স্থলপথে কমায়, চট্টগ্রাম বন্দরে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যের রেকর্ড চাপ

প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যে চলছে নাটকীয় রদবদল। নয়াদিল্লির বিধিনিষেধ আরোপের পর স্থলবন্দরগুলো কার্যত অচল হয়ে পড়ায় দুই দেশের আমদানি–রপ্তানিকারকরা ছুটছেন চট্টগ্রাম বন্দরের দিকে—যা একদিকে রেকর্ড পরিমাণে পণ্য প্রবাহ বাড়াচ্ছে, অন্যদিকে দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দরকে বাড়তি চাপে ফেলছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুলাই মাসে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ভারতের সঙ্গে আমদানি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় তিনগুণেরও বেশি বেড়েছে, আর রপ্তানিও বেড়েছে প্রায় তিনগুণ।
জুলাইয়ে আমদানির পরিমাণ দাঁড়ায় ৪ লাখ ৭৯ হাজার ৬২৫ টনে—যা পরিমাণের দিক থেকে আগের বছরের একই মাসের চেয়ে ২১৩ শতাংশ বেশি। আর এর আর্থিক মূল্য ৮০ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫২১ মিলিয়ন ডলারে। অন্যদিকে, রপ্তানির পরিমাণ ১৭৬ শতাংশ ও মূল্য ৩৮৫ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ১৮ হাজার ৭৪১ টন ও ৭৪.৯৭ মিলিয়ন ডলারে।
এই প্রবৃদ্ধি গেল মাস আগস্টেও অব্যাহত থাকে। ২৮ আগস্ট পর্যন্ত এনবিআরের সাময়িক তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে রপ্তানি গত বছরের ৮,১১৬ টন (১৮.২৬ মিলিয়ন ডলার) থেকে বেড়ে ৭৬,২৫৫ টন হয়েছে, যার মূল্য ৬৪.৬৬ মিলিয়ন ডলার। তবে আমদানির পরিমাণ ৩১ শতাংশ কমলেও আর্থিক মূল্য সামান্য বেড়েছে।
স্থলবন্দর হয়ে রপ্তানি কার্যত বন্ধ হওয়ার পেছনে মূল কারণ ভারতের নতুন বিধিনিষেধ। চলতি বছরের মে মাস থেকে দিল্লি একযোগে বেশ কিছু বাংলাদেশি পণ্যের—যেমন তৈরি পোশাক, পাটজাত দ্রব্য ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্য—স্থলপথে রপ্তানি নিষিদ্ধ করে। ফলে বাধ্য হয়ে এসব পণ্য এখন সমুদ্রপথে পাঠানো হচ্ছে। এর আগে, এপ্রিল মাসে বাংলাদেশও ভারতের সুতা আমদানি স্থলবন্দর দিয়ে নিষিদ্ধ করে।
এনিয়ে ভারতের সঙ্গে আলোচনার প্রচেষ্টাও থমকে রয়েছে, যেকারণে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, দীর্ঘমেয়াদি অশুল্ক বাধা—যেসব খাত বাড়তি সমুদ্র বাণিজ্যের খরচ বহন করতে পারে না, তাদের ওপর বড় ধরনের চাপ ফেলবে। সীমান্ত অঞ্চলে ইতোমধ্যেই কর্মসংস্থান কমে আসছে।
তারা আরও বলছেন, ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যিক অচলাবস্থা নিরসনে সরকারকে সক্রিয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
স্থলবন্দর কার্যত অচল
ভারতের নতুন বিধিনিষেধের ফলে স্থলবন্দরগুলোতে পড়েছে বড় ধাক্কা। এনবিআর জানায়, জুলাইয়ে স্থলপথে চালান ২৬ শতাংশ কমেছে, আর আগস্টে কমেছে ৫২ শতাংশ—যা সাম্প্রতিক সময়ে সর্বোচ্চ পতন।
যেখানে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরার সীমান্তলাগোয়া স্থলবন্দরগুলো ছিল দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের মূল ভরসা, সেখানে এখন প্রায় বন্ধ অবস্থা। ফলে ব্যবসায়ীরা বাধ্য হচ্ছেন চট্টগ্রাম হয়ে সমুদ্রপথ ব্যবহার করতে, যা শিপিং খরচ ও সময় দুটোই বাড়াচ্ছে।
অবস্থা আরও জটিল হয় যখন ভারত গত ৮ এপ্রিল ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বন্ধ করে দেয় এবং তার এক সপ্তাহ পর বাংলাদেশের তুলা আমদানিও নিষিদ্ধ করে।
পোশাক খাত টিকে আছে, ধাক্কা খেল অন্যরা
এর প্রভাব পড়েছে বিভিন্ন শিল্পের ওপর, তবে খাতভেদে তা ভিন্ন। ভারতের বাজারে বাংলাদেশের মোট রপ্তানির প্রায় ৩৫ শতাংশ আসে পোশাক খাত থেকে, যা স্থিতিশীল রয়েছে। জুলাই মাসে এ খাতের রপ্তানি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৯ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ কোটি ২৮ লাখ ডলারে।
"আমাদের উৎপাদন সক্ষমতা শক্তিশালী। ভারতীয় ক্রেতারাই অতিরিক্ত মেরিটাইম কস্ট ক্যারি করতেছে, ফলে পোশাক রপ্তানি টিকে আছে," বলেন বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সাবেক পরিচালক বেলায়েত হোসেন।
তবে সবচেয়ে বড় ধাক্কা লেগেছে পাট খাতে। জুলাই মাসে এ খাতের রপ্তানি ধসে গিয়ে দাঁড়ায় মাত্র ৩৪ লাখ ডলারে, যা ৭৪ শতাংশ কমেছে। খাদ্যপণ্য রপ্তানিও ১৭ শতাংশ কমেছে।
চট্টগ্রামভিত্তিক বিএসপি ফুড প্রোডাক্টস, যারা এতদিন ভারতের আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্যের বাজারে রপ্তানি করত, এখন তারা কর্মীসংখ্যা কমিয়ে এনেছে ১৫০ থেকে ৬০ জনে। অন্যদিকে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ জানিয়েছে, ভারতের বাজারে তাদের রপ্তানি ১৪ শতাংশ কমেছে। প্রতিষ্ঠানটি এর জন্য উচ্চ ফ্রেইট খরচ এবং নভসেবা বন্দরের দীর্ঘসূত্রতাকে দায়ী করছে।
সরকার ও বিশ্লেষকদের সতর্কতা
বাণিজ্য উপদেষ্টা এস কে বশিরউদ্দিন গত ১২ আগস্ট স্বীকার করেছেন যে ভারতের সঙ্গে আলোচনায় অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। তবে তিনি দাবি করেছেন, বাংলাদেশের রপ্তানি খাত এখনো স্থিতিশীল রয়েছে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান- সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) সতর্ক করে বলেছে, দীর্ঘমেয়াদি নন-ট্যারিফ বাধা টেকসই হবে না। এতে সমুদ্রপথে বাড়তি খরচ বহন করতে অক্ষম খাতগুলো দুর্বল হয়ে পড়বে, এবং সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে ইতোমধ্যেই কর্মসংস্থান সংকট দেখা দিচ্ছে।
ভারতে রপ্তানির প্রবণতা দীর্ঘদিন ধরেই ঊর্ধ্বমুখী, এবং এটি আরও বাড়বে বলেই আশা করা যায়। তবে পারস্পরিক সুফল নির্ভর করছে এ বাধাগুলো দূর করার ওপর," বলেন চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ।
তিনি আরও বলেন, কেবল চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর নির্ভর করা ঝুঁকিপূর্ণ। "এখনই সময় মংলা বন্দরের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করার। কারণ ঢাকা থেকে এখন সহজেই সেখানে সহজেই পৌঁছানো যায় এবং ভারতের নভাসেবা বন্দরেরও কাছাকাছি অবস্থিত।"
চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর চাপ
বাংলাদেশের ৯০ শতাংশেরও বেশি বৈদেশিক বাণিজ্য যেখান দিয়ে সম্পন্ন হয়, সেই চট্টগ্রাম বন্দর ইতিমধ্যেই জট, সীমিত ইয়ার্ড ও জাহাজ বিলম্বে ভুগছে। ভারতের জন্য হঠাৎ বাড়তি চালান এই বন্দরকে আরও চাপে ফেলেছে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক বলেন, "ভারতগামী বাড়তি রপ্তানির চাপ সামলাতে আমরা প্রস্তুত আছি। আমাদের সক্ষমতা ১০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে।"
তবে ব্যবসায়ী নেতাদের মতে, শুধু বাড়তি ব্যবস্থা যথেষ্ট নয়। তারা দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা বে ও লালদিয়া টার্মিনাল দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি তুলছেন, যাতে জট কমে ও জাহাজের টার্নঅ্যারাউন্ড টাইম কমে।
স্থিতিশীল হলেও ভঙ্গুর প্রবৃদ্ধি
রাজনৈতিক অস্থিরতা সত্ত্বেও, ২০২৪–২৫ অর্থবছরে ভারতের বাজারে বাংলাদেশের মোট রপ্তানি ১১ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে রেকর্ড ১৭৬ কোটি ডলারে। তবে ২০২৫ সালের জুনে তা ১৯ শতাংশ হ্রাস পায়, যা বাণিজ্যে বাধা ও বিলম্বের প্রভাবই প্রকাশ করে।
অন্যদিকে ভারতের রপ্তানিতেও অস্থিতিশীলতা লক্ষ করা গেছে—মার্চে যা ১১৬ কোটি ডলারে উঠে জুনে নেমে আসে ৭২ কোটি ৬৮ লাখ ডলারে। জুলাইয়ে তা আবার প্রায় সাড়ে ৯৯ কোটি ডলারে পুনরুদ্ধার হয়।
ভারতীয় হাইকমিশনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার। ২০২৩–২৪ অর্থবছরে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য দাঁড়িয়েছে ১৪ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি, যার মধ্যে বাংলাদেশ থেকে ভারতে রপ্তানি মাত্র ১.৯৭ বিলিয়ন ডলার।
বিশ্লেষকরা সতর্ক করে বলেছেন, এবছরের জুলাই–আগস্টে চট্টগ্রামে অস্বাভাবিক যে প্রবৃদ্ধি দেখা গেছে তা টেকসই নাও হতে পারে। ভারতের সঙ্গে রাজনৈতিক সমাধান এবং বন্দরের সক্ষমতায় দ্রুত বিনিয়োগ না হলে এই ভঙ্গুর অর্জন ভেঙে পড়তে পারে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (র্যাপিড) -এর চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক বলেন, চট্টগ্রাম হয়ে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য করলে খরচ প্রায় ২৫ শতাংশ বেড়ে যেতে পারে। এর বোঝা শেষ পর্যন্ত বহন করতে হবে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদেরকেই, যা দীর্ঘমেয়াদি টেকসই বাণিজ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
তিনি আরও বলেন, "সংকটকালে স্থলবন্দর একধরনের সেফটি ভালভ। দেশের বাজারে কোনো পণ্যের ঘাটতি হলে, সাপ্লাই চেইন স্থিতিশীল করতে আমরা রাতারাতি ভারত থেকে আমদানি করতে পারি। কিন্তু এই সুবিধা বন্ধ হয়ে গেলে সমস্যার মুখে পড়ব।"
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক মইনুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ এখন ভারতের সঙ্গে সবচেয়ে খারাপ কূটনৈতিক সম্পর্কে আছে, যা দুই দেশের অর্থনীতিকেই ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
তিনি বলেন, "বাধাগুলো ভারতের দিক থেকে এসেছে, বাংলাদেশ চেষ্টা করলেও সম্পর্ক উন্নতির সুযোগ সীমিত। তবে আমি আশাবাদী নই, কারণ দিল্লি বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে।"
এই ঝুঁকি এড়াতে চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা ও দক্ষতা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন ড. রাজ্জাক। তার মতে, ভারতের সঙ্গে বর্ধিত বাণিজ্য চাপে বন্দরের কার্যক্রম টেকসই রাখতে হলে এখনই অবকাঠামো উন্নয়ন জরুরি।
তিনি আরও বলেন, ভারতের সঙ্গে উত্তেজনা প্রশমনে বাংলাদেশ সরকারকে সক্রিয় পদক্ষেপ নিতে হবে। উভয় দেশের স্থিতিশীল সম্পর্ককে তিনি "ভূরাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ" বলে অভিহিত করেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অর্থনীতির অধ্যাপক মইনুল ইসলাম মনে করেন, বাংলাদেশ বর্তমানে ভারতের সঙ্গে ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ কূটনৈতিক সম্পর্কে পড়েছে, যা উভয় দেশের অর্থনীতির জন্যই ক্ষতিকর। "প্রতিবন্ধকতাগুলো এসেছে ভারতের দিক থেকে, ফলে বাংলাদেশের হাতে সম্পর্ক উন্নয়ন ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই। কিন্তু আমি তেমন আশাবাদী নই, কারণ নয়াদিল্লি বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে," বলেন তিনি।