে খোঁড়া। সাহানাও সেলাই করেন, পশ্চিম সোনাতলায় থাকেন এবং মহিলাদের বিষয় নিয়ে লেখেন। আরেকজন আছেন আশিস ঘরামি (২৯), দলটির একমাত্র হিন্দু সদস্য। তিনি বাংলাদেশের একটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্য, যারা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বৈষম্যের শিকার হয়েছেন বলে খবর রয়েছে।
দলের অন্যান্য সদস্যরা হয় মোটর রিকশা চালান অথবা কৃষক, আর কেউ কেউ বেকার।
আব্দুল লতিফ বলেন, 'আমরা একটি সমবায় হিসেবে কাজ করি। আমাদের পত্রিকা স্থানীয় খবর, কমিউনিটি অনুষ্ঠান এবং পশ্চিম সোনাতলা ও কখনও কখনও আশেপাশের গ্রামগুলোর খবর প্রকাশ করে।' তিনি আরও করেন, 'এই সংখ্যায় আমি খারাপ রাস্তার পরিস্থিতি নিয়ে লিখব। দেখাবো মানুষ কীভাবে বর্ষার সময়ে এর জন্য ভোগান্তি সহ্য করছে।'
আব্দুলের স্কুল তার বাড়ি থেকে তিন কিলোমিটার দূরে এবং প্রতিদিন সেখানে পৌঁছতে হলে তাকে নৌকা করে আন্ধারমানিক নদী পার হতে হয়।
তিনি বলেন, 'সংকটই আন্ধারমানিক প্রকাশিত হওয়ার কারণ। হাসান যেভাবে আমাদের গ্রামের সমস্যা নিজের লেখার মাধ্যমে তুলে ধরেছেন, তা আমাকে দলের সঙ্গে যুক্ত হতে অনুপ্রাণিত করেছে।'
'একটি সুন্দর ঘটনা ঘটল'
রুশিয়া হাসানের দলের সঙ্গে শুরু থেকেই কাজ করছেন। তিনি জানান, দশম শ্রেণি শেষ করার পর গ্রামের এক কৃষকের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। পরিবারকে সাহায্য করার জন্য তিনি একটি দর্জির ব্যবসা শুরু করেন, যা গ্রামে লুকানো সমস্যাগুলোকে সামনে আনে। রুশিয়া বলেন, 'যখন মহিলারা তাদের কাপড় সেলাই করার জন্য আমার কাছে আসে, তখন তারা তাদের মন খুলে কথা বলে। আমি এমন সমস্যার কথা শুনি যা বাইরে কখনো আসে না—বিশেষ করে মহিলারা ও শিশুদের নিঃশব্দে ভোগা কষ্টগুলো।'
রুশিয়ার শোনানো একটি গল্পের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন আবেজান বেগম নামের একজন নারী, যিনি পশ্চিম সোনাতলা থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরের রহমতপুর গ্রামের বাসিন্দা। ২০২৩ সালে ভয়ংকর বন্যায় তার বাড়ি ধ্বংস হয় এবং তাকে পলিথিন দিয়ে তৈরি খোলা ঘরে থাকতে হয়।
আবেজান বেগম বলেন, 'আমার গল্প হাসান তার ফেসবুক পেজে শেয়ার করেছিলেন। এরপর একটি সুন্দর ঘটনা ঘটল—বিদেশে থাকা বাংলাদেশিরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন। মোট ৬০ হাজার সাহায্য পাওয়ার মাধ্যমে আমি নতুন বাড়ি বানাতে পারি এবং কিছু ছাগল কিনতে পারি।'
রুশিয়া জানান, আজ আবেজান আবার মর্যাদাপূর্ণ জীবন যাপন করছেন তিন কামরার একটি বাড়িতে।
তারা স্থানীয় মানুষের গল্প তুলে ধরেন। এক সংখ্যায় হাসান তার গ্রামের এক মেয়ে রুবিনাকে নিয়ে কবিতা লেখেন। রুবিনা তার দাদী এবং মানসিক সমস্যায় ভুগছে এমন মায়ের সঙ্গে ভাঙাচোরা কাঁচা ঘরে থাকত। দারিদ্র্যের কারণে রুবিনাকে খাবারের জন্য ভিক্ষা করতে হত।
হাসান কবিতাটি প্রকাশ করার পর এটি অনেক পড়া হয় এবং স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তাদের নজরে আসে। কর্মকর্তারা রুবিনা এবং তার পরিবারকে কিছু জমি এবং একটি বাড়ি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
হাসান এবং তার দল প্রায়ই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে মানুষের গল্প প্রকাশ করেন। বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা বন্যা, তাপপ্রবাহ, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং লবণাক্ত পানির প্রবেশের জন্য বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ।
বিলাল নিজে কৃষক এবং ছোট একটি ধানক্ষেতের মালিক। তিনি অন্য কৃষকদের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত মনে করেন, বিশেষ করে যখন তিনি দেখেন যে প্রতিবার বৃষ্টিপাত অপ্রত্যাশিত হওয়ায় তার ফসল কমে যাচ্ছে।
হাসান বলেন, 'পরবর্তী সংখ্যায় আমি বর্ষার সময় স্থানীয় দিনমজুরদের সংগ্রামের গল্প লিখব।'
হাসান ও তার দল প্রতিবেদন জমা দেন নোটবুক থেকে। হাসান বলেন, 'আমাদের প্রতিবেদকরা তাদের গল্পগুলো হাতে লেখা নোট আকারে পাঠান। আমি সিদ্ধান্ত নেই কোনটি কাগজে যাবে এবং ভাষা সম্পাদনা করি।' এরপর তিনি এ-৩ সাইজের কাগজে ফাউন্টেন পেন দিয়ে সম্পূর্ণ প্রতিবেদন ও গল্পগুলো লেখেন এবং কলাপাড়ার একটি কপি শপে ফটোকপি করান।
প্রতিটি পত্রিকা চার পৃষ্ঠার এবং রঙিন প্লাস্টিকের টেপ দিয়ে বাঁধা হয়। হাসান ৩০০টি কপি তৈরি করেন, যার কপি প্রতি খরচ প্রায় ১০ টাকা। লেখালিখি, ফটোকপি এবং বাঁধাইয়ের কাজ সপ্তাহখানেক সময় লাগে।
প্রকাশের পর হাসান ও তার দল পত্রিকাটি বিতরণ করে পশ্চিম সোনাতলা এবং নিকটবর্তী গ্রাম—টুঙ্গিবাড়ি, চাঁদপাড়া, রহমতপুর এবং ফতেহপুরে। তাদের কোনো স্টল বা সাবস্ক্রিপশন ব্যবস্থা নেই, পুরোপুরি স্থানীয় চাহিদার ওপর নির্ভরশীল। প্রয়োজনে বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়, অথবা খরচ মূল্যে বিক্রি করা হয়। হাসান বলেন, 'আমাদের গ্রামে মানুষদের অনেকেরই অবস্থা খারাপ, তাই বেশিরভাগ সময় এটি বিনামূল্যে দেওয়া হয়। সত্যি বলতে, আমি এর থেকে কোনো অর্থ উপার্জন করি না। আমার লক্ষ্য তা নয়।'
একজন অনুগত পাঠক
পশ্চিম সোনাতলার ৮৪ বছর বয়সী আজিজুর রহমান খান এই আন্ধারমানিকের অন্যতম অনুগত পাঠক এবং হাসানের প্রতিবেশী। গত দুই বছর ধরে তিনি প্রতিটি সংখ্যা নিয়মিত পড়ছেন এবং খুশি মনে প্রতিটি কপির জন্য অর্থ প্রদান করেন, যা হাসান ব্যক্তিগতভাবে পৌঁছে দেন।
আজিজুর বলেন, 'আমি পারভেজকে (হাসান) ছোটবেলা থেকেই চিনি। আমি তার আগ্রহ এবং আমাদের গ্রামবাসীর সুখ-দুঃখের গল্প বলার আবেগকে ভালোবাসি। যখন পৃথিবীর বাকি সবাই আমাদের ভুলে গিয়েছিল, তখন আন্ধারমানিক আমাদের গল্প সবার কাছে পৌঁছে দিচ্ছে।'
সাবেক কর কর্মকর্তা আজিজুর খান বলেন, তিনি হাসানের প্রকাশনার জন্য নেওয়া আর্থিক ঝুঁকি বুঝতে পারেন। তিনি বলেন, 'আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করি যে এমন এক দিন আসবে, যখন সব কিছু ভালোমতো ঠিক হয়ে যাবে এবং এই পত্রিকা দুই সপ্তাহে একবার প্রকাশিত হবে।'
আজিজুর আন্ধারমানিক নদীর কাছ থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে থাকেন। তিনি জানান, পত্রিকার নাম এসেছে দুটি বাংলা শব্দ থেকে–'আন্ধার' অর্থ অন্ধকার এবং 'মানিক' অর্থ রত্ন।
বৃষ্টিভেজা, অন্ধকার মেঘাচ্ছন্ন আকাশের দিকে তাকিয়ে তিনি ধীরে বললেন, 'হাসান আমাদের আন্ধারমানিক–অন্ধকারে জ্বলজ্বলে এক রত্ন।'
অনুবাদ: তাসবিবুল গনি নিলয়
