শতভাগ কার্গো নিরাপত্তার স্বীকৃতির ৬ দিন পর শাহজালাল বিমানবন্দরে আগুন

আন্তর্জাতিকভাবে শতভাগ কার্গো নিরাপত্তার স্বীকৃতি পাওয়ার মাত্র ছয় দিন পরই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে ছাই হলো হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের (এইচএসআইএ) কার্গো ভিলেজ। ব্যবসায়ীদের আশঙ্কা, ক্ষতির পরিমাণ ১ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে।
ঘটনাটি ঘটল এমন সময়ে, যখন মাত্র এক সপ্তাহ আগেই (১২ অক্টোবর) যুক্তরাজ্যের ডিপার্টমেন্ট ফর ট্রান্সপোর্টের (ডিএফটি) নিরাপত্তা মূল্যায়নে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছিল।
শনিবার (১৮ অক্টোবর) দুপুরে লাগা এই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীসহ বিভিন্ন সংস্থার সমন্বিত দমকলকর্মীদের প্রায় সাত ঘণ্টা সময় লাগে। রাত ১১টা ৩০ মিনিটের দিকে আগুনের তীব্রতা কিছুটা কমলেও তখনও সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি। ভবনটির ভেতর থেকে তখনও কালো ও সাদা ধোঁয়া বের হচ্ছিল।
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, গত আগস্টে অনুষ্ঠিত ওই মূল্যায়নে শাহজালাল বিমানবন্দর সামগ্রিকভাবে ৯৩ শতাংশ স্কোর করে, যার মধ্যে 'কার্গো নিরাপত্তা' খাতে পায় ১০০ শতাংশ নম্বর।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও জানানো হয়, ওসমানী বিমানবন্দরও কার্গো নিরাপত্তায় ১০০ শতাংশ নম্বর পেয়েছে। একইসঙ্গে, যুক্তরাজ্যের পরিদর্শকরা বেবিচকের প্রস্তুতি ও কার্যকারিতা নিয়ে গভীর সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন।
বেবিচক ওই অর্জনকে মাইলফলক হিসেবে বর্ণনা করে জানায়, এটি বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক মান ও বৈশ্বিক আস্থার প্রতিফলন।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি থেকে স্থানীয় সংকটে
ডিএফটি যুক্তরাজ্য সরকারের একটি আনুষ্ঠানিক আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা মূল্যায়ন ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে বিদেশী বিমানবন্দরসমূহে যাত্রী ও কার্গো নিরাপত্তা মানদণ্ড যাচাই করা হয় এবং যুক্তরাজ্যের চাওয়া অতিরিক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থাগুলোর বাস্তবায়ন পর্যালোচনা করা হয়।
তবে শাহজালাল বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে আগুনের এই ঘটনা সেই অর্জনের মধ্যেই নতুন প্রশ্ন তুলেছে, অবকাঠামোগত নিরাপত্তা কতটা সুরক্ষিত।
শনিবারের এই অগ্নিকাণ্ডে বিমানবন্দরের কার্যক্রম ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যাহত হয়। নয়টির বেশি ফ্লাইট বিলম্বিত বা অন্যত্র সরিয়ে নিতে হয়, এতে যাত্রীদের ভোগান্তি ও সরবরাহ ব্যবস্থায় অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশের রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতিতে এর প্রভাব ব্যাপক হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল এয়ার এক্সপ্রেস অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তারা জানান, বিমানপথে পরিবহন হওয়া আমদানি-রপ্তানির অন্তত এক-তৃতীয়াংশই তৈরি পোশাক ও বস্ত্রখাতের পণ্য। বর্তমানে বাংলাদেশে ৬০টির বেশি আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সেবা চালু আছে, যাদের অধিকাংশই শাহজালাল বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজের মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করে।
ব্যবসায়ীদের শঙ্কা
ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, এ ঘটনার মধ্য দিয়ে বিমানবন্দরের অগ্নি-নিরাপত্তা ও সংরক্ষণ ব্যবস্থার দীর্ঘদিনের দুর্বলতা আবারও সামনে এলো।
বিকেএমইএ-এর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম শনিবার সন্ধ্যায় দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-কে বলেন, 'কার্গো ভিলেজের মতো অত্যন্ত সংবেদনশীল এলাকায় এমন অগ্নিকাণ্ডই প্রমাণ করে জায়গাটি কতটা অনিরাপদ।'
তিনি বলেন, 'আমরা রপ্তানিকারকরা বহু বছর ধরে অভিযোগ করে আসছি, আমাদের পণ্যগুলো খোলা ও অনিরাপদ স্থানে সংরক্ষণ করা হয়, যা বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি তৈরি করে।'
একইভাবে, বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, 'শনিবার আমরা আমাদের সব সদস্যকে ইমেইল পাঠিয়েছি; যাতে তারা জানান, তাদের কোন কোন পণ্য কার্গোতে সংরক্ষিত ছিল।'
তিনি বলেন, 'এখনো ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। আমি নিজেও কার্গো এলাকায় কিছু অ্যাকসেসরিজ ও যন্ত্রপাতি আমদানি করেছিলাম। তবে আমার চালান নিরাপদ আছে কি না, তা এখনো জানতে পারিনি।'
'যদি ওই চালান সময়মতো না পৌঁছায়, তাহলে আমারও বড় রপ্তানি ক্ষতি হবে,' যোগ করেন বিজিএমইএ সভাপতি।
বিলিয়ন ডলারের ঝুঁকি
কার্গো ভিলেজটি মূলত তৈরি পোশাক (আরএমজি) খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবহার করে। এখান থেকেই তারা হালকা যন্ত্রপাতি ও ইলেকট্রনিক পণ্য আমদানি করে এবং বিদেশে পোশাক ও নমুনা রপ্তানি করে থাকে। এছাড়া আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সার্ভিস, ওষুধ কোম্পানির কাঁচামাল আমদানির চালান, এবং কৃষিপণ্যের রপ্তানিও এখান থেকে সম্পন্ন হয়।
'এখনই ক্ষতির সঠিক পরিমাণ বলা সম্ভব নয়,' বলেন বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল এয়ার এক্সপ্রেস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কবির আহমেদ খান।
'তবে সরাসরি ও পরোক্ষ প্রভাব মিলিয়ে রপ্তানি–আমদানি খাতে এক বিলিয়ন ডলারেরও বেশি ক্ষতি হতে পারে,' তিনি যোগ করেন।
এক দশক আগেও বাংলাদেশের এয়ার কার্গো খাত বড় ধরনের সমস্যার মুখে পড়েছিল। ২০১৬ সালে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা স্ক্রিনিং না থাকায় যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) বাংলাদেশ থেকে সরাসরি চালান গ্রহণে নিষেধাজ্ঞা দেয়। ফলে রপ্তানিকারকদের পণ্য তৃতীয় দেশে পুনরায় স্ক্রিনিং করিয়ে পাঠাতে হতো।
এরপর থেকে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) ও বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ ব্যাপক উন্নয়ন কার্যক্রম হাতে নেয়; নতুন এক্সপ্লোসিভ ডিটেকশন সিস্টেম (ইডিএস), বিস্ফোরক শনাক্তকারী কুকুর (ইডিডি) এবং কর্মীদের বিশেষ প্রশিক্ষণ তারই অংশ।
সম্প্রতি কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন, যুক্তরাজ্যের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে দেওয়া স্বীকৃতি এই উন্নতিরই প্রমাণ।
বেবিচক তাদের বিবৃতিতে জানায়, ডিএফটি থেকে প্রাপ্ত ভাল মূল্যায়ন জাতীয় স্বার্থে গভীর তাৎপর্য বহন করে। এটি বাংলাদেশের বিমান নিরাপত্তা ব্যবস্থার দৃঢ়তা ও সক্ষমতার প্রতিফলন, যা সামগ্রিকভাবে জাতীয় নিরাপত্তার উন্নয়নে সহায়তা করে। এই ফলাফল বিদেশি নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও এয়ারলাইন্সগুলিকে আশ্বস্ত করে যে যাত্রী ও কার্গো ব্যবস্থাপনা টেকসই এবং উচ্চমানের নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণ বজায় রয়েছে।
অগ্নিকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধানে তদন্ত কমিটি
ঘটনার পর অন্তর্বর্তী সরকার এক বিবৃতিতে জানায়, সাম্প্রতিক আগুনের ঘটনাগুলো খতিয়ে দেখতে নিরাপত্তা সংস্থাগুলো কাজ করছে এবং মানুষের জীবন ও সম্পদের সুরক্ষায় সর্বোচ্চ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সরকার সতর্ক করেছে, নাশকতা বা অগ্নিসংযোগের কোনো প্রমাণ পাওয়া গেলে দ্রুত ও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।