উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার ‘গোপন যুদ্ধ’, হয়তো এগিয়ে আছেন কিম জং উন

বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক উত্তেজনা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ প্রায়ই মানুষের মন থেকে মুছে যাচ্ছে। একপাশে দক্ষিণ কোরিয়ার আড়ম্বরপূর্ণ জীবনযাত্রা ও বিনোদন সংস্কৃতি, অন্যপাশে উত্তর কোরিয়ায় মানবেতর জীবনযাপন ও কিম জং উনের একনায়কতন্ত্র—এই দুই বিপরীত বাস্তবতা ধীরে ধীরে যুদ্ধের বিষয়টিকে 'অপ্রাসঙ্গিক' করে তুলছে।
যুক্তরাষ্ট্রে দুই কোরিয়ার সংঘাতকে এখন 'ফরগটেন ওয়ার' বা 'ভুলে যাওয়া যুদ্ধ' হিসেবে বর্ণনা করা হয়। তবে বিশ্লেষকদের মতে, কোরিয়া যুদ্ধের 'লিগ্যাসি' বা সময়ের গভীরতা ব্যাপক। আজ ৭০ বছর পরে এসেও দুই কোরিয়ার মধ্যে পুরনো সেই যুদ্ধ শেষ হয়নি।
দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলে নিযুক্ত বিবিসির সাংবাদিক জিন ম্যাকানজি গত মাসে একদিন বিকেলে দক্ষিণ কোরিয়ার সীমান্তে দাঁড়িয়ে অদ্ভুত দৃশ্য লক্ষ্য করেন। উত্তর কোরিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়ার সীমান্তজুড়ে ঘন কাঁটাতারের বেড়া ও প্রহরী চৌকির পাশাপাশি রয়েছে সবুজ রঙের বড় বড় স্পিকার।
সীমান্তের ওই স্পিকার থেকে ভেসে আসছিল দক্ষিণ কোরিয়ার পপ গান আর সাথে উত্তর কোরিয়ার প্রতি উসকানিমূলক বার্তা। এক নারী কণ্ঠ বলছিলো, 'আমরা যখন বিদেশ ভ্রমণ করি, তখন তা আমাদের উদ্দীপ্ত করে'—যা স্পষ্টতই উত্তর কোরিয়ার নাগরিকদের জন্য ব্যঙ্গাত্মক, যেহেতু তারা তাদের দেশের বাইরে যেতে পারেন না।
আবার থেমে নেই উত্তর কোরিয়াও। দক্ষিণ কোরিয়ার সেই উসকানিমূলক বার্তা ঢাকতে তাদের দিক থেকেও খুবই সূক্ষ্মভাবে শোনা যাচ্ছিল সামরিক প্রচারণার সঙ্গীত।
উল্লেখ্য, উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধাবস্থায় রয়েছে। তবে বহু বছর ধরে সরাসরি গোলাগুলি না হলেও, উভয়পক্ষের মধ্যে এক ধরনের 'তথ্য যুদ্ধ' অব্যাহত রয়েছে।
একদিকে দক্ষিণ কোরিয়া চেষ্টা করছে, তাদের দেশ, সংস্কৃতি ও বিনোদন জগতের তথ্য গোপনে উত্তর কোরিয়ায় পৌঁছে দিতে। অন্যদিকে কিম জং উন মরিয়া সেই তথ্য আটকাতে, যাতে তার দেশের জনগণ বাইরের কোনো তথ্যের সংস্পর্শে না আসে।
উত্তর কোরিয়া পৃথিবীর একমাত্র দেশ যেখানে এখনো ইন্টারনেট প্রবেশ করতে পারেনি। দেশটির টিভি চ্যানেল, রেডিও স্টেশন এবং সংবাদপত্র—সবই সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণে।
উল্লেখ্য, ২০১৮ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার জনপ্রিয় কে-পপ গার্ল গ্রুপ 'রেড ভেলভেট' উত্তর কোরিয়ার রাজধানী পিয়ংইয়ংয়ে 'স্প্রিং ইজ কামিং' কনসার্টে পারফর্ম করেছিল। সেই সময়, কিম জং উন তার স্ত্রীকে সাথে নিয়ে কনসার্টটি উপভোগ করেন।
কনসার্টের ভিডিওতে দর্শকদের চুপচাপ দেখা গেলেও কিম জং উন হাত তালি দিয়ে কনসার্টটি উপভোগ করছিলেন। জানা যায়, অন্য একটি কর্মসূচি থাকলেও কিম জং উন তার সময়সূচি পরিবর্তন করে কনসার্টে যোগ দিয়েছিলেন।
প্রায় ১০ বছরেরও বেশি সময় পর সেবারই দক্ষিণ কোরিয়ার কোনো গ্রুপ উত্তর কোরিয়ায় পারফর্ম করে। এ কনসার্ট দুই কোরিয়ার মধ্যে সম্পর্ক উষ্ণ করার ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবেও বিবেচিত হয়।
আবার ২০১৮ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার সংস্কৃতি অনুযায়ী কিম জং উনের হাতের আঙুল দিয়ে 'হার্ট শেইপ' দিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে বন্ধুত্বের ইঙ্গিত দিতে চাওয়া একটি ছবি দক্ষিণ কোরিয়ার অনেকেরই মন জয় করে।
অন্যদিকে কিম জং উনের বড় ভাই কিম জং চুল একজন প্রতিভাবান সঙ্গীতশিল্পী এবং ব্রিটিশ সঙ্গীতশিল্পী এরিক ক্ল্যাপটনের একজন বড় ভক্ত।
তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রায় প্রতিদিনই কিম বা উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় মিডিয়া 'সমাজতন্ত্র বিরোধী ও অসামাজিক' প্রভাবের বিরুদ্ধে তীব্র ভাষায় কথা বলছে। বিশেষত দক্ষিণ কোরিয়ার সিনেমা, নাটক ও কে-পপ ভিডিওর প্রসার ঠেকাতে মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে তারা।
কারণ তাদের মতে, দক্ষিণ কোরিয়ার কন্টেন্টগুলোর প্রভাব উত্তর কোরিয়ার তরুণদের 'পোশাক, চুলের স্টাইল, কথাবার্তা ও আচরণ' নষ্ট করছে। যদি এটি নিয়ন্ত্রণে আনা না যায়, তবে উত্তর কোরিয়া 'একটি ভেজা দেয়ালের মতো ভেঙে পড়বে'।
বিশেষ করে কে-পপকে 'ভয়াবহ ক্যান্সার' বলে অভিহিত করে কিম তার সরকারকে কড়াভাবে হস্তক্ষেপের নির্দেশ দিয়েছেন।
এটি নিছক কোনো 'খামখেয়ালি' শাসকের রাগ নয়। একদিকে উত্তর কোরিয়ার অর্থনীতি হিমশিম খাওয়ার মতো অবস্থা, আরেকদিকে পশ্চিমের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কও ভেঙে পড়েছে, ঠিক সে সময়ই দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতি উত্তর কোরিয়ার তরুণদের আগ্রহ বেড়েছে।
ওয়াশিংটনের স্টিমসন সেন্টারের জ্যেষ্ঠ সহকর্মী ও উত্তর কোরিয়ার তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ মার্টিন উইলিয়ামস বলেন, 'কিম জং উনের এই তথ্য নিয়ন্ত্রণের মূল কারণ হলো, কিম পরিবার নিয়ে প্রচলিত গল্পগুলোর বেশিরভাগই মিথ্যা। উত্তর কোরিয়ার জনগণকে এসব মিথ্যা দিয়ে বেঁধে রাখা হয়।'
দক্ষিণ কোরিয়ার ধারণা, যদি জনগণের সামনে এসব মিথ্যা ফাঁস হয়, তাহলে কিম পরিবারের এই স্বৈরশাসন একসময় ভেঙে পড়তে পারে।
এশিয়া প্রেসের মাধ্যমে পাচার হওয়া উত্তর কোরিয়ার সরকারি নথি অনুযায়ী, এখন কম্পিউটার, টেক্সট মেসেজ, মিউজিক প্লেয়ার ও নোটবুক পরীক্ষা করা হচ্ছে, যাতে দক্ষিণ কোরিয়ার কোনো কনটেন্ট বা উচ্চারণের প্রভাব না থাকে।
যেমন, উত্তর কোরিয়ার নারীরা তাদের সঙ্গীদের 'কমরেড' বলে সম্বোধন করতে বাধ্য। কিন্তু, অনেকেই দক্ষিণ কোরিয়ার নাটকের মতো করে তাদের 'ওপ্পা' বা 'হানি' বলে ডাকতে শুরু করেছে। কিম এই ভাষাকে 'বিকৃত' বলে আখ্যা দিয়েছেন।
সীমান্তে প্রকাশ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার লাউডস্পিকারের মাধ্যমে বার্তা ছড়ালেও, পর্দার আড়ালে আরও সূক্ষ্ম এক কর্মকাণ্ড চলছে। কয়েকটি সম্প্রচারক ও অলাভজনক সংস্থা গভীর রাতে স্বল্প এবং মধ্যম তরঙ্গের রেডিওতে অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে, যাতে করে উত্তর কোরিয়ার নাগরিকেরা গোপনে এই অনুষ্ঠানগুলো শুনতে পারেন।
প্রতি মাসে হাজার হাজার ইউএসবি স্টিক এবং মাইক্রো-এসডি কার্ড সীমান্ত পেরিয়ে উত্তর কোরিয়ায় পৌঁছায়। এসব ডিভাইসে দক্ষিণ কোরিয়ার সিনেমা, টিভি নাটক, পপ গান ও খবর থাকে—সবই উত্তর কোরিয়ার প্রোপাগান্ডা মোকাবিলার জন্য।
কিন্তু এই মুহূর্তে যারা এই তথ্য-যুদ্ধে জড়িত, তারা শঙ্কিত কারণ উত্তর কোরিয়া হয়তো এই লড়াইয়ে প্রাধান্য পেতে শুরু করেছে।
কিম জং উন এখন যাদের কাছেই এসব বিদেশি কন্টেন্ট পাওয়া যাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর দমন-পীড়ন চালাচ্ছেন। তাছাড়া এই প্রচেষ্টা যে তহবিলের ওপর নির্ভর করে, তার ভবিষ্যতও অনিশ্চিত। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক সাহায্য কাটছাঁটের ফলে এই তহবিলও সংকটে পড়েছে।
তাহলে দীর্ঘদিনের এই তথ্য-যুদ্ধে দুই দেশের অবস্থান কোথায় গিয়ে ঠেকেছে?
প্রতি মাসে, দক্ষিণ কোরিয়ার অলাভজনক সংস্থা ইউনিফিকেশন মিডিয়া গ্রুপ (ইউএমজি) -এর একটি দল নতুন খবর ও বিনোদনমূলক বিষয়বস্তু বেছে নিয়ে এমন প্লে-লিস্ট তৈরি করে, যা উত্তর কোরিয়ার মানুষের কাছে আবেদনময় মনে হতে পারে।
এরপর এসব ফাইল বিভিন্ন ধরনের ডিভাইসে লোড করা হয়। ঝুঁকির মাত্রা অনুযায়ী এসব ডিভাইসকে ভাগ করা হয়। কম ঝুঁকির ইউএসবি-তে থাকে দক্ষিণ কোরিয়ার টিভি নাটক ও পপ গান—সম্প্রতি এর মধ্যে ছিল নেটফ্লিক্সের প্রেমের সিরিজ 'হোয়েন লাইফ গিভস ইউ ট্যানজারিনস' এবং দক্ষিণ কোরিয়ার জনপ্রিয় ব্যান্ড 'ব্ল্যাকপিঙ্ক' এর সদস্য, গায়ক ও র্যাপার জেনির একটি হিট গান।
তবে যেসব ড্রাইভে উচ্চ ঝুঁকির কনটেন্ট থাকে, সেগুলো মূলত ইউএমজির 'শিক্ষামূলক প্রোগ্রাম'—তাতে থাকে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে বিভিন্ন তথ্য, যা কিম জং উন সবচেয়ে ভয় পান বলে মনে করা হয়।
এই ড্রাইভগুলো প্রথমে পাঠানো হয় চীনা সীমান্তে। ইউএমজি-র বিশ্বস্ত সহযোগীরা সেখান থেকে নদী পেরিয়ে এগুলো উত্তর কোরিয়ায় নিয়ে যায়, যেখানে ধরা পড়ার ঝুঁকি থাকে খুব বেশি।
দক্ষিণ কোরিয়ার টিভি নাটকগুলো আপাতদৃষ্টিতে সহজ সরল মনে হলেও, সেগুলোতে উঠে আসে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার নানা দিক—আকাশচুম্বী অ্যাপার্টমেন্টে বসবাস, দ্রুতগামী গাড়ি চালানো, দামি রেস্টুরেন্টে খাওয়া দাওয়া। এতে দক্ষিণ কোরিয়ার মানুষের স্বাধীনতা এবং উত্তর কোরিয়ার পিছিয়ে পড়া জীবনের পার্থক্যও স্পষ্ট হয়।
এতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে কিম জং উনের বছরের পর বছর ধরে প্রতিষ্ঠিত মিথ্যা এবং দক্ষিণ কোরিয়ার দরিদ্র ও অত্যাচারিত মানুষদের বাস্তবতা।
দক্ষিণ কোরিয়ার এসব কন্টেন্ট গুপ্তভাবে উত্তর কোরিয়াতে পৌঁছে দেয়ার পর বড় পরিবর্তনও এসেছে বলে জানান ইউএমজি-র পরিচালক লি কোয়াং-বেক। তিনি বলেন, 'কিছু মানুষ আমাদের জানিয়েছে যে, এই নাটকগুলো দেখে তারা কেঁদেছে এবং প্রথমবারের মতো নিজের স্বপ্নের কথা ভাবতে শুরু করেছে।'
ঠিক কতজন মানুষ এই ইউএসবি-গুলোতে থাকা তথ্য দেখতে পেরেছে, তা জানা কঠিন। তবে সাম্প্রতিক কিছু উত্তর কোরিয়ার পলাতকদের বয়ান থেকে বোঝা যায়, এই তথ্য আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ছে এবং প্রভাব ফেলছে।
লিবার্টি ইন নর্থ কোরিয়া নামের সংস্থার সোকিল পার্ক জানান, 'সাম্প্রতিক উত্তর কোরিয়ার পলাতক ও শরণার্থীরা বেশিরভাগই বলেছে, এসব বিদেশি কনটেন্টই তাদের জীবন বাজি রেখে পালানোর প্রেরণা জুগিয়েছে।'
উত্তর কোরিয়ায় কোনো রাজনৈতিক বিরোধী দল বা প্রকাশ্য ভিন্নমত নেই, তাই প্রতিবাদ করতে একসাথে জড়ো হওয়া খুবই বিপজ্জনক। তবু সোকিল পার্ক আশা রাখেন, এই কনটেন্টগুলো দেখে অন্তত কিছু মানুষ একা একা হলেও প্রতিরোধের পথ খুঁজে পাবে।
উত্তর কোরিয়া থেকে পালিয়ে আসা
২৪ বছর বয়সী কাং গিউরি বড় হয়েছেন উত্তর কোরিয়ায়। সেখানেই তিনি একসময় মাছ ধরার ব্যবসা চালাতেন। তবে ২০২৩ সালের শেষের দিকে তিনি নৌকায় করে পালিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ায় পৌঁছান।
বিদেশি টিভি অনুষ্ঠান তার এই সিদ্ধান্তে কিছুটা অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল বলে জানিয়েছেন তিনি। 'আমি দমবন্ধ লাগছিল, হঠাৎই দেশ ছেড়ে পালানোর তাগিদ অনুভব করলাম', বলেন কাং।
গত মাসে সিউলের এক পার্কে রোদঝলমলে দুপুরে আমাদের সাক্ষাৎকালে কাং ফিরে তাকালেন শৈশবের স্মৃতির দিকে—কীভাবে তিনি মায়ের সঙ্গে লুকিয়ে লুকিয়ে বিদেশি রেডিও সম্প্রচার শুনতেন। প্রথম কে-ড্রামা হাতে পান মাত্র ১০ বছর বয়সে। এরপর জানতে পারেন, কন্টেন্ট ভর্তি ইউএসবি এবং এসডি কার্ড ফলের বাক্সে ভরে পাচার করা হয়।
আরও বেশি করে বিদেশি অনুষ্ঠান দেখার পর তিনি বুঝতে পারেন, সরকার তার সঙ্গে মিথ্যা বলেছে। কাং বলেন, 'আমি ভাবতাম আমাদের ওপর এত নিয়ন্ত্রণ থাকা স্বাভাবিক। ভেবেছিলাম, হয়তো সব দেশেই এমন নিয়ন্ত্রণ থাকে। কিন্তু পরে বুঝলাম, আসলে এমন নিয়ন্ত্রণ শুধু উত্তর কোরিয়াতেই আছে।'
কাং আরও জানান, সেখানে প্রায় সবাই দক্ষিণ কোরিয়ার টিভি অনুষ্ঠান আর সিনেমা দেখতেন। বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে ইউএসবি বিনিময় করতেন।
'আমরা সবাই মিলে জনপ্রিয় নাটক আর অভিনেতাদের নিয়ে কথা বলতাম, সাথে কে-পপ তারকাদের নিয়েও—বিশেষ করে বিটিএস-এর কিছু সদস্য আমাদের খুব ভালো লাগত', জানান তিনি।
তিনি আরও বলেন, 'আমরা প্রায়ই দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনীতি কতটা উন্নত, সেসব নিয়েও গল্প করতাম। কিন্তু সরাসরি উত্তর কোরিয়ার শাসন ব্যবস্থার সমালোচনা করতাম না।'
এই অনুষ্ঠানগুলোর প্রভাব তাদের কথাবার্তা আর পোশাকেও পড়েছে বলে জানান কাং। তিনি বলেন, 'উত্তর কোরিয়ার তরুণ প্রজন্মের মধ্যে দারুণ পরিবর্তন এসেছে।'
তরুণদের দমনে নতুন কৌশল আর শাস্তি
এসব ইউএসবি দিয়ে বিদেশি কন্টেন্ট এর প্রবেশ নিয়ে বেশ ভালভাবেই অবগত কিম জং উন। সেই সাথে চলতি সময়ে নিজের শাসনব্যবস্থার ঝুঁকি সম্পর্কেও আরও সচেতন হয়েছেন কিম, তাই তিনি প্রতিরোধ শুরু করেছেন।
করোনার সময় তিনি চীনের সীমান্ত বরাবর নতুন বৈদ্যুতিক বেড়া তৈরি করান, যাতে বাইরে থেকে তথ্য প্রবেশ করা কঠিন হয়ে যায়। ২০২০ থেকে শুরু হওয়া নতুন আইন অনুযায়ী, বিদেশি ভিডিও বা তথ্য যারা বিতরণ করবে, তাদের জেল বা মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি হতে পারে।
এর প্রভাবও হয়েছে বেশ মারাত্মক। ইউনিফিকেশন মিডিয়া গ্রুপের পরিচালক লি কুয়াং-বেক বলছেন, 'আগে এসব ভিডিও খোলা বাজারে বিক্রি হতো। এখন শুধু খুব কাছের মানুষদের কাছ থেকেই পাওয়া যায়।'
কাং গিউরি বলছেন, কড়াকড়ি শুরুর পর তিনি ও তার বন্ধুরা অনেক বেশি সতর্ক হয়ে গেছেন। 'এখন আমরা কারও সঙ্গে এসব নিয়ে কথা বলি না, যদি না খুবই কাছের কেউ হয়। তাও খুব গোপনে।'
তিনি জানান, দক্ষিণ কোরিয়ার ভিডিও দেখার অপরাধে ধরা পড়ে আরও অনেক তরুণের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে।
সম্প্রতি কিম জং উন কোরিয়ান-ড্রামা দেখার সঙ্গে জড়িত হতে পারে এমন আচরণকেও দমন করেছেন। ২০২৩ সালে তিনি দক্ষিণ কোরিয়ার ভাষা ব্যবহার বা সেই উচ্চারণে কথা বলা অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করেন।
'ইয়ুথ ক্র্যাকডাউন স্কোয়াডস' (Youth Crackdown Squads) নামে একটি দল শহরের রাস্তায় পেট্রোল দেয়, তরুণদের আচরণ নজরদারি করার জন্য। কাং গিউরি বলছেন, পালানোর আগে তাকে বারবার আটকানো হত এবং দক্ষিণ কোরিয়ার মতো পোশাক পরা বা চুল সেজে রাখার জন্য তিরস্কার করা হত।
স্কোয়াড সদস্যরা তার মোবাইল জব্দ করে তার টেক্সট মেসেজ পড়ত, যাতে নিশ্চিত হওয়া যায় সে কোনো দক্ষিণ কোরিয়ার শব্দ ব্যবহার করেনি।
২০২৪ সালের শেষদিকে, সিউলে অবস্থিত ইউনিফিকেশন মিডিয়া গ্রুপের (ইউএমজি) সংবাদ সংস্থা ডেইলি এনকে একটি উত্তর কোরিয়ার মোবাইল ফোন দেশ থেকে চোরাই পথে বের করতে সক্ষম হয়।
মোবাইল ফোনটি এমনভাবে প্রোগ্রাম করা ছিল যে, যখন কোনো দক্ষিণ কোরিয়ান শব্দের ভেরিয়েন্ট লেখা হয়, তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে মুছে ফেলা হয় এবং তার স্থানে উত্তর কোরিয়ার সমতুল্য শব্দ বসানো হয়—এক ধরনের অরওয়েলিয়ান নিয়ন্ত্রণই বলা যায়।
উইলিয়ামস বলেন , 'স্মার্টফোন এখন উত্তর কোরিয়ার মানুষদের মানসিক অবস্থা প্রভাবিত করার কৌশলের অবিচ্ছেদ্য অংশ।'
তবে এসব দমন নীতির পরিপ্রেক্ষিতে তিনি মনে করেন, এই তথ্য যুদ্ধে এখন উত্তর কোরিয়া 'অধিকাংশ দিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে'।
২০২৫ সালের শুরুতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের হোয়াইট হাউসে পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর, উত্তর কোরিয়ার মানুষের কাছে তথ্য পৌঁছে দিতে কাজ করা বেশ কয়েকটি সাহায্য সংস্থার তহবিল বন্ধ করে দেওয়া হয়। এদের মধ্যে ছিল এমন দুটি ফেডারেল অর্থায়িত সংবাদ সেবা, রেডিও ফ্রি এশিয়া ও ভয়েস অব আমেরিকা (ভিওএ), যারা রাতের বেলা উত্তর কোরিয়ায় সম্প্রচার করত।
ভয়েস অব আমেরিকা-কে ট্রাম্প 'চরমপন্থী' এবং 'ট্রাম্পবিরোধী' হিসেবে অভিযোগ করেন। তাছাড়া হোয়াইট হাউস বলেছে এই পদক্ষেপের মাধ্যমে তারা 'করদাতাদের থেকে চরমপন্থী প্রচারণার বোঝা আর নেবেনা'।
তবে সিউলে অবস্থিত ভয়েস অব আমেরিকা-এর প্রাক্তন ব্যুরো প্রধান স্টিভ হারম্যান বলেন, 'এটি উত্তর কোরিয়ার মানুষের বিশ্ব সম্পর্কে জানার খুবই সীমিত একটি জানালা ছিল, যা কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই বন্ধ হয়ে গেছে।'