বিদেশিদের জন্য কেন টাস্কফোর্স গঠন করেছে জাপান?

দীর্ঘদিন ধরে দেশের মন্দা অর্থনীতিকে চাঙা করতে বিদেশিদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছিল জাপান। কিন্তু এখন অনেকের কাছে মনে হচ্ছে বিদেশিদের সংখ্যা খুব বেশি হয়ে গেছে। এ অবস্থায়, রোববারের জাতীয় নির্বাচনের আগে ভোটের উত্তেজনা যখন তুঙ্গে, তখন সরকার একটি নতুন টাস্কফোর্স গঠন করেছে।
আগামী উচ্চকক্ষ নির্বাচনের আগে এই ইস্যুটি রাজনৈতিক আলোচনায় উঠে এসেছে, আংশিকভাবে এমন একটি প্রান্তিক রাজনৈতিক দলের কারণে যারা 'জাপানিজ ফার্স্ট' নীতির পক্ষে প্রচার চালাচ্ছে—যেটা অনেকটা যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের স্বদেশবাদী বক্তব্যের মতো প্রচার চালাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবা মঙ্গলবার এই টাস্কফোর্সের উদ্বোধন করেন। এর দপ্তরের আনুষ্ঠানিক নাম প্রমোশন অফ এ সোসাইটি অব হারমনিয়াস কো-এক্সিসটেন্স উইথ ফরেন ন্যাশনালস। তিনি বলেন, কিছু বিদেশিদের দ্বারা সংঘটিত অপরাধ বা অস্বস্তিকর আচরণ এবং সরকারি বিভিন্ন ব্যবস্থার 'অপপ্রয়োগ' এই পদক্ষেপের জন্য দায়ী।
বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ জাপানের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে কঠোর অভিবাসন নীতি এবং একটি শক্তিশালী সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যবোধের, যা অনেকটাই একাকীত্বের দিকে ঝুঁকেছে।
তবে দ্রুত বয়স্ক জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং জন্মহার নাটকীয়ভাবে কমে যাওয়ায়, জাপান ধীরে ধীরে বিদেশি কর্মীদের জন্য দরজা খুলেছে এবং আন্তর্জাতিক পর্যটকদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে।
তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, এভাবে বিদেশিদের জন্য 'সেতু তুলে নেওয়া' (অর্থাৎ অভিবাসন সীমিত করা) জনসংখ্যা সংকটকে আরও তীব্র করে তুলতে পারে এবং পর্যটন খাতকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে।
এই প্রেক্ষাপটেই নতুন টাস্কফোর্স গঠিত হয়েছে এবং কেন বিদেশিদের বিষয়টি নির্বাচনের ইস্যু হয়ে উঠেছে, তা বোঝা যাচ্ছে।
নতুন টাস্কফোর্সটি কী করবে?
প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবা নতুন অফিসটিকে একটি 'কমান্ড সেন্টার' হিসেবে বর্ণনা করেছেন, যা জাপানি নাগরিক ও বিদেশিদের জন্য নীতিমালা সমন্বয় করবে। এই অফিসের আওতায় থাকবে অভিবাসন, বিদেশিদের জমি অধিগ্রহণ এবং বকেয়া সামাজিক বীমার মতো বিষয়।
ইশিবা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, 'যারা নিয়ম মানবে না, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'
এখনও বিস্তারিত কিছু জানানো হয়নি, তবে সরকার গত মাসে বলেছে—যেসব পর্যটক ও বিদেশি বাসিন্দারা চিকিৎসাবাবদ পাওনা বিল পরিশোধ করেনি, তাদের ভিসা দেওয়া বা পুনরায় জাপানে প্রবেশ নিষিদ্ধ করার জন্য নীতিমালায় সংশোধনের পরিকল্পনা রয়েছে।
জাপানি জনগণ কেন বিরক্ত?
গত এক দশকে জাপানে বিদেশি বাসিন্দার সংখ্যা ২২.৩ লাখ থেকে বেড়ে ৩৭.৭ লাখে পৌঁছেছে, তবে তারা এখনো ১২ কোটির বেশি মোট জনসংখ্যার মাত্র ৩ শতাংশ।
তবে যা আরও বেশি চোখে পড়ার মতো, তা হলো সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, বিশেষ করে কোভিড-১৯ মহামারির পর, পর্যটনের ব্যাপক বৃদ্ধি।
জাপান ন্যাশনাল ট্যুরিজম অর্গানাইজেশনের তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের প্রথমার্ধে রেকর্ড ২ কোটি ১৫ লাখ বিদেশি পর্যটক জাপান সফর করেছেন। জাতিসংঘের পর্যটন সংস্থা ইউএন টুরিজমের মতে, গত বছর জাপান ছিল বিশ্বের ৮ম সর্বাধিক ভ্রমণকৃত দেশ এবং এশিয়ার মধ্যে শীর্ষে।
এই পর্যটকের ঢল অনেক বাসিন্দাকে বিরক্ত করেছে, কারণ তাদের পাড়া-মহল্লায় ভিড় করছে ভ্রমণপিপাসুরা—দৃশ্য উপভোগ, কেনাকাটা বা ছবি তোলার জন্য—ফলে স্থানীয়দের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বিঘ্নিত হচ্ছে।
এই পরিস্থিতির কারণে কর্তৃপক্ষকে এক পর্যায়ে একটি কনভেনিয়েন্স স্টোর থেকে ফুজি পর্বতের জনপ্রিয় দৃশ্য আংশিকভাবে আড়াল করতে হয়েছে, কারণ এলাকাবাসীর ভিড় নিয়ে অভিযোগ বেড়ে গিয়েছিল। একটি অনসেন (গরম পানির স্পা) রিসোর্ট এলাকাতেও সতর্কতা জারি করা হয়েছে, পর্যটকদের ব্যক্তিগত গোসলের চাহিদায় পানির স্তর কমে যাওয়ার আশঙ্কায়।
কেউ কেউ পর্যটকদের দায়ী করছেন মুদ্রাস্ফীতি (মূল্যবৃদ্ধি) এবং চালসহ কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ঘাটতির জন্য—যা জাপানের সবচেয়ে প্রিয় খাদ্যশস্য।
অনেকে অভিযোগ করছেন, বিদেশি বাসিন্দারা নাকি জাপানের সরকারি স্বাস্থ্য বীমা ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিচ্ছেন এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীরা দেশজুড়ে সম্পত্তি কিনে মুদ্রস্ফিতি ঘটাচ্ছেন।
টোকিওর এক অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তি, যিনি আগে একটি ট্রেডিং কোম্পানিতে কাজ করতেন, সিএনএনকে বলেন—তিনি মনে করেন, বিদেশি কর্মীরা জাপানি নাগরিকদের চাকরি কেড়ে নিচ্ছেন।
৭৮ বছর বয়সী ওই ব্যক্তি বলেন, 'তারা জাপানে এসেছে কারণ তারা নিজ দেশে জীবিকা নির্বাহ করতে পারছিল না।
তিনি আরও বলেন, 'তাদের সংস্কৃতি ভিন্ন, তাই একসঙ্গে থাকা অসম্ভব।'
অন্যদিকে, অফিসকর্মী কোউয়ামা নানামি (২৩) বলেন, তিনি সংবাদে পড়েছেন যে জাপানে বসবাসরত বিদেশিদের অনেকেই কল্যাণ সহায়তা পাচ্ছেন।
তিনি বলেন, 'আমার মনে হয় এই সহায়তাগুলো জাপানি নাগরিকদের জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দেওয়া উচিত ছিল।'
এই বিরক্তি কি যৌক্তিক?
টোকিওর ওয়াসেদা ইউনিভার্সিটির সমাজবিজ্ঞান অধ্যাপক শুন্সুকে তানাবে বলেন, অভিবাসন নিয়ে যে নেতিবাচক ধারণাগুলো ছড়িয়ে পড়েছে—যেমন অপরাধ বৃদ্ধির আশঙ্কা—তার অনেকটাই রাজনৈতিক প্রচারে মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর দাবির ওপর ভিত্তি করে।
তিনি সিএনএনকে বলেন, 'মানুষ চোখে দেখছে বিদেশির সংখ্যা বেড়েছে, তাই ধরে নিচ্ছে সমাজে নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিশ্চয়ই খারাপ হচ্ছে।'
তিনি আরও বলেন, 'ফলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়ানো নেতিবাচক প্রচারণাগুলো অনেকের মনে সাড়া ফেলছে, এবং তারা ভাবছে—যেসব দল এই কাল্পনিক হুমকি থেকে সমাজকে "রক্ষা" করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, তারাই হয়তো সঠিক পথ দেখাবে।'
তিনি (তানাবে) উল্লেখ করেন, গত ২০ বছরে জাপানে অপরাধের হার কমেছে, যদিও এই সময়ে পর্যটক ও বিদেশি বাসিন্দার সংখ্যা বেড়েছে। তিনি বলেন, 'অপরাধের হারে জাপানি নাগরিক ও বিদেশি নাগরিকদের মধ্যে প্রকৃতপক্ষে কোনো উল্লেখযোগ্য পার্থক্য নেই।'
জাপানের বিচার মন্ত্রণালয়ের ২০২৩ সালের এক হোয়াইট পেপার অনুযায়ী, ওই বছর মোট ৯ হাজার ৭২৬ জন বিদেশিকে অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যা মোট গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিদের মাত্র ৫.৩ শতাংশ। এই সংখ্যার মধ্যে উভয়ই অন্তর্ভুক্ত—পর্যটক ও বিদেশি বাসিন্দা।
এখন কেন এই বিষয়টি আলোচনায়?
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, নির্বাচনী প্রচারণা এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে, আর এই মুহূর্তে বিদেশি নাগরিকদের 'দায়িত্বহীন আচরণ' ও পর্যটকদের 'অশালীনতা' নিয়ে জনমনে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে—এটাই ইশিবার ওপর চাপ তৈরি করেছে।
সানসেইতো নামে একটি ছোট ডানপন্থী দল অভিবাসনবিরোধী অবস্থান এবং 'জাপানিজ ফার্স্ট' নীতি তুলে ধরে জনমাধ্যমে ব্যাপক মনোযোগ পাচ্ছে।
এই উদীয়মান দলটি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার মতো শক্তিশালী না হলেও, ১০ থেকে ১৫টি আসন পেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে—যা প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবার নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সংখ্যাগরিষ্ঠতা খর্ব করতে পারে।
এই রাজনৈতিক চাপই সম্ভবত ইশবাকে বিদেশিদের নিয়ে নতুন টাস্কফোর্স গঠনে বাধ্য করেছে।
গত বছর জাপানের ক্ষমতাসীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) এবং তাদের জোটসঙ্গী কোমেইতো ১৫ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো নিম্নকক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছিল। এবারের নির্বাচনে যদি তারা উচ্চকক্ষেও হারে, তাহলে প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবার ওপর পদত্যাগের চাপ আরও বাড়তে পারে।
চিবা প্রদেশের কাণ্ডা ইউনিভার্সিটি অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ-এর জাপান গবেষক জেফরি হল বলেন, 'সানসেইতো'র মতো অভিবাসনবিরোধী দলগুলো এই সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছে—জনগণের ভুল ধারণা ও অভিবাসন নিয়ে আতঙ্ককে উস্কে দিয়ে এলডিপির ভোট কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে।'
রোববার প্রচারণা চালাতে গিয়ে, সানসেইতো দলের সচিব সেক্রেটারি জেনারেল সোহেই কামিয়া বলেন, তার দল মনে করে—সরকারি অর্থ ব্যবহার করে বিদেশি কর্মী নিয়োগ করা বা লাভজনক ব্যবসা বিদেশিদের কাছে তুলে দেওয়া যুক্তিযুক্ত নয়।
তিনি জোর দিয়ে বলেন, 'এটি কোনো বৈষম্য বা ঘৃণাসূচক বক্তব্য নয়।'
জেফরি হল মন্তব্য করেন, নতুন অফিস গঠন এলডিপিকে দেখাতে সাহায্য করতে পারে যে তারা বিষয়টিকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে, তবে এর একটি মূল্য চুকাতে হবে।
হল বলেন, 'যদি জাপান এমন একটি সমাজ হয়ে যায় যেখানে বিদেশিদের প্রতি অতিরিক্ত নজরদারি করা হয় এবং তারা অস্বাগত বোধ করে, তাহলে ব্যবসাগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় বিদেশি কর্মী পাওয়া কঠিন হয়ে যেতে পারে।'
জাপানের কেন বিদেশি কর্মী দরকার?
২০২৪ সালে দেশের জন্মহার রেকর্ড নিচু হয়ে দাঁড়িয়েছে ১.১৫ এ, যা ২.১ এর তুলনায় অনেক কম—২.১ জন্মহার দরকার জনসংখ্যা স্থিতিশীল রাখতে, যদি অভিবাসন না থাকে। এর মানে আগামী কয়েক দশকে কাজের যোগ্য জনসংখ্যা আরও কমে যাবে। এই জনসংখ্যাগত সংকট জাপানের অর্থনীতির জন্য খারাপ সংকেত, যা ১৯৯০-এর দশকের শুরুর পর থেকে স্থবিরতার সম্মুখীন।
বিদেশি কর্মীদের আকৃষ্ট করতে সরকার ভিসার শর্তাবলী শিথিল করছে এবং তাদের জন্য অবস্থান উন্নত করার চেষ্টা করছে।
গত অক্টোবর মাসে জাপানে বিদেশি কর্মীর সংখ্যা ২৩ লাখের রেকর্ডে পৌঁছেছে, যা স্বাস্থ্য, শ্রম ও কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী। সরকার 'নির্দিষ্ট দক্ষ কর্মী' ভিসা প্রদান করছে, যা নার্সিং, আতিথেয়তা, নির্মাণ এবং বিমানচালনা সহ বিভিন্ন শিল্পে কাজ করার সুযোগ দেয়, বৈদেশিক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে।
মঙ্গলবারের ঘোষণায় প্রধানমন্ত্রী ইশিবা উল্লেখ করেন, জাপানের জন্য উন্মুক্ত মনের থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি বলেন, 'জন্মহার কমে যাওয়া এবং বয়স্ক জনসংখ্যার বৃদ্ধি নিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি জাপানের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রাণশক্তি গ্রহণ করা অপরিহার্য, তা হলে কিছু পরিমাণ বিদেশি কর্মী গ্রহণ এবং পর্যটন সম্প্রসারণের মাধ্যমে আমরা একটি প্রবৃদ্ধিমুখী অর্থনীতিতে সাবলীল রূপান্তর নিশ্চিত করতে পারব।'