বিশ্বে প্রথমবার মানব শরীরে ইনসুলিন উৎপাদন; জিন-পরিবর্তিত কোষ প্রতিস্থাপনেই মিলেছে সাফল্য
টাইপ-১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষরা সাধারণত সারাজীবন ইনসুলিন ইনজেকশন বা পাম্পের ওপর নির্ভরশীল থাকেন। এই রোগে শরীরের সেই কোষগুলো ধ্বংস হয়ে যায় যা ইনসুলিন নামের হরমোন তৈরি করে। ইনসুলিনের কাজ হল রক্তে চিনি নিয়ন্ত্রণে রাখা। ইনসুলিন না থাকলে রক্তে শর্করা বেড়ে যায় এবং হার্ট অ্যাটাক, চোখের সমস্যা, কিডনির অসুখ, স্নায়ু ক্ষয়সহ বিভিন্ন সমস্যা হতে পারে।
তবে সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি মানুষকে নিজের শরীরে ইনসুলিন তৈরি করার সুযোগ দিতে পারে।
বিশ্বে প্রথমবারের মতো টাইপ-১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত একজন পুরুষ রোগী নিজের শরীরে ইনসুলিন উৎপাদনে সক্ষম হয়েছেন।
৪২ বছর বয়সী ওই রোগীকে প্রথমবারের মতো জেনেটিকভাবে পরিবর্তিত ইনসুলিন উৎপাদনকারী কোষ প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। অর্থাৎ, বিজ্ঞানীরা এমন কোষ তৈরি করেছেন যা রোগীর শরীরের প্রতিরক্ষা শক্তি ভুলভাবে আক্রমণ করতে পারে না। এই চিকিৎসা এমন একটি বড় পদক্ষেপ, যেখানে রোগীর জন্য দীর্ঘমেয়াদী ইমিউনোসাপ্রেসিভ ওষুধ (যা শরীরের প্রতিরক্ষা কমিয়ে দেয়) দরকার হয়নি।
উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেল বায়োলজিস্ট পের-ওলা কার্লসন বলেন, 'এটি আমার বৈজ্ঞানিক জীবনের সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ মুহূর্ত। এটি কেবল ডায়াবেটিস নয়, অন্যান্য অটোইমিউন রোগেও নতুন সমাধানের পথ খুলছে।'
গবেষকরা প্রায় ৮ কোটি পরিবর্তিত কোষ রোগীর বাহুর পেশীতে ইনজেকশন করেছিলেন। ১২ সপ্তাহ পরও কোষগুলো জীবিত ছিল এবং ইনসুলিন তৈরি করছিল। যদিও রোগীকে এখনও কিছু ইনসুলিন নিতে হয়েছিল, কোষগুলো প্রত্যাখ্যানের কোনো লক্ষণ দেখায়নি।
দশকের পর দশক ধরে বিজ্ঞানীরা কার্যকরী বেটা কোষ পুনরায় তৈরি করতে চেষ্টা করছেন। অতীতের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে, কারণ রোগীর ইমিউন সিস্টেম নতুন কোষগুলোকে ধ্বংস করে। অতিরিক্ত ইমিউনোসাপ্রেসিভ ওষুধ প্রয়োগ করা হলেও সংক্রমণ ও ক্যান্সারের ঝুঁকি থাকে।
প্রথমে মৃত দাতার প্যানক্রিয়াসের কোষগুলোকে আলাদা করা হয়। তারপর 'সিআরআইএসপিআর' নামের জিন কেটে-ছাঁট করার প্রযুক্তি ব্যবহার করে দুটি বিশেষ জিন নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে।
জিনগুলো নিষ্ক্রিয় হলে শরীর সহজে কোষগুলোকে আক্রমণ করতে পারে না। এছাড়া কিছু কোষে এমন পরিবর্তন আনা হয়েছে যা শরীরের অন্যান্য রক্ষাকর্তা কোষকে আক্রমণ করতে বাধা দেয়। তিন মাস পর দেখা গেছে, কোষগুলোর একটি অংশ টিকে আছে এবং ইনসুলিন তৈরি করছে।
প্রতিস্থাপনের আগে রোগীর শরীরে প্রাকৃতিক ইনসুলিন ছিল না। কিন্তু চার থেকে বারো সপ্তাহের মধ্যে তার শরীর কিছুটা নিজে ইনসুলিন তৈরি করতে শুরু করে। গবেষকরা বলেন, কোষগুলো পুরো ইনসুলিনের চাহিদা পূরণ করতে পারে না, তাই রোগীকে অতিরিক্ত ইনসুলিন দেওয়া হচ্ছে। চার ধরনের হালকা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা গেলেও সেগুলো গুরুতর নয়।
ওয়েইল কর্নেল মেডিসিনের বিশেষজ্ঞ লরা আলোনসো বলেন, 'টাইপ ১ ডায়াবেটিসে বেটা কোষ পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে কোষভিত্তিক চিকিৎসাই একমাত্র সমাধান।'
কার্লসন জানান, তারা রোগীর ওপর নজর রাখবেন এবং কোনো নেতিবাচক প্রভাব না দেখা গেলে আরও বেশি কোষ দেওয়া হবে। একই সঙ্গে তারা এমন স্টেম-সেল তৈরি করছেন যা প্রচুর পরিমাণে ইনসুলিন উৎপাদনকারী কোষ তৈরি করতে পারবে।
ইয়েলের বিশেষজ্ঞ কেভান হেরল্ড বলেন, 'এখনও পুরোপুরি নির্ভরযোগ্য বলা যায় না, তবে এটি রোগের দিকে এক নতুন দিক খুলেছে। প্রচণ্ড আশা রয়েছে।'
