দক্ষিণ কোরিয়ায় নিষিদ্ধ কুকুরের মাংস, তবে কুকুরগুলোর ভবিষ্যৎ কী?

ঈশ্বরের বাণী প্রচারের ফাঁকে ফাঁকে কুকুর পালনে ব্যস্ত থাকেন দক্ষিণ কোরিয়ার জু ইয়ং-বং। তবে এই কুকুরগুলো পোষার জন্য নয়, বরং মাংস বিক্রির জন্য!
তবে এখন তার ব্যবসা মুখ থুবড়ে পড়েছে। এমনকি এটি অবৈধ হয়ে যাওয়ার পথে।
২০২৪ সালে দক্ষিণ কোরিয়া সরকার কুকুরের মাংস বিক্রির ওপর জাতীয় নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এই আইন অনুযায়ী, ২০২৭ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে সব কুকুর পালনকারী খামারগুলোর কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে হবে এবং অবশিষ্ট কুকুর বিক্রি করতে হবে।
'গত গ্রীষ্ম থেকে আমরা কুকুর বিক্রির চেষ্টা করছি, কিন্তু ব্যবসায়ীরা বারবার পিছিয়ে যাচ্ছে। একজনও আসেনি,' বিবিসিকে বলেন ৬০ বছর বয়সী মি. জু।
খামারিরা বলছেন, শতাব্দীপ্রাচীন এই শিল্প বন্ধ করার জন্য তিন বছর যথেষ্ট সময় নয়। উপরন্তু, সরকারের পক্ষ থেকে এখনও কার্যকর কোনও বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি—না খামারিদের জন্য, না খাঁচাবন্দি প্রায় পাঁচ লাখ কুকুরের জন্য।
আবার সরকারি এই নিষেধাজ্ঞাকে স্বাগত জানানো পশু অধিকারকর্মী এবং বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, এই আইন বাস্তবায়নে নানা সমস্যা দেখা দিচ্ছে। যেসব কুকুর জবাইয়ের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে, তাদের পুনর্বাসনের সুযোগ না থাকায় এখন উল্টো ইউথানেশিয়ার (যন্ত্রণামুক্ত মৃত্যুর প্রক্রিয়া) আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
গ্রেস পিরিয়ড বা আইন বাস্তবায়নের পূর্বে প্রস্তুতির জন্য দেয়া অতিরিক্ত সময়ের অর্ধেক পার হলেও কুকুর খামারিরা এখনও শত শত বিক্রয়যোগ্য নয় এমন কুকুর নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। একদিকে খামারগুলো বন্ধ করতে পারছেন না, আবার জীবিকা নির্বাহেরও কোনও বিকল্প উপায় নেই।
কোরিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অব এডিবল ডগস-এর সভাপতি মি. জু বলেন, 'মানুষ কষ্টে আছেন। আমরা ঋণে ডুবে আছি, শোধ করতে পারছি না। অনেকেই তো নতুন কাজও খুঁজে পাচ্ছেন না।'
'পুরো পরিস্থিতিটাই বেশ হতাশাজনক!'

প্রতিবন্ধকতার ঝড় জর্জরিত কুকুর-খামারিরা
চান-উ (কাল্পনিক নাম, ব্যক্তিগত নিরাপত্তার কারণে পরিচয় গোপন রাখা হয়েছে) এর হাতে আছে মাত্র ১৮ মাস। এরই মধ্যে বিক্রি করে ফেলতে হবে প্রায় ৬০০টি কুকুর।
এই সময়সীমা পেরিয়ে গেলে তিনি সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ডের মুখোমুখি হতে পারেন।
'বাস্তবতা হলো, শুধু আমার খামারেই যত কুকুর আছে, তা এই অল্প সময়ের মধ্যে বিক্রি বা সরিয়ে ফেলা অসম্ভব,' বলেন তিনি। 'আমার সব সম্পদ আমি এই খামারে ঢেলে দিয়েছি। অথচ এখন কেউ কুকুরগুলো নিতে চাচ্ছে না।'
এই 'কেউ' বলতে তিনি শুধু আগের ক্রেতা ব্যবসায়ী বা কসাইদের কথা বলছেন না। ইঙ্গিত করছেন পশু অধিকারকর্মী এবং সরকারি কর্তৃপক্ষেরও, যারা কুকুর-মাংস নিষিদ্ধের জন্য লড়াই করে আসছেন। তবে বর্তমানে প্রায় পাঁচ লাখ অবশিষ্ট কুকুর নিয়ে স্পষ্ট কোনো পরিকল্পনা না থাকায় তিনি হতাশ।
'বাস্তবায়নের কোনও স্পষ্ট পরিকল্পনা ছাড়াই সরকার এই আইন পাস করেছে, এখন আবার বলছে, কুকুরগুলোও নিতে পারবে না।'
হিউমেইন ওয়ার্ল্ড ফর অ্যানিম্যালস কোরিয়া (হোয়াক)-এর ক্যাম্পেইন ম্যানেজার লি সাং-কিয়ং বলেন, কুকুরের মাংস নিষিদ্ধ হলেও এখনো সরকার ও নাগরিক সংগঠনগুলো অবশিষ্ট কুকুরগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে।
'নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয়েছে ঠিকই, কিন্তু অবশিষ্ট থেকে যাওয়া কুকুরগুলো নিয়ে আলোচনাটা এখনো খুবই সীমিত,' বলেন তিনি।

দক্ষিণ কোরিয়ার কৃষি, খাদ্য ও গ্রামীণ উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের (মাফরা) একজন বিদেশি গণমাধ্যম মুখপাত্র বিবিসিকে জানান, খামারিরা যদি স্বেচ্ছায় কুকুর ছেড়ে দেন, তাহলে স্থানীয় সরকারগুলো তাদের দায়িত্ব নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে রাখবে।
তবে এসব কুকুরকে নতুন বাড়ি খুঁজে দেওয়া এতোটাও সহজ নয়। পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া এখন নানা দিক থেকে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দক্ষিণ কোরিয়ার কুকুর মাংসের বানিজ্যের মুনাফা নির্ধারণ হয় ওজন অনুযায়ী, তাই সাধারণত খামারিরা বড় জাতের কুকুর পোষে। কিন্তু দেশের শহুরে জীবনে, যেখানে অধিকাংশ মানুষ অ্যাপার্টমেন্টে থাকে, সেখানে পোষ্য হিসেবে ছোট জাতের কুকুরের চাহিদাই বেশি।
হোয়াক এর ম্যানেজার লি সাং-কিয়ং জানান, মাংসের খামার থেকে আসা কুকুরদের নিয়ে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি নেতিবাচক। এসব কুকুরদের নিয়ে অসুস্থতার আশঙ্কার পাশাপাশি নানা ধরণের কুসংস্কারও কাজ করে।
অন্য একটি সমস্যা হলো, অনেক কুকুর তোসা-ইনু জাতের বা তার সংকর, যাদের দক্ষিণ কোরিয়ায় 'বিপজ্জনক' হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং পোষার জন্য সরকারি অনুমতি নিতে হয়।
দেশের আশ্রয়কেন্দ্রগুলো ইতিমধ্যে অতিরিক্ত কুকুরে ভরে গেছে। তাই উদ্ধার হওয়া বহু কুকুরের ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত। আশ্রয় না পেলে তাদের ইউথানেশিয়াই করতে হতে পারে।

'এটা একেবারে অবিশ্বাস্য,' বলেন চান-উ।
'আইন তৈরি হয়েছে পশু অধিকার সংগঠনের দাবির ভিত্তিতে। আমি ভেবেছিলাম তারা কুকুরগুলোর জন্যও কোনো সমাধান নিয়ে এসেছে—যেমন দায়িত্ব নেবে। কিন্তু এখন শুনছি তারাও বলছে, ইউথানেশিয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই!'
কোরিয়ান অ্যানিমাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান চো হি-ক্যাং ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে স্বীকার করেন, প্রাণী উদ্ধারের জন্য সংগঠনগুলো যতটা সম্ভব চেষ্টা করলেও 'কিছু কুকুর বাকি থাকবে।'
তিনি বলেন, 'অবশিষ্ট কুকুরগুলো 'হারিয়ে যাওয়া ও পরিত্যক্ত প্রাণী' হলে তা হৃদয়বিদারক, তবে শেষ পর্যন্ত তাদের ইউথানেশিয়া করা হবে।'
কয়েক সপ্তাহ পর সরকার এই উদ্বেগ কমাতে বলেছে, প্রাণী হত্যা তাদের পরিকল্পনার অংশ নয়।
সম্প্রতি মাফরা বিবিসিকে জানায়, প্রাণী আশ্রয়কেন্দ্র বাড়াতে এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সহায়তা দিতে তারা প্রতি বছর প্রায় ৪ দশমিক ৩ মিলিয়ন খরচ করছে। এছাড়া আগাম ব্যবসা বন্ধ করে খামার বন্ধ করলে প্রতি কুকুরের জন্য কৃষকদের সর্বোচ্চ ৪৫০ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দেবে।

মাফরার পরিকল্পনায় কুকুরদের উদ্ধারের ব্যবস্থাও অন্তর্ভুক্ত করার কঠোরভাবে দাবি জানিয়েছে হোয়াক।
হোয়াক আরও তুলে ধরে, ২০১৫ সাল থেকে তারা দক্ষিণ কোরিয়ার মাংস খামার থেকে প্রায় ২ হাজার ৮০০ কুকুর পুনর্বাসন করেছে। তবে বছরের পর বছর বাড়তে থাকা বিপুল সংখ্যক কুকুরের দায়ভার পশু কল্যাণ সংস্থাগুলোর ওপর চাপানো উচিত নয়।
সিউল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ভেটেরিনারি হিউম্যানিটিজ অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্সের সহযোগী অধ্যাপক চুন মিউং-সুনও সরকারী পরিকল্পনায় অবশিষ্ট কুকুরদের ভবিষ্যৎ নিয়ে যথেষ্ট ভাবনা-চিন্তা নেই বলে মত দেন।
তিনি বলেন, 'কুকুরগুলোর 'পরিচ্ছন্ন' নিষ্পত্তি নিয়ে স্পষ্ট ও বাস্তব আলোচনা জরুরি।'
'গৃহপালনের পাশাপাশি ইউথানেশিয়াও আলোচনার অংশ হওয়া উচিত। কিন্তু আমরা যদি নিষ্ঠুর হত্যার হাত থেকে কুকুরগুলোকে উদ্ধার করার পরই তাদের ইউথানেশিয়া করি, তাহলে মানুষের ক্ষুব্ধ হওয়া স্বাভাবিক।'
'জীবন অনিশ্চয়তার পথে এগোচ্ছে'
কিছু খামারি সমাধানের জন্য দেশের বাইরেও নজর দিয়েছেন। তারা কুকুরগুলোকে কানাডা, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে পাঠিয়েছেন, যেখানে তারা কুকুর পালনে আগ্রহী।
২০২৩ সালে হোয়াকের একটি দল আসান শহরের একটি খামার থেকে প্রায় ২০০টি কুকুর উদ্ধার করে, যাদের পরে কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়।
সেই খামারের প্রাক্তন মালিক ৭৪ বছর বয়সী ইয়াং জং-তে বিবিসিকে বলেন, উদ্ধারকারীরা যখন তার কুকুরগুলো ট্রাকে তুলছিলো, তখন কুকুরদের প্রতি মমত্ববোধে ও স্নেহ দেখে তিনি অভিভূত হয়েছিলেন।
তবে মি. ইয়াং দ্রুত জানান, তিনি কুকুর মাংস চাষের ওপর নিষেধাজ্ঞার পক্ষপাতী নন।
'কুকুর প্রাণী বিধায় যদি কুকুরের মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ হয়, তাহলে গরু, শূকর বা মুরগির মাংস খাওয়া কেন ঠিক?' তিনি প্রশ্ন তোলেন। 'সবই তো মানুষের জীবিকার জন্য প্রকৃতির সৃষ্টি।'
অন্যদিকে, সিউল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক চুন মিউং-সুন বলেন, কুকুরের মাংস অন্যান্য মাংসের মতো নয়। খাদ্য সুরক্ষা ও পরিচ্ছন্নতার দিক থেকে এতে বেশি ঝুঁকি থাকে—বিশেষ করে দক্ষিণ কোরিয়ায়, যেখানে কুকুরের মাংস সরকারি নিয়ন্ত্রিত মাংস উৎপাদন ব্যবস্থার অংশ নয়।
হিউমেইন ওয়ার্ল্ড ফর অ্যানিম্যালস জানায়, কুকুরের মাংস চীন, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, লাওস, মায়ানমার, উত্তর-পূর্ব ভারতের কিছু অংশ এবং আফ্রিকার কয়েকটি দেশে নিয়মিত খাওয়া হয়।
যদিও কোরিয়ার ইতিহাস জুড়ে কুকুর মাংসের ভোগের হার ওঠানামা করেছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দক্ষিণ কোরিয়ায় এটি দিন দিন আরও ট্যাবু হয়ে উঠেছে।

২০২৪ সালের এক সরকারি জরিপে দেখা গেছে, দক্ষিণ কোরিয়ায় গত ১২ মাসে মাত্র ৮ শতাংশ কুকুরের মাংস খেয়েছেন—যা ২০১৫ সালের ২৭ শতাংশের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম। জরিপে প্রায় ৭ শতাংশ মানুষ বলেছেন তারা ২০২৭ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কুকুর মাংস খেতে চান, আর ৩ দশমিক ৩ শতাংশ জানিয়েছেন, নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হওয়ার পরও তারা খাওয়া চালিয়ে যাবেন।
নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা আসার পর থেকে, দক্ষিণ কোরিয়ার মোট ১ হাজার ৫৩৭টি খামারের মধ্যে ৬২৩টি বন্ধ হয়ে গেছে।
তবুও অনেকের জন্য কুকুরের মাংসের বানিজ্য তাদের জীবিকার প্রধান অবলম্বন।
বিবিসির সঙ্গে কথা বলা কুকুর মাংস ব্যবসায়ীদের কেউই জানেন না, নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হলে তারা ভবিষ্যতে কীভাবে জীবিকা নির্বাহ করবেন।
কেউ কেউ এই পরিবর্তন মেনে নিয়েছেন। বিশেষ করে যারা কোরিয়ান যুদ্ধের সময় জন্মগ্রহণ করেছেন এবং ক্ষুধার সঙ্গে বেঁচে থাকার অভিজ্ঞতা আছে। তবে কেউ কেউ মনে করছেন, এই ব্যবসা হয়তো গোপনে টিকে থাকবে।
তবে তরুণ খামারিদের জন্য পরিস্থিতি সবচেয়ে উদ্বেগজনক বলে মনে করছেন অনেকেই।
চান-উ যখন ২৩ বছর বয়সে এই খাতে কাজ শুরু করেন, তখন কুকুর মাংসের প্রতি মানুষের মনোভাব এতটা নেতিবাচক ছিল না।
'তবুও,' বলেন চান-উ, 'আমার আশপাশের অনেকের মন্তব্য শুনে তখন থেকেই বুঝেছিলাম, এটা হয়তো সারাজীবন করার মতো উপযোগী পেশা নয়।'
তার মতে, নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাশার তুলনায় অনেক দ্রুত এসেছে। ঘোষণার পর থেকে তার জীবিকা মারাত্মক অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে।
'আমাদের এখন একটাই আশা—গ্রেস পিরিয়ডটা যেন বাড়ানো হয়,' বলেন তিনি। 'তাহলে অবশিষ্ট কুকুর নিয়ে ধীরে ধীরে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।'
অনেক খামারি এই একই আশায় আছেন। তবে কুকুর মাংস বানিজ্যের ওপর নির্ভরশীলদের জন্য এই আশাও দিনে দিনে ক্ষীণ হয়ে আসছে।
মি. জু বলেন, 'অনেকে এখনো অপেক্ষা করছেন—হয়তো কিছু বদল আসবে, সময় বাড়বে। কিন্তু আমি মনে করি, ২০২৭ সালের আগেই ভয়াবহ কিছু ঘটে যেতে পারে।'
'অনেকের জীবন অনিশ্চয়তার পথে এগোচ্ছে।'