বিদেশি সিনেমা, ড্রামা দেখার জন্য মৃত্যুদণ্ড দেওয়া বাড়িয়েছে উত্তর কোরিয়া: জাতিসংঘের প্রতিবেদন
উত্তর কোরিয়ায় মৃত্যুদণ্ডের হার বাড়ছে বলে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। বিশেষ করে বিদেশি সিনেমা ও টেলিভিশন নাটক দেখা কিংবা শেয়ার করার অভিযোগে বহু মানুষকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হচ্ছে। খবর বিবিসির।
জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় জানিয়েছে, গত এক দশকে উত্তর কোরিয়ার সরকার নাগরিকদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ আরও কঠোর করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, 'আজকের বিশ্বে অন্য কোনো জনগোষ্ঠী এত সীমাবদ্ধতার মধ্যে নেই।' নজরদারি এখন 'আরও ব্যাপক', যা প্রযুক্তির অগ্রগতির কারণে সম্ভব হয়েছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক সতর্ক করে বলেছেন, এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে জনগণ 'আরও ভোগান্তি, নিষ্ঠুর দমন-পীড়ন ও দীর্ঘদিনের ভয়ের শিকার হবে'।
জাতিসংঘের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনটি উত্তর কোরিয়া থেকে পালিয়ে আসা ৩০০ জনের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে তৈরি। এতে বলা হয়, দেশটিতে মৃত্যুদণ্ডের ব্যবহার ক্রমেই বেড়েছে। ২০১৫ সালের পর থেকে অন্তত ছয়টি নতুন আইন চালু হয়েছে, যেখানে বিদেশি চলচ্চিত্র বা নাটক দেখা ও শেয়ার করাকেও মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধ হিসেবে রাখা হয়েছে।
পালিয়ে আসা অনেকের দাবি, ২০২০ সালের পর এসব অপরাধে মৃত্যুদণ্ডের ঘটনা বেড়েছে। এসব শাস্তি জনসমক্ষে গুলি করে কার্যকর করা হয়, যাতে সাধারণ মানুষ ভয় পায় এবং আইন ভঙ্গ না করে।
২০২৩ সালে উত্তর কোরিয়া থেকে পালিয়ে আসা কাং গিউরি বিবিসিকে জানান, তার তিন বন্ধু দক্ষিণ কোরিয়ার কনটেন্ট রাখার দায়ে মৃত্যুদণ্ড পান। তিনি দেখেছিলেন, ২৩ বছরের এক বন্ধুকে মাদক অপরাধীদের মতোই মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। কাং বলেন, 'এখন এসব অপরাধকে একইভাবে দেখা হয়। ২০২০ সালের পর থেকে মানুষ আরও ভীত হয়ে পড়েছে।'
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০১১ সালে কিম জং উন ক্ষমতায় আসার পর অনেকেই জীবনের উন্নতি হবে বলে আশা করেছিলেন। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, আর 'অনাহারে' থাকতে হবে না। কিন্তু ২০১৯ সালে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে কূটনীতি এড়িয়ে অস্ত্র কর্মসূচিতে জোর দেওয়ার পর মানবাধিকার পরিস্থিতির 'অবনতি' ঘটে।
প্রায় সব সাক্ষাৎকারদাতা বলেছেন, তারা পর্যাপ্ত খাবার পাননি, দিনে তিন বেলা খাওয়াই ছিল 'বিলাসিতা'। করোনা মহামারির সময় তীব্র খাদ্যসংকট দেখা দেয় এবং অনেকে অনাহারে মারা যান। একই সময়ে সরকার অনানুষ্ঠানিক বাজার ও সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ কঠোর করে, ফলে জীবিকা নির্বাহ আরও কঠিন হয়ে পড়ে।
২০১৮ সালে পালিয়ে আসা এক তরুণী বলেন, 'কিম জং উনের শুরুর দিকে কিছুটা আশা ছিল। কিন্তু তা বেশিদিন টেকেনি। সরকার ধীরে ধীরে মানুষকে স্বাধীনভাবে জীবিকা নির্বাহের সুযোগ বন্ধ করে দেয়। বেঁচে থাকাই হয়ে দাঁড়ায় এক যন্ত্রণা।'
জাতিসংঘ জানিয়েছে, গত এক দশকে সরকার অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক সব ক্ষেত্রে প্রায় সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেছে। আধুনিক নজরদারি প্রযুক্তি এই নিয়ন্ত্রণ আরও শক্ত করেছে। পালিয়ে আসা এক নাগরিক বলেন, এসব দমননীতি আসলে 'মানুষের চোখ-কান বন্ধ করার চেষ্টা', যাতে সামান্যতম অসন্তোষও মুছে ফেলা যায়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, উত্তর কোরিয়ায় জোরপূর্বক শ্রম বেড়েছে। দরিদ্র পরিবারের মানুষদের 'শক ব্রিগেডে' ভর্তির মাধ্যমে নির্মাণ ও খনির মতো কঠিন কাজে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। এসব কাজ ঝুঁকিপূর্ণ, অনেকের মৃত্যু হয়। কিন্তু সরকার মৃত্যুকে মহিমান্বিত করে কিম জং উনের প্রতি 'ত্যাগ' হিসেবে আখ্যা দেয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হাজারো অনাথ ও পথশিশুকেও এসব কাজে যুক্ত করা হয়েছে।
২০১৪ সালে জাতিসংঘ প্রথম বলেছিল, উত্তর কোরিয়ার সরকার মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত। তখন দেশটির রাজনৈতিক কারাগারে ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল। সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অন্তত চারটি রাজনৈতিক কারাগার এখনও চালু রয়েছে। সাধারণ কারাগারগুলোতেও নির্যাতন, অতিরিক্ত শ্রম ও অপুষ্টিতে বন্দিদের মৃত্যু ঘটছে। যদিও কারারক্ষীদের সহিংসতা সামান্য কমেছে বলে কিছু তথ্য পাওয়া গেছে।
জাতিসংঘ পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে পাঠানোর আহ্বান জানিয়েছে। তবে এ জন্য নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন প্রয়োজন, যা চীন ও রাশিয়ার বিরোধিতায় আটকে আছে।
গত সপ্তাহে পিয়ংইয়ংয়ের নেতা কিম জং উন বেইজিংয়ে সামরিক কুচকাওয়াজে অংশ নেন। সেখানে তার পাশে ছিলেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। বিশ্লেষকদের মতে, এটি উত্তর কোরিয়ার কর্মসূচি ও মানবাধিকার পরিস্থিতিতে ওই দেশগুলোর নীরব সমর্থনের ইঙ্গিত।
জাতিসংঘ শুধু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে নয়, উত্তর কোরিয়া সরকারকেও রাজনৈতিক কারাগার উচ্ছেদ, মৃত্যুদণ্ড বন্ধ এবং মানবাধিকার শিক্ষা দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
মানবাধিকার বিষয়ক প্রধান ভলকার তুর্ক বলেন, 'আমাদের প্রতিবেদনে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, বিশেষ করে উত্তর কোরিয়ার তরুণদের মধ্যে পরিবর্তনের প্রবল আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে।'
